ভারতের ইউজিসি ২০১৮ সাল থেকে ঠিক করেছে যে ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিঙে থাকা প্রথম ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। অর্থাৎ তারা এসএসসি বা এইচএসসির ফল, বিএস বা এমএস রেজাল্ট কিছুই দেখবে না।

শিক্ষক নিয়োগ: পিএইচডি নাকি মাস্টার্স?

কেন দেখবে? বিশ্ব র‍্যাঙকিঙে প্রথম ৫০০-তে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কি ঘোড়ার ঘাস খায়? তারা তো সবকিছু দেখেই আমাদের ছেলেমেয়েদের পিএইচডি করার সুযোগ দেয়। ওখানে ফুল ফান্ডিং নিয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়া কি যথেষ্ট যোগ্যতা নয়? আমাদের বরং বলা উচিত ৫০০ নয়, বিশ্ব র‍্যাংকিঙে থাকা প্রথম ৭০০টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি থাকলে তাকে সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু আমি কী দেখলাম? আমার অন্তত দুজন সহকর্মী আছেন, যাদের ওই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ বোর্ডের সামনে ভাইভা দিয়ে নিয়োগ পেলেন কিন্তু পদ দেওয়া হলো প্রভাষকের। যেখানে ভারত দেয় সরাসরি সহকারী অধ্যাপকের পদ, আমরা দিই প্রভাষক পদ। অথচ এখন থেকে কেবল মাস্টার্স করলেই আমরা তাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেই। এতে প্রমাণিত হয় আমরা যোগ্য প্রার্থীর যোগ্যতা মেপে সঠিক পদায়ন করতে পুরোপুরি ব্যর্থ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং ও পিএইচডি

এখন আসা যাক র‍্যাংকিং বিষয়ে। আমরা কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং বাড়ানোর কোনো চিন্তাভাবনা করছি? এই র‍্যাংকিং নিয়ে অনেককে বিরূপ মন্তব্য করতেও দেখেছি। অথচ আমি নিশ্চিত, কোনো কারণে যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং উপরে উঠে, তারাই তখন গর্ববোধ করে প্রচার করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং বাড়াতে হলে কিছু কাজ করতে হয়। প্রথম কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটকে আধুনিক করা। প্রথম পাতায় রাজনৈতিক অনুষ্ঠানাদি প্রচার না করে গবেষণা-সংক্রান্ত সংবাদে গুরুত্ব দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী-গবেষকের সংখ্যা বাড়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। এগুলো করলেই ক্যাম্পাসের পরিবেশ অন্যরকম হয়ে যাবে।

আমাদের ষোল কোটির বেশি মানুষ। সকল বাবা-মায়ের চাওয়া একটিই— সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করা। অর্থাৎ লেখাপড়া মানুষ হওয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের ছেলেমেয়েরা কি লেখাপড়া করে মানুষ হচ্ছে? মানুষ যে হচ্ছে না তা কি আমরা প্রতিদিন উপলব্ধি করছি না? মানুষ হলে এতো এতো বেকার থাকতো? সার্টিফিকেট পেলেই কি মানুষ হয়ে গেলো?

বাংলাদেশের কলেজে লেখাপড়া

বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি কলেজ এখন অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রি দিচ্ছে। অথচ এই কলেজগুলোর এসব ডিগ্রি দেওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতাও নেই। এরকম অযোগ্য প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট পেলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটি মেকি গর্ব জন্মে যায়। ফলে যদিও কার্যকরভাবে তারা ছোটখাট চাকুরির যোগ্য, কিন্তু বড় চাকুরির সার্টিফিকেট থাকায় ছোট চাকুরি করতে চায় না। এইভাবে দেশে এখন হতাশাগ্রস্ত বেকার অনেক।


আমাদের দ্রুত কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রির পথ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ এসব ডিগ্রি দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও সুযোগসুবিধা একদম নেই। বড়জোড় আমরা দুই বছরের বিএ, বিএসসি পাস কোর্স ডিগ্রি দিতে পারি। আর কলেজগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এইচএসসির ওপর। কারণ এই ডিগ্রির মানের ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেকাংশে নির্ভর করে। কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালু করে এইচএসসিকে দারুণভাবে অবহেলা করা হয়েছে।


তাদের কথা কি কেউ ভাবছে? উচ্চশিক্ষা তো সকলের জন্য না। একটি সুষম খাদ্যে যেমন ভিন্নরকমের অনেক ভিটামিন লাগে, তেমনি একটি ব্যালান্সড সমাজের জন্যও প্রয়োজন ভিন্ন প্রকৃতির নানা শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ। এর মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া উচিত।

এসব বিবেচনায় আমাদের দ্রুত কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রির পথ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কারণ এসব ডিগ্রি দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় শিক্ষক ও সুযোগসুবিধা একদম নেই। বড়জোড় আমরা দুই বছরের বিএ, বিএসসি পাস কোর্স ডিগ্রি দিতে পারি। আর কলেজগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে এইচএসসির ওপর। কারণ এই ডিগ্রির মানের ওপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অনেকাংশে নির্ভর করে। কলেজে অনার্স-মাস্টার্স চালু করে এইচএসসিকে দারুণভাবে অবহেলা করা হয়েছে।

মনে রাখতে হবে, ২০ থেকে ৩০ বছর বয়স হলো একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে সৃষ্টিশীল এবং শ্রেষ্ঠ সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেই বয়সের শিক্ষার্থীদের শিক্ষক। সাধারণভাবে এটি সত্য যে, শিক্ষক থেকে শিক্ষার্থীর মাঝে জ্ঞানের প্রবাহ নির্বিঘ্ন করার জন্য শিক্ষককে জ্ঞানে-মানে-সম্মানে উঁচুতে থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এটি আরও সত্য। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যাদের পড়ান তারা তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ে শিক্ষার্থী হয়ে এসেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহণযোগ্যতা

প্রশ্ন হলো, আমরা কি আমাদের গ্রহণযোগ্যতাকে সেই পর্যায়ে নিতে পেরেছি বা নিতে সতত চেষ্টা জারি রেখেছি? এই ঢাল তৈরি বা বজায় রাখার জন্য আমাদের যেরকমভাবে চলা উচিত, সেরকমভাবে কি আমরা চলছি? আমরা কি নৈতিকতার মানদণ্ডে সেই উঁচু অবস্থানে আছি? আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন অন্যায়ের শিকার হয় আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াই? রাজনীতির কারণে আমরা কখনো নীরব থাকি, আবার রাজনীতির কারণে আমরা কখনো অতি সরব হই। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে আমরা শিক্ষকরা পদ-পদবি নেই। এসব করেই শিক্ষকদের মান সমাজে আজ তলানিতে।


আমাদের শিক্ষার্থীরা যখন অন্যায়ের শিকার হয় আমরা কি তাদের পাশে দাঁড়াই? রাজনীতির কারণে আমরা কখনো নীরব থাকি, আবার রাজনীতির কারণে আমরা কখনো অতি সরব হই। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে আমরা শিক্ষকরা পদ-পদবি নেই। এসব করেই শিক্ষকদের মান সমাজে আজ তলানিতে।


আমাদের মতো দেশে যেখানে শাসকগোষ্ঠী প্রায়ই অন্যায়-অত্যাচার লুটপাট ইত্যাদিতে জড়িত থাকে, সেখানে শিক্ষার্থী-শিক্ষকই এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদের প্রধান ভূমিকা রাখার কথা। কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হলে তো কোনো দলের সদস্য বা কর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। শিক্ষিত এবং আলোকিত মানুষ হওয়ার প্রধানতম বৈশিষ্ট হলো সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে এবং প্রতিবাদী হবে।

প্রতিবাদী মানুষ রক্তের শ্বেতকণিকার মত। রক্তের শ্বেতকণিকা যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস কর্তৃক আক্রান্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে; ঠিক তেমনি প্রতিবাদী মানুষরা সমাজকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে। এইজন্যই সত্যজিৎ রায় তাঁর হীরক রাজার দেশে ছবিতে একজন শিক্ষককে সমাজ পরিবর্তনের কারিগরের চরিত্র দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনো গবেষণায় তেমন আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারেনি। যেটুকু সুনাম ও ঐতিহ্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেটি সেই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণেই হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা শুরুর দিকে কোন অন্যায় মেনে নেননি। আজ আমাদের সেই ঐতিহ্যও ভুলুন্ঠিত।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

কামরুল হাসান মামুন

কামরুল হাসান মামুন

ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছে।

মন্তব্য লিখুন