বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে পড়ালেখা ও শিক্ষকতার মান উন্নয়ন পরস্পর সম্পর্কিত। উন্নত দেশে যিনিই অধ্যাপক, তিনিই একজন বিজ্ঞানী। বাংলাদেশে এই দুই চরিত্রকে আলাদা করে দেখা হয়। এরও বিভিন্ন কারণও রয়েছে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে বিশেষ কিছু ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত যেগুলো দেশের উন্নয়নে জরুরি।

পদক্ষেপসমূহ

১) ক্লাসে পড়ালেখা করার আগে ও পরে যেকোনো বিভাগের শিক্ষাক্রম সমসাময়িক বিষয়ের সাথে হালনাগাদ থাকার ব্যবস্থা করা।

২) ক্লাসে ফ্রন্টাল লেকচারের পাশাপাশি বিভিন্ন টিচিং পদ্ধতি প্রয়োগ করা।

 ৩) বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ কলেজের ডিগ্রি কোর্সের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো বিভাগে পাঁচ বছর পড়া মানে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া। সেই জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে উন্নয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের সেই বিষয়গুলো বেশ ভালো করে বুঝানো।

৪) শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দের সাথে ক্লাসে পড়ালেখা করতে পারে সেই ব্যবস্থা প্রয়োগের চেষ্টা করা।

৫) পরীক্ষা ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন আনা দরকার যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষাভীতি তৈরি না হয়।


বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ কলেজের ডিগ্রি কোর্সের মধ্যে অনেক পার্থক্য থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেকোনো বিভাগে পাঁচ বছর পড়া মানে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া। সেই জ্ঞান বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করে উন্নয়ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের সেই বিষয়গুলো বেশ ভালো করে বুঝানো।


৬) শিক্ষার্থীরা যাতে শুধু সিজিপিএর পিছনে না ছুটে জ্ঞান অর্জনের পিছনে ছুটে সেই চেষ্টা করা।

৭) শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়কালীন বিভিন্ন সংগঠন যেমন- সাংস্কৃতিক সংঘ, বিজ্ঞান ক্লাব, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকে সেই পরামর্শ দেওয়া। অনেক শিক্ষার্থীই এ কাজগুলোকে সময়ের অপচয় বলে মনে করে। তাদেরকে বুঝানো উচিত যে এটি কখনোই সময় অপচয় নয়।

৮) বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যেসব প্রজেক্ট এবং থিসিস করে সেগুলো প্রকাশিত না হয়ে পড়ে থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের এসব কাজ বাস্তব জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করা হবে তার ব্যবস্থা করা।

৯) বিভাগে প্রতি সপ্তাহে সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করার ব্যবস্থা করা যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আরো ভালো এ্যাকাডেমিক সম্পর্ক তৈরি হয়।

১০) প্রতি মাসে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিঙের ব্যবস্থা করা।

ক্লাসে পড়ালেখা বিষয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে আমার বিভিন্ন সময় আলোচনার মাধ্যমে প্রাপ্ত উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বেশ কিছু বিষয় আলোচনা করা যেতে পারে।

ক্লাসে পড়ালেখা ও এর প্রতি অনাগ্রহ

অনেক শিক্ষার্থীই বলে যে, তাদের ক্লাসে মনোযোগ থাকে না। এর মূল কারণ, শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষকদের গুণাগুণের বিষয়টি বেশি বিবেচ্য হবে। একজন শিক্ষকের উচিত ক্লাসে পড়ালেখা নিয়ে কার্যক্রম চালানোর সময়ে তাঁর লেকচারের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরি করা। এতে তিনি ব্যর্থ হলে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আগ্রহ ধরে রাখতে পারবে না। শিক্ষকের লেকচারের ভঙ্গি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে। যেমন, কেউ যদি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে লেকচার দেন, তবে তাঁর প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বেশিক্ষণ থাকবে না। তাই ক্লাসে ফ্রন্টাল লেকচারের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষণ পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করতে হবে।

পুরনো লেকচার দিয়ে ক্লাস নেওয়া

এই বিষয়টির প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা জরুরি। অনেক শিক্ষার্থীই বলে যে, বেশিরভাগ শিক্ষক পুরনো লেকচার দিয়ে ক্লাস নেন, সাথে কিছু নোট-পাতা নিয়ে আসেন, যেগুলোকে শিক্ষার্থীরা চোথা বলে। ক্লাসে পড়ালেখা নিয়ে আধুনিক পদ্ধতির সঙ্গে এটি বেমানান। অনেক বয়স্ক অধ্যাপক মাল্টিমিডিয়া পছন্দ করেন না ক্লাস নেওয়ার সময়। অনেকে মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন ব্যবহার করলেও সেখানকার তথ্য হালনাগাদ করেন না। শিক্ষকদের এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে ।

ক্লাস যা পড়ানো হবে সেটি পরীক্ষার খাতায় থাকতে হবে

অনেক শিক্ষার্থীই এ-ধরনের মন্তব্য করে। কোনো বিষয়ের ওপর একজন শিক্ষকের চোথা অনুযায়ী দেওয়া লেকচারে দেওয়া তথ্যের হুবহু কেউ পরীক্ষার খাতায় না লিখলে সেই কোর্সে নম্বর কম দেওয়া হয়। অর্থাৎ, কোনো শিক্ষার্থী যদি পরীক্ষার খাতায় কোনো বিষয়ের হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করে, তবে তাকে নম্বর কম দেওয়া হয়। এর জন্য পরীক্ষার ফল খারাপ হয়। সব শিক্ষকের এই বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে যে, এখন তথ্য বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যায়। কেউ যদি হালানাগাদ তথ্য ব্যবহার করে, তবে সেটিই যুক্তিসঙ্গত হওয়া উচিত ।

ক্লাসে যা পড়ানো হয় তা কোনো কাজে আসে না

অনেক শিক্ষার্থীই মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে পড়ালেখা যা করানো হয় সেগুলো আসলে কোনো কাজে আসে না। কারণ, বাংলাদেশর চাকরির পরীক্ষায় প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়ের বাংলা, ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়। সুতরাং, এতো পড়ে কী লাভ? আসলেই তাই। আর এজন্য দরকার দেশের চাকরির নিয়োগ সিস্টেমের পরিবর্তন করা। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ ডিগ্রি কলেজের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।

গবেষণায় অনীহা

বলতে গেলে, বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ৯৫%-এরও বেশি শিক্ষার্থীর গবেষণায় অনীহা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষার অভাব, পরিবেশের অভাব, চাকরির নিয়োগ ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সমস্যা ইত্যাদি। অনেক শিক্ষার্থীই প্রকৃত শিক্ষা পায় না। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তাই আমাকেও হতে হবে— এ-রকম একটি ভ্রান্ত ধারণা থাকে অনেকের। এ ধারণা নিয়ে যারা আসে তাদের সঙ্গে সাধারণ ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না।


যে শিক্ষক নিজেই গবেষণা করেন না, তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে পারেন না। আরেকটি মূল সমস্যা হলো, দেশের চাকরির বাজারে গবেষণার মূল্য কম। এসব কারণে শিখার্থীরা গবেষণায় আগ্রহী হয় না ।  


আবার অনেকেই গবেষণা করতে চায়, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণার পরিবেশ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্লাসে পড়ালেখা ও এর সাথে সম্পর্কিত কাজ ছাড়া শিক্ষকদের অনেকে নিজেরাই গবেষণায় আগ্রহী নন। এর ফলাফল একজন ভালো শিক্ষার্থীর ওপরেও পড়ে। যে শিক্ষক নিজেই গবেষণা করেন না, তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে পারেন না। আরেকটি মূল সমস্যা হলো, দেশের চাকরির বাজারে গবেষণার মূল্য কম। এসব কারণে শিখার্থীরা গবেষণায় আগ্রহী হয় না ।  

একটি দেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে হতে হবে জ্ঞান তৈরির কারখানা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের তাঁর শিক্ষকতাকালীন সময়ে অনেক ভূমিকা পালন করতে হয়। সর্বোপরি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁর গবেষণায় ও শিক্ষকতায় বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরবেন এটিই প্রত্যাশা।

মিঠুন কুমার: রিমোট সেন্সিং ইঞ্জিনিয়ার, ও সিনিয়র লেকচারার। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট, স্পেস এন্ড এনভাইরনমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (SERC), বাংলাদেশ ।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

মন্তব্য লিখুন