শিশু খেতে চাইছে না। মা বা অন্য কেউ বলছেন, “এই, তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও! নইলে বাঘ (অথবা ভূত) এসে ধরে নিয়ে যাবে কিন্তু।” তাতেও কাজ না হলে বলেন, “এই বাঘ, আয় তো! এই দুষ্টু বাচ্চাটাকে ধরে নিয়ে যা তো।” এসব বলে আর বাঘের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম প্রথম ওরা বেশ ভয় পায়। ভয়ে কান্না করে আর খেয়েও নেয়। পরে বুঝে যায়, এটি মিথ্যে কথা। এও বুঝে যায়, মিথ্যে বলা শিখিয়ে দিয়েছে বড়রাই।

এ-সমস্যার সমাধান কী? সমাধান খোঁজার আগে জানতে হবে, শিশু কেনো খেতে চায় না। আমরা একবারও কি ভেবেছি, আমাদের বড়দের কি সবসময় একই রুটিনে, একই পরিমাণ এবং একই খাবার খেতে ইচ্ছে করে? অবশ্যই করে না। তাই ইচ্ছেমতো একটু আগেপরে খাই। নয়তো খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনি। কিংবা পরিমাণ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিই। কখনও কখনও কোনো একবেলা কিছু খাওয়া থেকেও বিরত থাকি।

তাহলে শিশুর বেলায় কেনো ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার বাধ্য হয়ে গিলতে হবে? ওরা বলতে পারে না, তাই কান্না করে বোঝায় আর খাবো না। ওদের পেটে আর জায়গা থাকে না, তাই আর না খাওয়ার জন্যে কান্না করে। আর আমরা বড়রা সেটি না বুঝে ওদের মুখে আরও খাবার গুঁজতে থাকি— কারণ প্লেটের সব খাবার শেষ করা চাই। নিরুপায় হয়ে শিশুরা খাবার গেলে আর বাঁচার জন্যে বমি করে দেয়। মাঝে মাঝে এ অবস্থাতেও আমরা থামি না; বরং বমি পরিষ্কার করে আবার খাবার গুঁজতে থাকি।


আমরা একবারও কি ভেবেছি, আমাদের বড়দের কি সবসময় একই রুটিনে, একই পরিমাণ এবং একই খাবার খেতে ইচ্ছে করে? অবশ্যই করে না। তাই ইচ্ছেমতো একটু আগেপরে খাই। নয়তো খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন আনি। কিংবা পরিমাণ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিই। কখনও কখনও কোনো একবেলা কিছু খাওয়া থেকেও বিরত থাকি। তাহলে শিশুর বেলায় কেনো ঘড়ি ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণ খাবার বাধ্য হয়ে গিলতে হবে?

এটুকু জোর দিয়ে বলা যায়, ক্ষুধা থাকলে শিশুদের না খাওয়ার বিশেষ কোনো কারণ নেই; যদি না তারা অসুস্থ থাকে। শিশুদের পরিচর্যাকারী হিসেবে আমরা এই ধৈর্য্যটুকু ধরতে পারছি না। প্লেটের সবটুকু খাবার শেষ করতে হবে, এই ভ্রান্ত ধারণা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। ওরা আর খেতে না চাইলে, তখনই থেমে যাওয়া উচিৎ। যদি মনেই হয়, ওদের পেট ভরে নি এখনও, খানিক বাদে অন্য কিছু দেওয়া যেতে পারে— যদি ওরা খেতে চায়।

খাওয়া একটি মজার কাজ। এক ধরনের বিনোদনও বটে। কিন্তু সেই খাওয়াই হয়ে ওঠে শিশুর জন্যে ভীতিকর বিষয়। খাওয়া মানেই অত্যাচার মনে হয় তখন। খেতে না চাওয়া আর কান্না করা ছাড়া উপায় থাকে না কোনো।

একবার একেবারেই খেতে না চাওয়া এক শিশুকে নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছিল। শিশুটি যখন কিছুতেই খেতে চাইলো না এবং প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করলো, তখন ওকে ঘরে একলা রেখে পাশে খাবার রেখে দেওয়া হল। ও কান্না করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে উঠে পাশে খাবার দেখে নিজেই খেয়ে নিলো। আমাদের বড় মেয়ের ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটি করেছি অনেকবার। ও আর খেতে না চাইলে জোর করে ওর মাকে থামিয়ে দিতাম। এমনও হয়েছে, ওর পেট ভরেনি কিন্তু খেতে চাইছে না। আমি ওর মায়ের কাছ থেকে খাবার কেড়ে নিতাম। পরে ঠিকই দেখেছি, আমার বা ওর মায়ের কাছে এসে বলছে, আমার ক্ষুধা লেগেছে! আমাদের মোটামুটি সচ্ছল ঘরের আদরের সন্তানদের ক্ষুধা কী জিনিস সেটিই বোঝার সুযোগ দিচ্ছি না। কেবল মুখে খাবার গোঁজার যুদ্ধে ব্যস্ত আছি।

শিশুদের খাদ্যাভাস নষ্ট করছি ওদের পেছনে দৌড়ে দৌড়ে। শিশুদের কাজই হলো বড়দের মনোযোগ আকর্ষণ করা। ওরা জেনে যায়, ওরা না খেতে চাইলে দৌড়াদৌড়ি খেলার এই সুযোগটা পেয়ে যাবে। পাড়ায় ঘুরে ঘুরে খাওয়ানো, বাঘের ভয় দেখিয়ে খাওয়ানো বা টিভি দেখিয়ে খাওয়ানো— কোনোটিই ভালো কাজ নয়। গল্প বা ছড়া বলে বলে খাওয়ানো একটি ভালো উপায় হতে পারে। বেশি ভালো হয়, ছোট-বড় সবাই একসাথে খাওয়া। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শিশুকে নিজের হাতে খেতে দেওয়া উচিত। বড় হওয়ার পথে শিশুর আত্মবিশ্বাস তৈরিতে এটি দারুণ ভূমিকা রাখে।

শিশুরা কান্না করে, কিছুতেই থামতে চায় না। আমরা কান্নার কারণ বুঝতে পারি না। হয়তো মা বলেন, এই তো, বাবা চলে এসেছে! চলতো, দরোজা খুলে দেখি। দরোজা খুলে কাউকে পাওয়া যায় না। শিশু আবার কাঁদে। তখন আবার বলে, বাবা আজকে কী নিয়ে আসবে? শিশুর যেটি পছন্দ, সেই জিনিসের নাম বলে। পরে বাবা ফেরেন খালি হাতে। শিশুর মনে এই মিথ্যে গেঁথে যায়।


কোমলমতি শিশুদের জব্দ করার আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো, পুলিশের ভয় দেখানো। এটি আরও খারাপ। মা-বাবা এতে শুধু মিথ্যেই বলেন না; একটি অতিপরিচিত পেশা সম্পর্কে শিশুমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দেন।

শিশুদের সাথে এমন মিথ্যাচার করা কোনোভাবেই উচিত নয়। ক্ষণিকের জন্যে খুশি করতে গিয়ে, সারাজীবনের জন্যে ভুল শিক্ষা দেওয়ার অধিকার আমাদের নেই বোধহয়। মজার ছলেও কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা পালন করা উচিত। ওরা যদি সাময়িকভাবে তা ভুলেও যায়, তবুও পালন করা উচিৎ। কারণ, কোনো না কোনো সময়ে ওদের ঠিক মনে পড়বে। আমার নিজের সন্তানের বেলাও বহুবার তার প্রমাণ পেয়েছি। সত্যি কথা বলার উদাহরণ শিশুর সামনে যতো বেশি তুলে ধরতে পারব, ওদের ততোটাই সত্যি বলার অভ্যাস তৈরি হবে। নিজেরা মিথ্যের মধ্যে বসবাস করে, শিশুর কাছ থেকে ‘সদা সত্য কথা’ আশা করা হাস্যকর রকমের বোকামি।

কোমলমতি শিশুদের জব্দ করার আরেকটি জনপ্রিয় উপায় হলো, পুলিশের ভয় দেখানো। এটি আরও খারাপ। মা-বাবা এতে শুধু মিথ্যেই বলেন না; একটি অতিপরিচিত পেশা সম্পর্কে শিশুমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে দেন।

তাহলে কী করা উচিত? আমি নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। আমাদের মেয়েরা যখন কান্না করে বা কিছুর জন্যে বায়না করে; আমি ওদের পছন্দের কোনোকিছুর দিকে মন ঘুরিয়ে দিই। যেমন, বড় মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে টেলিভিশন দেখছে। জানি, টিভি বন্ধ করে দিলে ভীষণ কান্নাকাটি করবে। তাই হয়তো বললাম, মা, চলো আমরা নিচে গিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসি। ও আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললো, চলো! জানতাম, সাইকেল চালানো ওর খুব পছন্দ। খুব ছোটবেলায় যখন কান্না করত, আকাশে চাঁদ থাকলে আর কিছুরই দরকার হতো না।

আমরা সাধারণত শিশুকে থামাতে গিয়ে সরাসরি কোনোকিছু করা থেকে বিরত করতে চাই। অথবা হাত থেকে জোর করে কিছু কেড়ে নিই। এটি খুব বোকা একটি উপায়। বিকল্প কোনো আগ্রহের জিনিস সামনে এনেই কেবল আগেরটা বাদ দেওয়া সম্ভব। কিছুতেই কাজ না হলে মাঝে মাঝে একটু কান্না করারও সুযোগ দেওয়া উচিৎ। ওদের এও বুঝা দরকার, ওরা যা যা চায়, তার সবই সবসময় পাওয়া সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ কান্না করে ঠিক পথে চলে আসবে। সব পেয়েছির দেশে নিয়ে গেলে শিশুর বায়না বাড়তেই থাকবে। চাওয়া মাত্র পাওয়ার সুযোগ শিশুকে নেশাগ্রস্ত করে। পরে শুধুশুধু ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।

শিশু হয়তো কোনোকিছুতে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেল। তার কান্না থামাতে সেই জিনিসকে ধরে মারা হয়। তাতে হয়তো কান্না থামে, কিন্তু শিশু শিখছে— কেউ আঘাত করলে তাকে পাল্টা আঘাত করতে হয়। মনে হতে পারে, এতো ছোটখাট বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কী আছে? কে জানে, আজকের পৃথিবীর এই অসহিষ্ণুতার এটিও একটি কারণ কিনা?

আমরা সবাই আশা করি, আমাদের সন্তানেরা আমাদের সাথে সবসময় সব বিষয়ে সত্যি কথা বলবে। কিছুই লুকোবে না, কখনই মিথ্যের আশ্রয় নেবে না। আর আমরা সত্যি কথা বলা শেখাতে চাই উপদেশ দিয়ে, নিজেদের জীবনে চর্চা করে নয়। আমরা বুড়োরা দিনরাত ওদের সাথে মিথ্যে বলে চলেছি। ওদের সামনে অন্যদের সাথে মিথ্যে বলে চলেছি। বাবা হয়তো বাড়িতেই আছেন, কিন্তু পাওনাদার থেকে বাঁচার জন্যে মাকে দিয়ে বলানো হচ্ছে, বাড়িতে নেই। শিশুর মনোজগতে জমা হয়ে যাচ্ছে সব। শিশুকে সামনে রেখে পরনিন্দা-পরচর্চা করছি সমানে। আবার বলি, ওরা ছোট মানুষ, শিশু; কিছু বোঝে নাকি? এভাবেই ওদের সাথে মিথ্যে বলার হাজারো উদাহরণ তৈরি করছি। আমরা প্রতিটি মা-বাবাই তার শিশুর সামনে একেকজন মিথ্যেবাদী হয়ে উঠছি।


শিশু হয়তো কোনোকিছুতে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেল। তার কান্না থামাতে সেই জিনিসকে ধরে মারা হয়। তাতে হয়তো কান্না থামে, কিন্তু শিশুকে শিখিয়ে দিচ্ছি— কেউ আঘাত করলে তাকে পাল্টা আঘাত করতে হয়। 

সন্তানের সুন্দর আগামী তৈরির জন্যে এসব পরিহার করা প্রয়োজন। মিথ্যে ভয় দেখিয়ে ওদের মনোজগতে ক্ষতের সৃষ্টি না করি। সত্যি ভয়ও দেখানোর দরকার নেই। ভয় দিয়ে কিছু জয় করা যায় না। যা দিতে পারব না, তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কখনোই যেনো না দিই। আর যদি বলেই ফেলি, এটা-ওটা কিনে দেব; তাহলে অতি অবশ্যই যেনো কিনে দিই। দিতে একটু সময় লাগলে, সেটিও যেনো বলে রাখি।

সন্তান বড় করতে আমরা সবাই পারি। বড় মানুষ হওয়ার শিক্ষা ক’জন দিতে পারছি? কাজটি কঠিন, আবার সহজও। সব ‘না’-গুলোকে তুলে দিন, ওরা ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যে বেড়ে উঠবে। ওদের সাথে মিথ্যে বলা বাদ দিলে, ওরা সত্যিটিই কেবল শিখবে। ভয় না দেখালে বুকে সাহস নিয়েই ওদের বেড়ে ওঠার কথা। শিশু আমাদের। সিদ্ধান্তও আমাদের!

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সুদেব কুমার বিশ্বাস

সুদেব কুমার বিশ্বাস

সুদেব কুমার বিশ্বাস পেশায় একজন শিক্ষাজীবী এবং কাজ ক‌রেন এক‌টি আন্তর্জা‌তিক উন্নয়ন সংস্থায়।

মন্তব্য লিখুন