উচ্চশিক্ষা

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস : অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস বা বিইউপি ২০০৯ সালে ৩০তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য হলো সামরিক বাহিনীর উচ্চশিক্ষার সাথে সাথে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয় উচ্চশিক্ষা প্রদান করা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়টি মিরপুরে সেনানিবাসে নিজস্ব ক্যাম্পাসে বেসামরিক শিক্ষার্থীদেরও উচ্চ শিক্ষা প্রদান করে থাকে।

যেহেতু বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস প্রশাসন সামরিক বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত তাই অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এদের শিক্ষার গুণগত মান, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা। যার প্রতিফলন বর্তমান করোনা মহামারীতে প্রতিফলিত হচ্ছে। করোনা মহামারীতে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে তখনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে এবং সেমিস্টার সময়মতো শুরু হচ্ছে। প্রশ্ন হল, কীভাবে?

প্রথমেই বলা দরকার, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার মূলমন্ত্র হলো ‘শৃঙ্খলা’। প্রতিটি সেমিস্টার বার্ষিক শিক্ষা পরিকল্পনা দ্বারা সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। ফলে সেমিস্টার পরীক্ষার ফল প্রকাশ কখনোই বার্ষিক পরিকল্পনা ব্যত্যয় ঘটে না।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষাকার্যক্রমে সামরিক বাহিনীর মূলমন্ত্র শৃঙ্খলা প্রতিফলিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি শিক্ষক নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নির্বাচন সকল কার্যক্রমের প্রতিফলন একদিকে যেমন শিক্ষকগণ দেশের কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল পেয়েছে, অন্যদিকে অধিকাংশ শিক্ষকই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছেন। যে কারণে গুণগত দিক থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা বয়সের দিক দিয়ে নবীণ কিন্তু যোগ্যতা ও শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সুনিপুণ দক্ষ।

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা সামরিক বাহিনীর সদস্য কর্তৃক পরিচালিত হওয়ায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষা সহায়ক প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার তদারকি করে থাকে। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস মিরপুর সেনানিবাসে অবস্থিত হওয়ার কারণে এর ক্যাম্পাস আধুনিক স্থাপনা ও শ্রেণিকক্ষ আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত। একইসাথে এর রয়েছে ভার্চুয়াল ক্যাম্পাস যা Ucam নামে পরিচিত। বিইউপি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সাথে সাথে শিক্ষাসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম যেমন আউটলাইন, কোর্স সহায়ক ম্যাটেরিয়াল, পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ইত্যাদি কার্যক্রম অনলাইনে করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর সাথে ভালোভাবে জড়িত ও দক্ষ। সেহেতু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের প্রযুক্তিগত বাধা এ পরিস্থিতিতে কাজ করে নাই।

চতুর্থত, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনাল নতুন শিক্ষক নির্বাচনের পর শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ শুরু থেকে বাধ্যতামূলক রেখেছে। যেকোনো নতুন শিক্ষক এই পেশাগত প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারে না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নতুন শিক্ষকদের ছয় মাস দীর্ঘ Post Graduate Diploma in Higher Education Teaching নামে পেশাগত শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত আছে যা বাংলাদেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নাই। ছয় মাস দীর্ঘ ও ২৪ ক্রেডিটের কোর্সটিতে ICT In Higher Education নামে একটি পূর্ণাঙ্গ মডিউল রয়েছে। বিশ শতকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তথ্যপ্রযুক্তি-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা এই কোর্সের মাধ্যমে দেয়া হয়। সেজন্য প্রত্যেকটি শিক্ষক প্রযুক্তিগতভাবে বর্তমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এছাড়াও বিইউপি প্রশাসন কর্তৃক প্রযুক্তিগত তথ্য ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে।

পঞ্চমত, বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়ার মূল সফলকারী। তারাই মূলত এই প্রক্রিয়াকে সফল করতে সহায়তা করছে। আর এই সফল প্রক্রিয়ার যাবতীয় বাধাকে অতিক্রম করার মূল নেতৃত্বে আছে বিশ্ববিদ্যালয়টির মাননীয় ভিসি মেজর জেনারেল সারোয়ার হাকিম এবং তাঁর নেতৃত্বে সম্মানিত ডীন ও চেয়ারম্যানগণ। চলমান অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য তিনি মার্চ মাসের শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতে নেতৃত্ব দিয়েছে বিইউপির আইসিটি ইউনিট। বিইউপির যাবতীয় তথ্য ও প্রযুক্তিগত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে সজ্জিত করা আছে। এই ইউনিটের নেতৃত্ব দেন সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের একজন মেজর ও তার নেতৃত্বে এক ঝাঁক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।

করেনার শুরুর দিকে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার জন্য সাময়িক কিছু বাধা আসে। যেমন আর্থিক। একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস নতুন হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সীমিত সংখ্যক এ্যাকাডেমিক প্রোগ্রাম ও সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী সুযোগ পেয়েছে। তারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা এবং স্বাভাবিকভাবে প্রযুক্তি সরঞ্জাম সক্ষম। তারপরও যেসব শিক্ষার্থীদের এ-ধরনের কোনো সহযোগিতা দরকার, তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি কোনো শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ কেনার জন্য সাহায্য দরকার, সে ধরনের সাহায্য প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা আছে।

সর্বোপরি, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রম পরিচালনা করা কোনো সহজ বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়। সে সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। অনলাইন বা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে কিংবা অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমকে শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করা পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এরই অংশ হিসেবে Edex, Mooc, Owe-এর মত অনলাইন কোর্স পোর্টাল ইন্টারনেটের দুনিয়ায় খুব জনপ্রিয়।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা, অর্থ ও ব্যবস্থাপনার জন্য Blackboard এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো সে ধরনের কোনো ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি; যদিও ICT Education Master Plan গত এক দশক ধরে বাস্তবায়ন করে চলছে। UGC-এর অধীনে HEQEP প্রজেক্ট-এর অধীনে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান উন্নয়নে গত দশক ধরে কাজ করে চলেছে। সে তুলনায় বিইউপি নিজেদের চাহিদা অনুসারে ও দক্ষ নেতৃত্বের নিজেদের অর্থায়নে যে অসাধ্য সাধন করে চলছে তা বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অনুকরণীয় ও প্রশংসার দাবি রাখে।

আরেকটি বিতর্কের জায়গা হলো, এ-ধরনের অনলাইন কোর্স আমাদের গতানুগতিক শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রমের সাথে কতোটুকু বিজ্ঞানসম্মত। আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষাকার্যক্রম তাদের কারিকুলাম অনুযায়ী করে থাকে। সেখানে শিক্ষাকার্যক্রমের বিষয়বস্তু, শিখন পদ্ধতি মূল্যায়ন ও শ্রেণিকক্ষে প্রত্যক্ষ পাঠদানের কিছু নিয়মতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা আছে। অন্যদিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সরাসরি সংযোগের কারণে যেভাবে বা যে ধরনের শিখন হয়, তা অনলাইনভিত্তিক ভার্চুয়াল সংযোগের ফলে কী ধরনের বা কতোটুকু শিখন আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে হয় বা সম্ভব তা গবেষণাকৃত কোনো ফলাফল আমাদের কাছে নেই।

সর্বোপরি, একটি আপদকালীন সময়ে এবং শিক্ষার্থীর শহরে কিংবা গ্রামে পরিস্থিতির মধ্যে বিরাজ করছে তা কীভাবে বিবেচনা করতে হবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সবকিছু বিবেচনা করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা ও সর্বোপরি শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন যা আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন করে তুলছে। এই পরিস্থিতিতে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আমাদের থেমে থাকলে হবে না, শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

User Review
0 (0 votes)
কাজী শহীদুল্লাহ

এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।

Recent Posts

মানুষের দুর্নীতিবাজ হওয়ার পেছনে শিক্ষকের দায় কতটা?

দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান! বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের…

3 মাস ago

মুখস্থবিদ্যা কতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল…

4 মাস ago

নতুন শিক্ষাক্রম : জাপানের সাথে তুলনা কতোটুকু প্রাসঙ্গিক?

বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির…

4 মাস ago

কেন ক্লাস করতে চায় না শিক্ষার্থীরা

শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের…

6 মাস ago

শিক্ষকের মান ও গুণগত শিক্ষা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, "কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক…

6 মাস ago

বিদ্যালয়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক ব্যবস্থাপনা : প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ

মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে…

7 মাস ago