বিশ্ববিদ্যালয় হলো সেই বিদ্যাপীঠ যেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা হয়। এর পেছনে যেমন শিক্ষকের অবদান থাকে, তেমনই থাকে শিক্ষার্থীর অবদান। এই জ্ঞান সৃষ্টি কিন্তু এমন নয় যে, একজন শিক্ষক চাইলেই করে ফেলতে পারেন, বরং এই সৃষ্টির জন্য একজন শিক্ষককে যথেষ্ট মেধাবী হতে হয়। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষককে যেমন নতুন কিছু সৃষ্টির পেছনে অনেক সময় দিতে হয়, একইভাবে তাকে জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞান বিতরণও করতে হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন শিক্ষকের পক্ষে এই দুটি কাজ একই সাথে সঠিকভাবে করা হয়ে উঠে না। তাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষক আছেন যারা তাদের বেশিরভাগ সময় জ্ঞান সৃষ্টির জন্য গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করেন। আবার কিছু শিক্ষক আছেন যারা এ্যাকাডেমিক কাজে বেশি মনোযোগ দেন। যেহেতু আমাদের দেশে গবেষণা করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা নেই, তাই বেশিরভাগ শিক্ষক এ্যাকাডেমিক কাজের দিকে বেশি মনযোগী।

একজন শিক্ষকের এই এ্যাকাডেমিক কাজগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। শিক্ষকরা শুধু ক্লাসে পড়ান না। তাঁদেরকে বিভাগীয় বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হয়। একই সাথে, তাঁকে ক্লাসের জন্য পড়তে হয়। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা, পরীক্ষার খাতা দেখা, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন করা, এক বা একাধিক প্রজেক্ট এবং থিসিস, অনেক ক্ষেত্রে পিএইচডি স্টুডেন্টদের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবেও কাজ করতে হয়। নতুন নতুন গবেষণা নিয়ে ভাবতে হয়, গ্রান্ট প্রপোজাল লিখতে হয়, গবেষণা করতে হয় এবং গবেষণার ফলাফলগুলোকে প্রকাশ করার জন্য গবেষণা পত্র লিখতে হয়। পাশাপাশি রিভিউয়ার হিসাবে কাজ করতে হয়, ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কাউন্সেলিং করতে হয়। 


আমরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য অর্থ ব্যয় করি; কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য যে দূরদর্শিতা দেখানো দরকার সেটি দেখাই না। …বলা হয়, এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক নেই যার কাজ জ্ঞান সৃষ্টি, গ্রহণ এবং বিতরণ করা। প্রশ্ন— আমরা কি সেই শিক্ষক তৈরির জন্য মানসম্মত পরিবেশ দিচ্ছি?


এদেশে শিক্ষার পেছনে খুবই কম বরাদ্দ দেয়া হয়। গবেষণা খাতে বরাদ্দ অপ্রতুল। বেতন স্কেল শিক্ষকবান্ধব নয়। মেধাবীদের শিক্ষক হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয় না। এশিয়াতে আমরাই মনে হয় একমাত্র দেশ, যেখানে শিক্ষাখাতে, গবেষণা খাতে এবং শিক্ষকদের বেতন খাতে বিনিয়োগ সর্বনিম্ন।

আমরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার জন্য অর্থ ব্যয় করি; কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য যে দূরদর্শিতা দেখানো দরকার সেটি দেখাই না। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে দুধে ব্যাকটেরিয়া আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করার কোনো সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশে নেই, থাকলেও প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ পাশের দেশ ভারতে এই সুবিধা আছে। বলা হয়, এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত শিক্ষক নেই যার কাজ জ্ঞান সৃষ্টি, গ্রহণ এবং বিতরণ করা। প্রশ্ন— আমরা কি সেই শিক্ষক তৈরির জন্য মানসম্মত পরিবেশ দিচ্ছি?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে পড়াশুনা হয় এটি আমার আগে জানা ছিলো না। যখন সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হলো, তখন সেই কলেজগুলোতে কীভাবে অনার্স আর মাস্টার্স চলছে সেটি জানার সুযোগ হয়েছে। ঢাকার ভেতরের কলেজগুলোতে পড়াশোনার যে অবস্থা দেখে এলাম, ঢাকা বাইরের কলেজগুলোতে শিক্ষার মান নিয়ে কথা না বলাই ভালো।

প্রথম দিন যখন একটি কলেজে গেলাম, জিজ্ঞাসা করেছিলাম ছাত্র-ছাত্রীদের, কেন তাদের এই করুণ অবস্থা। বললো, সারা বছর কোনো ক্লাস হয় না, সব বিষয় পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই, ল্যাব নেই, যে কয়টি ল্যাব আছে তা খুব একটা মানসম্মত নয়। তারা সবাই এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আমি প্রাইভেট পড়াই কিনা। আমি বললাম, না। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন প্রাইভেট পড়তে হবে? বললো, এখানে সবাই প্রাইভেট পড়ে। যেহেতু কোনো ক্লাস হয় না, তাই প্রাইভেট না পড়লে পাস করা সম্ভব নয়।

আমি বুঝতে পারছি না, যেখানে এই সাত কলেজে অনার্স এবং মাস্টার্স করানোর মতো পর্যাপ্ত শিক্ষক, ল্যাব এবং ক্লাসরুম নেই, সেখানে এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কোনোরকমে একটি ডিগ্রি দিয়ে কেন তাদের ভবিষ্যতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে?


আমি বর্তমানে প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালার বিরুদ্ধে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে ধ্বংস করে দেবে। যদি এই অভিন্ন নীতিমালার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়, তাহলে উপরের বর্ণিত ঘটনার মতো একসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎও একই রকম হবে। তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না, বরং হয়ে যাবে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।


আমি বর্তমানে প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালার বিরুদ্ধে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণাকে ধ্বংস করে দেবে। যদি এই অভিন্ন নীতিমালার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়, তাহলে উপরের বর্ণিত ঘটনার মতো একসময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎও একই রকম হবে। তখন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে না, বরং হয়ে যাবে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। সবাই ৮টা থেকে ৫টা অফিস করবে, ক্লাসে যাবে|

এটি ভালোভাবে উপলব্ধি করা দরকার যে, একজন শিক্ষকের কাজকে কখনোই ৮টা থেকে ৫টা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। প্রস্তাবিত অভিন্ন নীতিমালায় যারা পিএইচডি না করে শুধু বিভাগে ৮টা থেকে ৫টা পর্যন্ত অফিস করবে, তারা বেশি সুবিধা পাবে। বঞ্চিত তারাই হবে যারা (শুধু) একটি পিএইচডি করার জন্য সময় নষ্ট করবে, পোস্ট ডক করা তো অনেক দূরের বিষয়! এছাড়াও, এই অভিন্ন নীতিমালায় আরও অনেক বৈষম্য আছে যা শিক্ষাবিরোধী। এখানে সুকৌশলে গবেষণাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।  

সবশেষে, আমাদেরকেই ভাবতে হবে কেমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই আমরা। যতোদিন না আমরা শিক্ষকদেরকে একটি সম্মানজনক বেতন স্কেল দিতে না পারবো, একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ দিতে না পারবো, গবেষণার জন্য বরাদ্দ দিতে না পারবো, রাজনৈতিক এবং ব্যাক্তি স্বার্থে কোনো গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা থেকে বিরত না থাকবো, শিক্ষক রাজনীতিকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করতে পারবো, ততদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে স্বপ্ন সেটি স্বপ্নই থেকে যাবে।       

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

গৌতম সাহা

গৌতম সাহা

ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মন্তব্য লিখুন