বাড়ি গৃহশিক্ষকতা প্রাইভেট টিউশনি ও বিদ্যালয় ব্যবস্থা

প্রাইভেট টিউশনি ও বিদ্যালয় ব্যবস্থা

বাংলাদেশের শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষা

প্রাইভেট টিউশনি নিয়ে সাম্প্রতিককালে নানা মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত অভিভাবকদের এ উদ্বেগ বেশি। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার খরচ অনেক অভিভাবকই বহন করতে সক্ষম নন; কিন্তু কষ্ট করে অভিভাবকদের এ খরচটুকু জোগাড় করতে হচ্ছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও এ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার প্রবণতা যেভাবে বেড়েছে, তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। অপরদিকে শিক্ষকরা বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে না পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোয় আগ্রহী বলেও কথা উঠেছে। ফলে কিছুদিন আগে একবার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে আইন প্রণয়নের কথা শোনা গিয়েছিল। সম্প্রতি অবশ্য এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না।

আমাদের দেশে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানোর প্রবণতাটি নতুন কিছু নয়। গ্রামাঞ্চল বা মফস্বল শহরে আগে বাড়িতে শিক্ষক রেখে বা শিক্ষকের বাড়িতে ব্যাচে পড়ানো হতো। যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখায় দুর্বল ছিল, যাদের পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার কিংবা এসএসসি বা এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ বা স্টার মার্কস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি ছিল, মূলত তাদের বিদ্যালয়ের পড়াশোনার বাইরেও আলাদা প্রাইভেট পড়তে হতো। অনেক সময় বিদ্যালয় থেকেই এ ধরনের আয়োজন করা হতো– বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক উদ্যোগী হয়ে ভালো ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাড়তি পড়ার ব্যবস্থা করতেন। অন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা প্রাইভেট পড়ত, তাদের অধিকাংশই ইংরেজি বা গণিত বা এরকম কোন ‘কঠিন’ বিষয়ে প্রাইভেট পড়ত। বর্তমান সময়ের চিত্র পুরোপুরি অন্যরকম। এখন এমন শিক্ষার্থীও রয়েছে, যাদের সব বিষয়ে প্রাইভেট পড়তে দেখা যায়। আগে যে বিষয়গুলোতে (বাংলা, সমাজ, ধর্ম ইত্যাদি) প্রাইভেট পড়ার কথা অনেকে ভাবতই না, শিক্ষার্থীরা এখন সেসব বিষয়েও প্রাইভেট পড়ছে। বলা বাহুল্য, এ প্রবণতা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে বেশি।

প্রাইভেট পড়ার এ প্রবণতা উচ্চমাধ্যমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় ছড়িয়ে প্রাথমিক পর্যায়েও হানা দিয়েছে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০০৫ সালে সারাদেশে প্রথম শ্রেণীর ২২.৩ ও পঞ্চম শ্রেণীর ৩৮.৪ শতাংশ শিক্ষার্থী অর্থের বিনিময়ে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছে। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের এবং গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার বেশি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রাইভেট পড়ার হার প্রতি বছর দুই শতাংশ করে বাড়ছে (সমীর রঞ্জন নাথ, ২০০৬)। এই চিত্র উদ্বেগজনক। ফলে প্রাইভেট টিউশনি পদ্ধতিটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।

প্রাইভেট পড়ার রীতি সব সময়ই ছিল; কিন্তু আগেকার দিনের প্রাইভেট পড়ার সঙ্গে এখনকার কিছু পার্থক্য রয়েছে। আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোতে ‘সহায়তা করা’ বা কোন কিছুর বিনিময় ছাড়াই শিক্ষার্থীদের ‘পড়া দেখিয়ে দেয়ার’ প্রবণতাটা বেশি ছিল। সেখানে বর্তমানে প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো পুরোপুরিই ব্যবসায়িক উদ্যোগ, অর্থের বিনিময়ে পড়া তৈরি করে দেয়াটাই এক্ষেত্রে মুখ্য। এমনও দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের বেতন, পরীক্ষা-ফি ও বই-খাতা-কলম ইত্যাদিতে মাসে যত খরচ করছে, তার চেয়েও বেশি খরচ করছে প্রাইভেট শিক্ষকের পেছন। প্রাইভেট পড়ার ফলে কিছু শিক্ষার্থী হয়তো ভালো ফলাফল করছে; কিন্তু এতে লেখাপড়ার সার্বিক মান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে; প্রশ্নের সম্মুখীন প্রচলিত স্কুল-সিস্টেমও।

প্রাইভেট পড়া বা পড়ানো খারাপ কিনা– অনেকে সে প্রশ্ন করেন। অনেকে প্রাইভেট টিউশনির পক্ষে, অধিকাংশই বিপক্ষে। যারা বিপক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, প্রাইভেট টিউশনি ক্ষতিকর। এতে প্রচুর অর্থ খরচ ও সময় নষ্ট হয়, প্রাইভেট পড়ার ফলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহী হয় না, শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে ইত্যাদি। যারা পক্ষে তাদের যুক্তি হচ্ছে, বিদ্যালয়ে যথাযথ পড়ালেখা হয় না বলেই শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতে হয়। তাছাড়া কোন অভিভাবক বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরে সন্তানকে আরও বেশি পড়াতে চাইতে পারেনই। যার সামর্থ্য আছে, তিনি চাইবেন তার সন্তান অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাক। শিক্ষা যেহেতু এখন ‘পণ্যে’র কাতারে এবং শিক্ষার খরচকে সময়ের ‘শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ’ বলে মনে করা হয়, সেখানে যার সামর্থ্য আছে তিনি তো সে সামর্থ্যরে প্রতিফলন ঘটাবেনই। বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেহেতু ‘ফ্রিডম অব চয়েজ’ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে একজন অভিভাবকের অধিকার রয়েছে বিদ্যালয়ের পড়ালেখার বাইরেও সন্তানকে ‘বেটার ট্রিটমেন্ট’ দেয়ার। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যাদের সামর্থ্য নেই তাদের কী হবে? আর এতে কি বিদ্যালয়-ব্যবস্থা আস্তে-আস্তে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে?

অভিভাবকরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করান পড়ালেখার জন্য, শেখার জন্য, ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে কতটুকু শিখছে আর প্রাইভেট পড়ে কতটুকু শিখছে? অনেক স্বনামধন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যতটুকু শেখে, তার চেয়েও বেশি শেখে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে– এমন অভিযোগও শোনা যায়। প্রাইভেট টিউশনির কারণে বিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্যই যদি ব্যাহত হয়, তাহলে এটা নিয়ে চিন্তার কারণ আছে বৈকি। বিদ্যালয়ের নিজস্ব পড়ালেখার বদলে যদি বিনিময়ের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের বাইরের পড়ালেখা মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে বিদ্যালয় ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়ে কেন– মোটা দাগে দুটো কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, বিদ্যালয়ে যতটুকু পড়ালেখা হওয়ার কথা ততটুকু হয় না; কিন্তু পরীক্ষা পাসের সিস্টেমটা অত্যধিক গুরুত্ব পাওয়া শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা প্রাইভেট পড়ার ওপর জোর দিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, সচ্ছল অভিভাবকরা চান তাদের ছেলেমেয়েরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে থাকুক। এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে তারা দ্বিধাবোধ করেন না। দুটো কারণের মধ্যে প্রথমটি বিশেষ গুরুত্ববহ। প্রাইভেট পড়ার সিস্টেমটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা উপজাত হিসেবে বেড়ে উঠেছে।

আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব ও কাজ নির্ধারণ করা হয়েছে কেন্দ্রীয়ভাবে রচিত শিক্ষাক্রম দ্বারা। শিক্ষাক্রম অনুসারে বিদ্যালয়ের একটি বড় কাজ হচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করা ও সে অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা। এজন্য নানা ধরনের শিক্ষা উপকরণ রয়েছে, রয়েছে অবকাঠামোগত ব্যবস্থা, শিক্ষক, নানা ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি ইত্যাদি। সব আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হল নির্দিষ্টকৃত শিক্ষাক্রম নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা। যেসব বিদ্যালয় এ কাজটুকু করতে সক্ষম, সেগুলোকে ভালো বিদ্যালয় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থী বা অভিভাবককে পাঠ্যক্রম সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অন্য উপায় নিয়ে ভাবতে হয় না। সমস্যাটা হয় তখনই যখন বিদ্যালয় তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন না করে শিক্ষার্থীকে প্রচলিত পদ্ধতিতে কঠোরভাবে মূল্যায়ন করে যায়। এই মূল্যায়ন আবার যেহেতু শিক্ষার্থীর ‘ক্যারিয়ার’-এর সঙ্গে যুক্ত, তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা স্বভাবতই বিদ্যালয়ের বাইরে গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। বিদ্যালয় যদি পড়ালেখার কাজটুকু বিদ্যালয়েই সম্পন্ন করে দেয়, তাহলে কি কেউ প্রাইভেটের প্রতি আগ্রহী হবে? শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় ইতিমধ্যেই জানে, তারা দ্বিতীয়বার সেসব বিষয় শিখতে চাইবে না। টেলিভিশনের যেসব সিরিয়াল বা অনুষ্ঠান তাদের দেখা, তারা স্বভাবতই সেগুলোতে আগ্রহী হবে না। সুতরাং সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত প্রাইভেট পড়ার কারণ বিদ্যালয়ের কাজ ঠিকমতো না হওয়াকেই নির্দেশ করে। বিদ্যালয় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে কোন বাড়তি প্রচেষ্টা ছাড়াই প্রাইভেট টিউশনি পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যেতে, অন্তত এর তীব্রতা কমতে বাধ্য। অভিভাবক যখন দেখবেন বিদ্যালয় থেকেই পড়ালেখার প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হচ্ছে, তখন সামর্থ্য থাকলেও সন্তানকে প্রাইভেট পড়াতে আগ্রহী হবেন না।

একবার শোনা গিয়েছিল, সরকার শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধে আইন তৈরি করবে। অনেকে মনে করেন, আইন করেই এটা বন্ধ করা উচিত। এক্ষেত্রে তারা বর্তমান সরকার কর্তৃক নোট বই নিষিদ্ধ করার উদাহরণ তুলে ধরে থাকেন। কিন্তু নোট বই নিষিদ্ধ হলেও এর পরিবর্তিত চেহারায় গাইড বই কি বাজারে নেই? আইন করে কি আদৌ প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করা যাবে? পড়ালেখার মতো কোন বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত উপাদান বা কার্যপ্রক্রিয়াকে জবরদস্তি বা আইন করে বন্ধ করা যায় না, করা উচিতও নয়। প্রাইভেট টিউশনির মূল কারণ খুঁজে বের না করে এটা বন্ধে যত কার্যক্রমই গ্রহণ করা হোক, নানা ফরমে এটা ঠিকই বহাল থাকবে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার কেন্দ্র হওয়া উচিত বিদ্যালয়, প্রাইভেট পড়া কখনোই নয়। প্রাইভেট টিউশনি কেন দ্রুত বিস্তার লাভ করছে, সেই কারণ বের না করে এবং সে অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা না নিয়ে যত পদক্ষেপই গ্রহণ করা হোক– তা আদতে বিশৃঙ্খলা বয়ে আনবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করা গেলে একে ঘিরে গড়ে ওঠা দুষ্ট উপজাতগুলো এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version