প্রাথমিক শিক্ষার সাথে যুক্ত থাকার কারণে শ্রেণিকক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার সুযোগ হয়। সেই সুবাদে দেখলাম যে পারদর্শিতার ভিত্তিতে একই শ্রেণিতে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থী বিদ্যমান। শিক্ষাক্রম এই বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের কীভাবে চিহ্নিত করছে?

প্রথম শ্রেণিতে কিছু শিক্ষার্থীকে দেখলাম, যারা ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত কথায় লিখতে পারে, আর গণনা করতে পারে এর চেয়ে বেশি। আবার কিছু শিক্ষার্থীকে দেখলাম ১ থেকে ১০ পর্যন্ত লিখতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, যারা বেশি গণনা করতে পারে তাদের বেশিরভাগই বাড়ি থেকেই শিখে এসেছে। আর যারা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত লিখতে সমর্থ তারা বিদ্যালয়ে শিখেছে।

এবার নজর দিলাম শিক্ষাক্রমের দিকে, সেখানে দেখলাম শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতায় প্রথম শ্রেণির যোগ্যতা দেওয়া আছে ১ থেকে ৫০ পর্যন্ত পড়তে পারবে, লিখতে পারবে, আর ১ থেকে ২০ পর্যন্ত কথায় লিখতে পারবে। এছাড়াও আরও বেশ কিছু যোগ্যতা আছে যা প্রথম শ্রেণিতে অর্জন করবে। যেমন, ১ থেকে ১৯ পর্যন্ত দুইটি সংখ্যার তুলনা, ক্রমান্বয়ে সাজানো, কিছু যোগ-বিয়োগ করা ইত্যাদি বিস্তারিত শিক্ষাক্রমে পাওয়া যাবে।

শিক্ষাক্রমে যোগ্যতা আর বাস্তবে যে যোগ্যতা শিক্ষার্থীরা অর্জন করে তা দেখে মনে কিছু ভাবনা উদয় হলো:

প্রথমত, একই ক্লাশে একদল শিক্ষার্থী আছে যারা প্রথম শ্রেণিতে পড়লেও দ্বিতীয় শ্রেণির যোগ্যতা অর্জন করেছে, আবার ওই শ্রেণিতে একদল শিক্ষার্থী আছে যারা প্রথম শ্রেণির নূণ্যতম যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। মাঝখানে একদল আছে যারা মাঝামাঝিতে আছে। এই তিনদল শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখার কথা, দলে ভাগ করে কাজ করার কথা, সেটা করার মতো ক্লাশ রুমে ভৌত অবকাঠামো, ক্লাসের পর্যাপ্ত সময়, ইত্যাদি আছে কি?


একজন শিক্ষক যখন নিত্যদিনের শ্রেণির কাজ করেন, তখন কোন দলকে লক্ষ্য করে কাজ দেন? বা কোন দলকে প্রাধান্য দেন? যদি অপারগ শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেয় তখন পারগ শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হয় কিনা?


দ্বিতীয়ত, যদি না থাকে, তাহলে একজন শিক্ষক যখন নিত্যদিনের শ্রেণির কাজ করেন, তখন কোন দলকে লক্ষ্য করে কাজ দেন? বা কোন দলকে প্রাধান্য দেন? যদি অপারগ শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেয় তখন পারগ শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হয় কিনা?

এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, সমাপনী পরীক্ষার আগে মডেল টেস্ট চলার সময়ে শিক্ষকগণের যখন পরীক্ষার ডিউটি থাকতো তখন সেই সুযোগে কয়েকটি ক্লাশ পরিচালনার করার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিশেষ করে প্রথম শ্রেণিতে যারা একেবারেই বর্ণ শিখতে পারেনি তাদের বর্ণ শেখাতে গিয়ে দেখতাম যারা ওই একই ক্লাশে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির রিডিং পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে তারা খুব বিরক্ত হতো, সেক্ষেত্রে ওদের চিহ্নিত করে আলাদা বসিয়ে গল্পের বই পড়তে দিতে হতো। না হলে ওরা ক্লাশে খুব বিরক্ত হতো।

তৃতীয়ত, সেক্ষেত্রে যাঁরা এই শ্রেণিগুলোতে পড়ান তাঁদের দায়িত্ব একটু বেশিই থাকবে। শিক্ষার ভিত্তি হলো প্রাথমিক শিক্ষা, আর প্রথম শ্রেণি হলো প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি। এই শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীরা মৌলিক কিছু শিখতে শুরু করে, যা তার জীবনের প্রথম শেখা।

এই স্তরে আপনি কয়েক দলের শিক্ষার্থী পাবেন। একদল বাড়ী থেকে প্রথম শ্রেণি শেষ করে আসে, আরেকদল পাবেন যারা মাঝামাঝিতে আছে, শেষ দলকে পাবেন যাদের জন্য আপনাকে কাঠখর পোড়াতে হবে। যারা মাথার ঘাম ছুটিয়ে ছাড়বে, আজ শেখাবেন কালই ভুলে যাবে। সেক্ষেত্রে এই শেষ দলকে শেখাতে গিয়ে আপনাকে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আপনি ক্লাস সাইজ, শিক্ষার্থী সংখ্যা, ক্লাসের সময় বিবেচনা করে দলে আলাদা আলাদা কাজ দিতে পারেন। পারগ-অপারগ পাশাপাশি বসিয়ে পড়াতে পারেন।

এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কে কোথায় বসবে তা আগে থেকে নির্ধারণ করে দিতে হবে- এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই দেখেছি শিক্ষার্থীরা ওদের মতো করে বসে। যারা অপারগ তার সব সময় পেছনে বসতে চেষ্টা করে। সেক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে কে কোথায় বসবে তা ঠিক করে দিতে হবে।

আমি জানি আপনি আপনার নিজস্ব কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে তিন দলকে একটা পর্যায়ে আনতে চেষ্টা করেন, শিক্ষক যারা আছেন তাদের হাত ধরেই আমরা আজ এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি, তারপরও কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময় করলাম মাত্র।

শিক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে শিক্ষাক্রম নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের বিষয়টা নিয়ে একটু ভাবার অনুরোধ থাকবে। আমরা অনেক এগিয়ে গিয়েছি। প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিবছর দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম নিয়মিত হালনাগাদ করার কোন উপায় করা যায় কিনা?


প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতিবছর দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্রম নিয়মিত হালনাগাদ করার কোন উপায় করা যায় কিনা?


পরিশেষে, কেন এমনটা হচ্ছে সেটাও দেখা দরকার। আমরা যারা সচেতন অভিভাবক আছি তারা কেন মনে করি, শিক্ষাক্রমে যা শেখানোর কথা তা যথেষ্ট না? যেমন, শিক্ষাক্রমে আছে গণিতে ১ থেকে ৫০ শিখবে প্রথম শ্রেণিতে, যা শিশুর ধারণ ক্ষমতার সাথে মিল রেখে করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে কেন আমরা আমাদের শিশুকে এই বয়সেই এর চেয়ে অতিরিক্ত শেখাচ্ছি? আবার সেদিন দেখলাম কোথাও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কারক সমাস শেখাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে আমরা আবার তাদের শৈশবকে মেরে ফেলছি না তো?

এটা যারা করাচ্ছেন তারা আসলে কোন শিক্ষাক্রম অনুসরণ করছে তাও দেখা দরকার। হয়ত এর মাধ্যমে জানতে পারবো— হয় আমাদের শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে, কিংবা যারা এত বাড়তি চাপ দিচ্ছেন তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে।

আশা করি আমরা এর একটা সুষ্ঠু সমাধান পাবো।

মুশফিকুর রহমান: লিটারেসি প্রোগ্রাম অফিসার, রুম টু রিড, কক্সবাজার।

লেখক সম্পর্কে

মুশফিকুর রহমান

মুশফিকুর রহমান

মুশফিকুর রহমান বেসরকারি সংস্থা রুম টু রিড-এ কক্সবাজারে লিটারেসি প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন