যোগাযোগ বৈকল্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন পরিচিত রোগ না হলেও উন্নত দেশগুলোতে যোগাযোগ বৈকল্য বা কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বহুল প্রচলিত একটি রোগ। যোগাযোগ্য বৈকল্য হচ্ছে এমন এক ব্যাধি যা মানুষের মনের ভাব বিনিময়ের ক্ষমতাকে বিনষ্ট করে।

যোগাযোগ বৈকল্য কী?

যোগাযোগ বৈকল্যের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি কথা শোনা, অনুধাবন, বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে তিনি অন্যদের সাথে মৌখিক, অ-মৌখিক, চিত্রের সাহায্যে বা যেকোনো ধরনের যোগাযোগে বাধাগ্রস্থতায় ভোগেন। এটি এমন এক ব্যাধি যখন একজন ব্যক্তি কারো কোনো কথা বা নির্দেশনা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন না। পাশাপাশি, নিজের মনের ভাবটিও অন্যের কাছে ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হন!

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ যোগাযোগ বা সংজ্ঞাপনের মাধ্যমেই তার আবেগ, সংবেদন, প্রয়োজন, বাসনা, ইচ্ছাকে মানুষের কাছে তুলে ধরে। কিন্তু প্রতিটি ভাষিক সমাজেই এমন কিছু মানুষ রয়েছে যাদের এ ধরনের যোগাযোগে রয়েছে নানা ধরনের অক্ষমতা, বিকার, ও বৈকল্য। ব্যক্তির কোনো চিন্তা কিংবা বাচনিক, অবাচনিক ও গ্রাফিক প্রতীক ব্যবস্থার বার্তা গ্রহণ, প্রেরণ, প্রক্রিয়াকরণ ও উপলব্ধি করতে না পারাই হলো যোগাযোগ বৈকল্য।

যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে সমস্যার সম্মুখীন হন। তার পক্ষে শব্দ বুঝতে এবং শব্দ উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়। মৌখিক যোগাযোগের সময় শব্দ নির্বাচন করতে, বাক্যের ক্রমধারা ঠিক রাখতে, কথা বলার সময় ব্যক্যের গঠন কী হবে এগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে তারা মানুষের সাথে কথা বলতে চান না বা কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে অন্যদের থেকে আড়াল করে রাখতে চান।

যোগাযোগ বৈকল্যের ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি সামজিকভাবে একাকি হয়ে পড়েন। মোটাদাগে কোনো ব্যক্তির মধ্যে যেসব যোগাযোগ বৈকল্য দেখা যায় তা হচ্ছে: ভাষিক বৈকল্য, বাচিক-শব্দ বৈকল্য, শ্রবণ বৈকল্য, উপলব্ধি বৈকল্য, তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সমস্যা, শৈশবে তোতলানো বৈকল্য, সামাজিক বৈকল্য ইত্যাদি। যোগাযোগ বৈকল্যের বিষয়টি দৃশ্যমান হয় ব্যক্তির শ্রবণ, ভাষার প্রযোগ কিংবা বাচিক দক্ষতার মাধ্যমে। যোগাযোগ বৈকল্যের মাত্রা অতিস্বল্পমাত্রা থেকে শুরু করে অত্যন্ত জটিলমাত্রার হতে পারে।


যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে সমস্যার সম্মুখীন হন। তার পক্ষে শব্দ বুঝতে এবং শব্দ উচ্চারণ করতে সমস্যা হয়।


যোগাযোগ্য বৈকল্য কীভাবে হয়?

ব্যক্তির মধ্যে যোগাযোগ বৈকল্য নতুন করে সৃষ্টি বা ব্যক্তির মধ্যে বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির ক্রোমোজোমে থাকা জিন যোগাযোগ বৈকল্যের বৈশিষ্ট্য বংশাণুক্রমে বহন করতে পারে। তাই পূর্বপুরুষের মধ্যে থাকা যোগাযোগ বৈকল্য আক্রান্ত হতে পারেন তার বংশের যে কেউ।

শিশুদের ক্ষেত্রে অটিজমজনিত কারণে, বয়সের সাথে বিকাশ না হওয়া বা দেরিতে হওয়া, বিকাশগত বিলম্বের কারণে শিশুর বাক-শ্রবণ সংশ্লিষ্ট অঙ্গের (যেমন: ভোকাল কর্ড, স্যাকুলাস, কণ্ঠঃনালী ইত্যাদি) পরিপূর্ণ বিকাশ না হওয়ার ফলে যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে বয়সজনিত কারণে শ্রবণক্ষমতার হ্রাস, স্মৃতিশক্তির হ্রাস, হঠাৎ বড় ধরনের মানসিক আঘাতের ফলে, স্নায়ু বৈকল্য ইত্যাদি কারণে যোগাযোগ বৈকল্য হতে পারে। তবে মস্তিষ্কে বড় ধরনের কোনো আঘাত, মস্তিষ্কের কোনো রোগের কারণেও যেকোনো বয়সের মানুষ যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত হতে পারেন।

যোগাযোগ বৈকল্যের লক্ষণসমূহ

যোগাযোগ বৈকল্যের ক্ষেত্রে বেশ কিছু লক্ষণ দেখা যায়। মোটামুটি এ ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকলে কোনো শিশু যোগাযোগ বৈকল্যে ভুগছে বলে প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা যায়। প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করা গেলে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।

১. যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত শিশু কারো সাথে কথা বলে না। কেউ তার সাথে কথা বলতে গেলেও সে কোনো কথার উত্তর দেয় না বা নিজের কোনো প্রয়োজনও ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করে না। সাধারত দেড় থেকে দুই বছর বয়সে শিশু কথা বলা শুরু করে। প্রথমে এক শব্দ, দু’শব্দ করে আস্তে আস্তে ‍পুর্ণাঙ্গ বাক্য ব্যবহার করে কথা বলে। যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত শিশু বয়স বৃদ্ধির পরেও সাধারণত কথা বলে না।

২. এ-ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর কথা বলতে বা শব্দ উচ্চারণে অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কথা বলার সময় শব্দ উচ্চারণে শিশুর কষ্ট হয়। কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেও দেখা যায় শব্দ অস্পষ্ট বা শব্দের উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ। সেজন্য অধিকাংশ সময়ই আক্রান্ত ব্যক্তির কথা শ্রোতা বুঝতে পারে না।

৩. একজন স্বাভাবিক মানুষ সাধারণত মিনিটে ১৪০ থেকে ১৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে কথা বলে। কিন্তু যারা স্বাভাবিক নয়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা মিনিটে অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে। অর্থাৎ, ধীরগতিতে কথা বলে যা শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর ও একঘেয়ে শোনায়।

৪. কিছু মানুষ কথা বলার সময় একই শব্দ বারবার বলে। তাদের অজ্ঞাতসারে তারা কথা বলার সময় একই শব্দ বারবার পুনরাবৃত্তি করে কথা বলে থাকে। এটি মুদ্রাদোষ নয়, বরং প্রতিবার কথা বলার সময়ই বিভিন্ন শব্দ বারবার উচ্চারণ করে। এটিকেও যোগাযোগ বৈকল্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

৫. যোগাযোগ বৈকল্য মানে শুধু কথা বলার সমস্যা নয়। কথা বলতে সমস্যা হওয়া বা কথা বলতে না পারা এই রোগের একটি অংশমাত্র। যোগাযোগ বৈকল্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্যের কথা শুনতে সমস্যা হয়। কথা শোনার সময় কান বাঁকিয়ে কথা শোনে, কথা শোনার সময় এক কানে হাত দিতে পারে, বক্তার মুখের সামনে কান রেখে কথা শোনার চেষ্টা করতে পারে।

৬. যোগাযোগ বৈকল্যের ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি কথা বলার সময় কথার ক্রম ঠিক রাখতে পারে না। কথা বলার সময় অংশ অংশ করে কথা বলে। সেক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিও শিশুদের মতো আধ-ভাঙ্গা করে কথা বলে এবং শিশুরা প্রথম কথা শেখার সময় যেমন বাক্যে শব্দের সঠিক ক্রম মেনে কথা বলতে পারে না, ঠিক সেভাবে কথা বলে।


একজন স্বাভাবিক মানুষ সাধারণত মিনিটে ১৪০ থেকে ১৬০টি শব্দ উচ্চারণ করে কথা বলে। কিন্তু যারা স্বাভাবিক নয়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা মিনিটে অনেক কম শব্দ ব্যবহার করে কথা বলে। অর্থাৎ, ধীরগতিতে কথা বলে যা শ্রোতার কাছে বিরক্তিকর ও একঘেয়ে শোনায়।


৭. যোগাযোগ বৈকল্যের সাথে কথা শোনা এবং অনুধাবনও জড়িত। তাই, আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো মানুষের সাথে কথা বলার সময় অনেক বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। শ্রোতার সম্পূর্ণ কথা আক্রান্ত ব্যক্তি শুনতে পারে না, উপলব্ধিও করতে পারে না। সেই সাথে নিজের মনের অনুভূতি প্রকাশ করতেও বাধার সম্মুখীন হয়।

৮. যোগাযোগ বৈকল্যের ক্ষেত্রে আরো একটি সমস্যা হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি লিখিত, মৌখিক, গ্রাফিক্যালসহ সব ধরনের নির্দেশনা বুঝতে সমস্যাবোধ করে। কোনো রকম সাহায্য ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে প্রায় হিমশিম খায়।

৯. যোগাযোগ‌ বৈকল্যের ক্ষেত্রে আক্রান্তদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা হলো, যোগাযোগ বৈকল্যে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মৌখিক যোগাযোগ অর্থাৎ কথা না বলে শারীরিক অঙ্গভঙ্গি বা ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যে মনের ভাব প্রকাশ করার চেষ্টা করে। বাক-প্রতিবন্ধীরা যেমন ইশারা ভাষার সাহায্যে তাদের সকল কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, একই বৈশিষ্ট্য যোগাযোগ বৈকল্যের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।

১০. বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র অথবা সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে তারা সাধারণত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। যোগাযোগ বৈকল্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটি। সাধারণত চোখে চোখ রেখে তারা কথা বলতে চায় না। নিজের চুল নিয়ে বা অন্য কিছু নিয়ে খেলার মাধ্যমে যেকোনো পরিস্থিতি থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে।

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

শামস আল গালিব

শামস আল গালিব

শামস আল গালিব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী।

মন্তব্য লিখুন