বাড়ি ই-শিক্ষা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে? ছবি: The Print
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হচ্ছে? ছবি: The Print

বাংলাদেশে একটা সময় প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে না? এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত দেয়া হয়েছে। বর্তমানে, সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হচ্ছে। এ নিয়েও ছাত্র-ছাত্রী আর শিক্ষকরা ভিন্ন মত পোষণ করছে। এই বিষয়গুলো নিয়েই আজ আমি আমার মতামত তুলে ধরবো। যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস নেয়ার কথা বলা হয় তাহলে সাধারণত তিনটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। তা হলো ১. ছাত্র-ছাত্রী, ২. শিক্ষক, ৩. অনলাইন শিক্ষা এবং পরিবেশ।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস ও শিক্ষার্থীদের অবস্থা

অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করার জন্য আমাদের প্রথমেই জানতে হবে ছাত্র-ছাত্রীরা কী ভাবছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস শুরুর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত জানার জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করে। গণিত বিভাগে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৬০০-এর চাইতেও বেশি। কিন্তু এই জরিপে অংশগ্রহণ করেছে মাত্র ২২৬ জন ছাত্র-ছাত্রী। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছাত্র-ছাত্রীদের মতামত আমরা জানতে পারিনি। তার মানে হলো, বড় একটি অংশ আমাদের নেটওয়ার্কের বাইরে অবস্থান করছে। তাদের অনেকের অবস্থান প্রান্তিক গ্রামগুলোতে, অনেকের অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, অনেকের প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধা নেই।

ফিরে আসি আমাদের জরিপে অংশ নেয়া ২২৬ জন ছাত্র ছাত্রীর মতামত নিয়ে। তাদের অধিকাংশ অবস্থান করছে জেলা শহরগুলোতে। তাদের সবাই অনলাইনে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৩৫% অনলাইন ক্লাসে আগ্রহী এবং ১৬.৩% সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এই ২২৬ জন ছাত্র-ছাত্রীকে আরো একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। তা হলো, তাদের সবার কি অনলাইন ক্লাস করার মতো প্রযুক্তিগত সুবিধা আছে কিনা?

আমরা এখানে প্রযুক্তিগত সুবিধা বলতে বুঝিয়েছি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ। ৪৪.২% ছাত্র-ছাত্রী জানিয়েছে, তাদের অনলাইনে ক্লাস করার মতো প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা আছে যাদের মধ্যে মাত্র ৩৫% অনলাইন ক্লাসে আগ্রহী ছিলো। বাকি যে ১৬.৭% সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলো, তাদের মধ্যে প্রায় ৯% ছাত্র-ছাত্রীর কিন্তু অনলাইন ক্লাস করার মতো সামর্থ ছিলো। বাকি ৪৮.৭% বলেছে তাদের কোনো প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নেই এবং তারা অনলাইন ক্লাসে আগ্রহী নয়। আর ৭.১% এ-বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলো। এই যে জরিপটি পরিচালনা করা হলো, সেটি শুধু একটি বিভাগের চিত্র। আমি অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের সাথে কথা বলে তুলনামূলক একই চিত্র খুঁজে পেয়েছি।

এই জরিপ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার ছিলো যে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা অনলাইন ক্লাস করার মতো প্রস্তুত ছিলো না। অথবা তাদের যে সুযোগ-সুবিধাগুলো দেয়া দরকার, সেটি দেয়ার সামর্থ্য আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্জন করতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে, জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস নেয়া শুরু করেছে এবং ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির হার খুবই সন্তোষজনক।

বিশেষ করে, ৮০-৯০% ছাত্র-ছাত্রী শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত থাকছে এবং আমরা স্বাভাবিক সময়ে শ্রেণিকক্ষে পড়াতে গিয়েও এতো বেশি উপস্থিতি পেয়েছি বলে মনে হয় না। এ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশুনায় ফিরতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে এবং তারাও এখন মানসিকভাবে প্রস্তুত পড়াশুনা করার জন্য। এই সময় প্রতিটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যাগুলো জানার চেষ্টা করছে এবং সেগুলো দ্রুত সমাধান করার জন্য তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।  

শিক্ষকদের ভূমিকা

অনলাইন ক্লাস পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকরা; কারণ তাঁদেরকেই ক্লাস কীভাবে নিতে হয়। কীভাবে ক্লাস নিলে ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হবে সেই বিষয়টি তারাই পরিচালনা করেন। যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাসের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগ্রহী ছিলো না, তখন কি শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাস নেবার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন? এজন্য আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে ছোট একটি জরিপ চালিয়েছিলাম। সর্বমোট ১৬০ জন শিক্ষক তাদের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। দেখা যায়, ৬৩.১% শিক্ষক অনলাইন ক্লাস নেবার ব্যাপারে আগ্রহী। ৩৬.৯% শিক্ষক অনলাইন ক্লাস নেবার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার, আমাদের শিক্ষকরা সব প্রতিকূলতাকে মেনে নিয়েই অনলাইন ক্লাস নিতে চাচ্ছেন। তাদেরকে আরেকটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেটি হলো, তাদের প্রযুক্তিগত সুবিধা যেমন কম্পিউটার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ আছে কিনা।

দেখা যাচ্ছে, ৭.৫% শিক্ষকের অনলাইন ক্লাস নেবার জন্য কোনো কম্পিউটার নেই। ১৫% শিক্ষকের উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ নেই এবং ৩৬.৩% শিক্ষকের কোনো কম্পিউটার ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ নেই। শুধু ৪১.৩% শিক্ষকের কম্পিউটার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ আছে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, ২১.৮ % শিক্ষকের প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকার পরও তারা অনলাইনে ক্লাস নিতে আগ্রহী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে জয় করেই অনলাইন ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস কীভাবে নেবেন সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কীভাবে শিক্ষকরা জুম-এর লাইসেন্সড ভার্সন পাবেন সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেবার ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যদিও এখন পর্যন্ত সকল সুযোগ-সুবিধা শিক্ষকরা পাননি, তারপরও আমি তাদের এই আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই।      

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস ও শিক্ষার পরিবেশ

অনলাইনে ক্লাস পরিচালনা করার জন্য দরকার হয় একটি অনলাইন ক্লাসরুম। এই সুবিধা আমাদের দেশের কোনো পাবলিক বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। তাই অনলাইন ক্লাস নেবার জন্য আমাদের সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে জুম্, গুগল ক্লাসরুম, ইউটিউব ইত্যাদি। কিন্তু আপনি এগুলো ব্যবহার করে কিছু শিক্ষার্থীকে সেই ক্লাসরুমে যুক্ত করে কোনো একটি বিষয় পড়িয়ে ফেলতে পারবেন— ব্যাপারটি কিন্তু শুনতে যতো সহজ মনে হচ্ছে, আসলে তেমন নয়। বরং যারা এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছেন, তাদের কেউই আমাকে পজিটিভ ফিডব্যাক দেয়নি। আপনি গণিত ক্লাসে গিয়ে গল্প বলবেন না, গণিত পড়াবেন। বাংলা ক্লাসে গিয়ে সাহিত্য পড়াবেন।

দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। আপনি ফাঙ্কশনাল অ্যানালাইসিস, রিয়েল অ্যানালাইসিস, টোপোলজি, টেনসর, মেকানিক্স, ম্যাথেমেটিক্যাল মেথডস ইত্যাদি বিষয়ের ক্লাস ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর পরও অসংখ্য প্রশ্ন থেকে যায়। তাদেরকে আপনি অনলাইনে পড়াতে গেলে কীভাবে পড়াবেন? বিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রীদের ল্যাব থাকে, যেখানে তাদের কাজ করতে হয়, সেটি আপনি কীভাবে করবেন? আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকেই অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে, আমরা প্রতিটি বিভাগ থেকে তাদেরকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করছি। আমাদের শিক্ষক সমিতি থেকেও তাদেরকে সাহায্য করছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এই সহযোগিতা করার জন্য অনেক শিক্ষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানসিকভাবে অনেক ছাত্র-শিক্ষক ভালো নেই, এটিও কিন্তু বুঝতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করার পরিবেশ পাচ্ছে কিনা সেটিও ভেবে দেখা দরকার। ছাত্র-ছাত্রীরা হল ছেড়ে যাবার সময় অনেকেই তাদের পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় বইসমূহ সাথে নিয়ে যেতে পারেনি।

উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিছু গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নিয়েছে। যেমন, আমরা জুম্ ব্যবহার করে ক্লাস নিচ্ছি, গুগল ক্লাসরুমে রিডিং ম্যাটেরিয়ালসগুলো দিয়ে দিচ্ছি, ক্লাসের ভিডিও রেকর্ডিং দিয়ে দিচ্ছি। যারা পুরো সময় ক্লাস করতে পারছে না, তারা পরে সেটি দেখে নিতে পারছে। যাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে, তারা কিন্তু বারবার সেই ক্লাস রেকর্ডিং দেখে বিষয়টা বুঝে নিচ্ছে। ল্যাব আর পরীক্ষাগুলো আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা ধীরে ধীরে অনলাইন ক্লাসের সাথে মানিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের অনলাইন ক্লাস এবং পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে আমার মনে হয়েছে, হয়ত আমরা আরো কিছুটা সময় আগেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস নেয়া শুরু করতে পারতাম।   

সবশেষে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিনদের সঙ্গে ২৫ জুন, ২০২০-এ ভার্চুয়াল সভা করেন। সেখানে তিনি শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট সুবিধাসহ প্রযুক্তিগত অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা যাতে অনলাইন ক্লাসে আসতে পারে সে ব্যাপারে প্রতিটি বিভাগ/ইনস্টিটিউটকে সীমিত সামর্থ্য নিয়েই অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালু করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন। একই সাথে, কোনো শিক্ষার্থীই যেন ইন্টারনেট অ্যাকসেসসহ প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে না থাকে, সেজন্য পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।

লেখক পরিচিতি

ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version