ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা জাস্টিন বুইবেন বা অ্যাকর্ন-এর গান শোনে, তারা রুনালায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এবং লালনগীতি জানে না, জানে না মমতাজ কে। ইংরেজি মাধ্যমের একটি ছেলে বা মেয়েকে শুধুমাত্র ইংরেজি বলতে পারা এবং উপস্থাপন দক্ষতা ছাড়া প্রশংসা করার মতো তেমন আর কিছু নেই। তারপরও তারা যে শুদ্ধ ইংরেজি বলছে তা কিন্তু নয়। তারা আমাদের নিজস্ব কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ, আমাদের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না বা শ্রদ্ধা দেখায় না। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা কিন্ত এখানে হচ্ছে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২০ ধরনের আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় আছে। অভিভাবকরা স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় বাদ দিয়ে তাদের সন্তানদের এসব আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন কেন? প্রথমত, এখানকার শিক্ষকগণ স্থানীয় ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের চেয়ে অনেক বেশি মানসম্পন্ন। তাছাড়া এসব স্কুলের কারিকুলাম ও কোর্স বিদেশি শিক্ষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, ব্যবস্থাপনাও বিদেশিদের। বিদেশিদের ব্যবস্থাপনা মানে দক্ষ ব্যবস্থাপনা বলে ধরে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ত, বাস্তবজীবনে সমস্যাবলী কীভাবে সমাধান করা যায় এসব স্কুলে সেগুলো শেখানো হয় অর্থাৎ এখানকার শিক্ষা অনেকটাই বাস্তবমুখী। শিক্ষার্থীরা এখানে গণিত ও প্রকৌশলগত দক্ষতাও অর্জন করে। দলে ও জুটিতে কাজ করে কীভাবে বাস্তবজীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করা যায় সে শিক্ষা তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকে। তারা আরও শিখে কোনো একটি ব্যাপার বা বিষয়কে কীভাবে জটিলভাবে ও সৃজনশীল উপায়ে চিন্তা করতে হয়। দেশে বিদেশে চাকুরি করে এখানকার গ্রাজুয়েটরা ইতোমধ্যে সুনাম অর্জন করেছে।

তাদের যোগাযোগ দক্ষতা, ব্যবস্থাপনা প্রশংসনীয়। তাছাড়া এসব স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহজেই ভর্তি হতে পারে। এসব স্কুলে যারা পড়ে তারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ ও মেলামেশার সুযোগ পায়। বড় হয়ে বাস্তব জীবনে অন্যের সাথে কীভাবে মিশতে হয় তা জানার সুযোগ পায়। এসব কারণে স্কুলে পড়ার খরচ অন্যান্য ইংরেজি মাধ্যমের চেয়ে বেশি। তারপরও অভিভাবকরা এখানে তাদের সন্তানদের পাঠাচ্ছেন। এখানকার শিক্ষার্থীরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো টিচিং অ্যাসিসট্যান্টশিপ পেয়ে থাকে। সমস্যা বিশ্লেষণ করা ও গ্রুপ আলোচনার সুযোগ পায়। আরেকটি বড় ব্যাপার হচ্ছে, অভিভাবকদের প্রাইভেট পড়ানোর চিন্তা করতে হয় না।

অভিভাবকদেরকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকদের বাসায় বাসায় যেতে হয় না যা দেশি ইংরেজি মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম এবং ইংরেজি ভার্সনের ক্ষেত্রে করতে হয়। ট্রাফিক জামে আটকে থাকার চিন্তা করতে হয় না। এসব বিদ্যালয় হচ্ছে- কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ইত্যাদি।
আন্তর্জাতিক এসব ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে। অর্ডিনারী ও অ্যাডভান্সড লেভেল, জুনিয়র ও সিনিয়র ক্যামব্রিজ, আমেরিকান হাইস্কুল ডিপ্লোমা, অস্ট্রেলিয়ান হায়ার স্কুল সার্টিফিকেট, আন্তর্জাতিক ব্যাকালরেট ইত্যাদি। এসব ডিগ্রি নেওয়ার পর একজন শিক্ষার্থী উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও গ্রেট ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যায়গুলোতে ভর্তির সুযোগ পায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এসব ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। ফলে এসব স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারছে না। সবাই যে বিদেশে যাচ্ছে বা যেতে পারছে তারও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। অভিভাবকরাও এসব বিষয়ে খুব একটা সচেতন নন। ইউজিসির বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখা দরকার। ইউজিসির এসব ডিগ্রি গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে এসব স্কুল থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির সুযোগ পাবে, দেশও তাদের সেবা পাবে, বাঁচবে বহু দেশি মুদ্রা।

এগুলো ছাড়াও আমাদের রয়েছে দেশি অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়। এগুলো নিয়ে বেশ কিছু নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচলিত আছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সালাম বা আদাব দেওয়ার তোয়াক্কা করে না। ক্লাসে যে কোন সময়, প্রথম পিরিয়ড শেষেও ক্লাসে ঢুকতে পারে; তবে তাদের কিছু বলা যাবে না কারণ কোনো ধরনের শাস্তি এখানে প্রযোজ্য নয়। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা মোটামুটি ফিটফাট পোশাক পরে, তৃতীয় গ্রেডের পর তাদের ড্রেস নিচে নামতে থাকে অর্থাৎ অশালীনভাবে পোষাক-পরিচ্ছদ পরিধান করে- আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাথে যা বেমানান। এসব বিদ্যালয়ে শারীরিক শাস্তির বিধান নেই। কোনো কোনো শিক্ষক বলেন শারীরিক শাস্তি দেয়ার দরকার নেই; শারীরিক শাস্তির ভয় তাদের অনেক কিছু শেখাতো। যাই হোক, এটি একটি বিতর্কিত বিষয়। তবে এটি সত্য যে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই উগ্র এবং আমাদের সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় না এমন অনেক আচরণই করে থাকে। আবার এও সত্য যে, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা আনন্দের মধ্যে দিয়ে শেখে। কিন্তু স্কুলে তো শুধু পড়ালেখা শেখাই উদ্দেশ্য নয়। তারা কাস্টম, ব্যবহার, কালচার, মানবিক আচরণ ও ব্যবহার স্কুলে শিখবে। কিন্তু এই বিদ্যালয়গুলো এসব কিছুর তোয়াক্কা করে না।তারা সব সময়েই চেস্টা করে কীভাবে অন্যের চেয়ে স্মার্ট হওয়া যায়।আর এই স্মার্টের পেছনে ছুটছে সব গার্ডিয়ান ও শিক্ষার্থী। তবে সবাই যে শুধু সন্তানদের স্মার্ট বানানোর জন্যই ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন তা নয়। বাংলা মাধ্যম বা ইংরেজি ভার্সনের অবস্থা যে খুব ভালো তা তো নয়। এসব স্কুলের লেখাপড়া এখনও আধুনিকতা থেকে অনেক দুরে।এখানে ক্রিয়েটিভিটি এবং উদ্ভাবনীর চর্চা বা প্রাকটিস নেই বললেই চলে। পড়া গিলা, খাতায় ঢেলে দেওয়া আর গ্রেড অর্জন করাই মুখ্য।

শিক্ষার্থীরা কী শিখলো বা তাদের বাস্তব জীবনে এগুলো কতটা কাজে লাগবে তার কোনো চেষ্টা বা চিন্তা নেই। কাজেই সচেতন এবং সচ্ছল অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়াও বাংলা মাধ্যমে হাতেগোনা কয়েকটি বিদ্যালয় আছে, সেগুলোতে ভর্তি করানোর চেষ্টা করা মানে এক পাগলামির মতো যুদ্ধ করা। এই যুদ্ধ এড়াতে এবং কোচিং এড়াতে অনেক অসচ্ছল অভিভাবকও তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম তো হলো একেবারে উচ্চবিত্তের খেলা; কিন্তু সাধারণ ইংরেজি মাধ্যমে তো তা নয়। অথচ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয় সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো প্রশংসীয় উদ্যোগ বা চেষ্টা নেই। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীরা জাস্টিন বুইবেন বা অ্যাকর্ন-এর গান শোনে, তারা রুনালায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন এবং লালনগীতি জানে না, জানে না মমতাজ কে। ইংরেজি মাধ্যমের একটি ছেলে বা মেয়েকে শুধুমাত্র ইংরেজি বলতে পারা এবং উপস্থাপন দক্ষতা ছাড়া প্রশংসা করার মতো তেমন আর কিছু নেই। তারপরও তারা যে শুদ্ধ ইংরেজি বলছে তা কিন্তু নয়। তারা আমাদের নিজস্ব কালচার সম্পর্কে অজ্ঞ, আমাদের সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে না বা শ্রদ্ধা দেখায় না। শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা কিন্ত এখানে হচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশের অভিভাবকরা কেন ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে পাঠাচ্ছেন? এর কয়েকটি কারণ আছে। একটি হচ্ছে আধুনিক যুগ ইংরেজি ও কম্পিউটারের যুগ, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো এই চাহিদা পূরণ করছে বলে অনেক অভিভাবক এখানে তাদের ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, বাংলা মাধ্যমে হাতেগোনা দু-একটি বিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোর শিক্ষার পরিবেশ ও মান ভালো নয়। জনসংখ্যার অনুপাতে ঢাকা শহরে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। আর হাতেগোন নামিদামি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া এক ধরনের পাগলামির মতো পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতা। কিছু অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল অভিভাবক টাকা খরচ করা এবং ইংরেজি মাধ্যমে বাচ্চাদের পড়ানো এক ধরনের প্রেস্টিজ বলে মনে করেন। ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখার ধরন ও পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদেরকে ক্রিয়েটিভ হতে বাধ্য করে যা বাংলা মাধ্যমে প্রায় পুরোটাই অনুপস্থিত। এসব কারণের জন্য ইংরেজি মাধ্যমের লেখাপড়া এবং বিদ্যালয়ের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে আর তা ছড়িয়ে পড়ছে সিটি থেকে শহর, শহর থেকে উপজেলা এমনকি গ্রামেও। কাজেই সময় এসেছে এসব বিভিন্ন ধরনের বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং দেশীয় কালচারের সাথে মিল রেখে বাস্তবমুখী শিক্ষাদান করার সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ

মাছুম বিল্লাহ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত রয়েছেন। তিনি সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজ ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মন্তব্য লিখুন