নিজ জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকুরি করছি। পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে ‘এডুকেশন স্পেশালিস্ট’ হয়েছি মাত্র! মাঝেমধ্যে মনে প্রশ্ন জাগে, যদি এমবিবিএস শেষ করে একজন ব্যক্তি ডাক্তার হতে পারেন, কৃষি বিষয়ে পাশ করে কৃষিবিদ হতে পারেন এবং প্রকৌশলবিদ্যা শেষে প্রকৌশলী হতে পারেন, তবে শিক্ষাবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স করার পর একজন কেন শিক্ষাবিদ বা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হতে পারছেন না? আমিই বা কেন শিক্ষাবিদ হতে পারছি না?
একটি গাণিতিক সমাধানকে তারা বিভিন্নভাবে সমাধান করে। আমি আনন্দিত হই, তবে ক্লাসের শিক্ষক সেগুলো কেটে দেন। ওরা আমাকে বলে, “বাবা, তুমি যে বললে আমার উত্তর ঠিক হয়েছে, তাহলে শিক্ষক কেটে দিলেন কেনো?”
এ-বিষয়টি নিশ্চিত করার দায় কার ওপর বর্তায়? আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, শিক্ষাবিজ্ঞানে লেখাপড়া শেষ করে ১৬ বছর যাবৎ শিক্ষা নিয়ে কাজ করেও আমি শিক্ষার ন্যূনতম কিছুই জানি না। আমার এই না-জানাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় প্রথমত আমার সন্তানেরা। তারা প্রায়শই নিজেদের পাঠ্যবই থেকে আমাকে নানাবিধ প্রশ্ন করে। আমি উত্তর দিতে অপারগ হলেই তারা হি হি করে হাসে আর বলে, “বাবা, তুমি না এডুকেশন স্পেশালিস্ট?”
একটি গাণিতিক সমাধানকে তারা বিভিন্নভাবে সমাধান করে। আমি আনন্দিত হই, তবে ক্লাসের শিক্ষক সেগুলো কেটে দেন। ওরা আমাকে বলে, “বাবা, তুমি যে বললে আমার উত্তর ঠিক হয়েছে, তাহলে শিক্ষক কেটে দিলেন কেনো?”
আমি চাইলেই পাঠ্যবই কিংবা শিক্ষকের ত্রুটির কথা সন্তানদেরকে বলতে পারি না। পারি না এটি বলতে যে, তোমরা যা শিখছো সেটি একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যার উত্তর যন্ত্রও দিতে পারে। আমাদের শিক্ষা যোগ্যতাভিত্তিক হলেও সেটির যথাযথ মূল্যায়ন ব্যবস্থার অভাবে মুখস্তনির্ভরই রয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, আমাকে আমার হিতাকাঙ্ক্ষীরা অভিযুক্ত করেন যে, একজন শিক্ষাবিদ হয়েও নিজের বাড়ির বিদ্যালয়টির উন্নয়ন ঘটাতে পারছি না কেনো? আমি বিব্রতবোধ করি। কী করে বোঝাবো তাদেরকে শিশু চায় না পড়ে ভালো ফলাফল করতে। অভিভাবক চায় নিজের সন্তানকে শ্রেষ্ঠ বানাতে। শিক্ষক চান না পড়িয়ে সকলকে সন্তুষ্ট রাখতে।
এছাড়াও পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট রক্ষা করতে দেখা যায়, বছরের শুরুতে শিশুদের হাতে বই, শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং দেশব্যাপি সকল শিশুর অভূতপূর্ব ফলাফল। অতএব, সকলের প্রত্যাশা যে পূরণ হচ্ছে তাতো দৃশ্যমান।
যে শিশুরা দারিদ্র্যের কারণে বাড়তি গৃহশিক্ষক না পেয়ে অকৃতকার্য হয়ে ঝরে পড়ল, তার অভিভাবক তো নিজ সন্তানের অকৃতকার্যতার কারণ হিসেবে নিজ দারিদ্র্যকেই দায়ী করে চলেছেন। দারিদ্র্য সে সকল অভিভাবককে মূক করে দিয়েছে।
আমি চাইলেই পাঠ্যবই কিংবা শিক্ষকের ত্রুটির কথা সন্তানদেরকে বলতে পারি না। পারি না এটি বলতে যে, তোমরা যা শিখছো সেটি একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স যার উত্তর যন্ত্রও দিতে পারে।
তৃতীয়ত, নিজ কিংবা সরকারি অফিসের যেকোনো সভায় শিক্ষাবিষয়ে কথা উঠলেই দেখি শিক্ষার যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ অন্যরাই ভালো কষেন! এমন অনেক অপেশাদার ক্ষেত্র রয়েছে যেখান থেকে প্রতিনিয়তই ফিডব্যাক আসে যে, আমরা কিছুই করতে পারছি না। এটি আমাকে ভাবিয়ে তুলে, “আমি কি আসলেই শিক্ষার কিছু বুঝি?” যদি তারাই ভালো বোঝেন তাহলে শিক্ষাবিদের প্রয়োজন আছে কি?
শারীরিক সমস্যাকে সাড়িয়ে দেয়ার জন্য দরকার চিকিৎসক। আর শিক্ষার সমস্যাকে সাড়িয়ে দেয়ার জন্য দরকার শিক্ষাবিদ। চিকিৎসক ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি, চিকিৎসা উপকরণ নিজ হাতে তৈরি করেন না। এর জন্য বিশেষায়িত লোকবল রয়েছে। চিকিৎসকের কাজ হচ্ছে রোগের ধরন, কারণ ও উৎস চিহ্নিত করে চিকিৎসা প্রদান। আর চিকিৎসকের দক্ষতা যতোই থাকুক, রোগী যদি তাঁর পরামর্শ মেনে না চলেন; তবে রোগ ভালো না হওয়ার জন্য চিকিৎসককে দায়ী করা যায় কি?
তেমনি একজন শিক্ষাবিদও শিক্ষার সমস্যা চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমাধান দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে উভয়ই যদি দল, মত, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিতে পরিণত হতে না পারেন, তবে জাতির জন্য উভয়েই হয়ে ওঠেন এ্যাটম বোমা অর্থাৎ সভ্যতা ধ্বংসের প্রকাণ্ড হাতিয়ার।
একজন শিক্ষাবিদের দায়িত্ব বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন আনয়ন যার মাধ্যমে অধিক সংখ্যক শিশুকে সহজতর উপায়ে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করানো যায়। সময়ের সাথে সাথে শিক্ষার কন্টেন্ট, শিশুর শিখন প্রক্রিয়া, কার্যকর শিখন উপকরণ এবং শিক্ষকের শিক্ষণ-শিখন কৌশল ইত্যাদির পরিবর্তন সাধন করাই শিক্ষাবিদের কাজ।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, শিক্ষা সর্বদাই মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাবে। একজন শিক্ষাবিদ যেন তার সকল সৃষ্টিতে মানবিক গুণাবলীর বিষয়টি খেয়াল রাখেন, অর্থাৎ যেকোনো পরিস্থিতিতে এ-ব্যাপারে কোনো আপোষ না করেন। কালের পরিক্রমায়, স্রোতের অনুকূলে গা ভাসাতে ভাসাতে যিনি চলেন, তিনি খড়কুটো ছাড়া বেশি কিছু তো নন।
একসময় এ-দেশের শিক্ষার একটি স্ট্র্যাটেজিক উদ্দেশ্য ছিলো ‘ক্রিটিক্যাল বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন’ মানুষ তৈরি। এখনো পৃথিবীতে ক্রিটিক্যাল মানুষদের মূল্য সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘কূটনৈতিক’, ‘রাজনৈতিক’ ‘অর্থনৈতিক’ ইত্যাদি যাদের অবস্থান উদারনৈতিকতার অনেক উপরে। যারা একদা মানুষকে ক্রিটিক্যাল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এখন চাইলেও তাদেরকে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষে পরিণত করা যাবে না। যদি সরল, মানবীয় এবং যোগ্য মানুষ তৈরি করতে চাই, তাহলে আজ শুরু করলে ২০৭৫ সাল নাগাদ তেমন একটি জাতি আমরা পেতে পারি।
শিক্ষার্থীকে স্বনির্ভর শিক্ষার্থী হিসেবে তৈরি করা খুবই জরুরি। এটি শিশুকে হাঁটতে শেখানোর মতো। শিশু দৌড়াতে কিংবা লম্ফঝম্ফ যাতে নিজেই করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। আর শিশুকে স্বনির্ভর শিক্ষার্থী হিসেবে গড়তে পারলে শিক্ষাদানে শিক্ষকসহ সকল পর্যায়ের পরিশ্রম অনেক কমে আসবে।
প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিহিংসা, প্রতিপত্তি, প্রতিলিপি এই শব্দসমূহ পৃথিবীর পরিবর্তনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে সত্যি, তবে অনেক ধ্বংসও এনেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি সাধিত হয়েছে, এগুলো মানুষের মানবিক গুণাবলী নষ্ট করেছে।
দেশের সকল স্থানে একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা হতে হবে প্রতিযোগিতাশূন্য, যার উদ্দেশ্য হবে শুধুই সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতো এসবেরও দুষ্টচক্র রয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞান বলে, “মানুষ যদি তার একটি অপরাধ ধামাচাপা দিয়ে পার পেতে পারে, তাহলে সে অগণিত অপরাধ সংঘটিত করার শক্তি অর্জন করে।” এগুলো আমরা সরল চোখে দেখতে পাই না। তবে, যখন কোনো সামাজিক চর্চা নিজ জীবনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে, তখনই কেবল উপলব্ধিতে আসে যে, ‘এ সঠিক নয়’।
সুতরাং, অপরাধের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসার মাধ্যমে জীবনকে সত্য ও সুন্দরের মাঝে পরিচালিত করার জন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
প্রথমত, এ-দেশে শিক্ষা হতে হবে সকল প্রকার দ্বান্দ্বিকতা ও অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিবর্জিত। একই ধারার এবং দেশের সকল স্থানে একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় মূল্যায়ন ব্যবস্থা হতে হবে প্রতিযোগিতাশূন্য, যার উদ্দেশ্য হবে শুধুই সঠিক শিক্ষা নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে কোন কোন বিষয় শিশুর মনস্তত্বে বিরূপ প্রভাব ফেলে। সেগুলো অনতিবিলম্বে বাদ দিতে হবে। শিশুর বিনোদনের জন্য সুপারম্যান, ব্যাটম্যান চরিত্রগুলো বাদ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, বিশেষ কোনো বিষয় বা কোনো পেশাকে বড় বা ছোট করে না দেখে সকল কাজের প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব সৃষ্টি করতে হবে। অতএব, শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে যারা লেখাপড়া করছেন তাদেরকে আরও বেশি যোগ্য করার জন্য বর্তমান শিক্ষাক্রমটিকেও ঢেলে সাজাতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই অনুশীলন বিষয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
সর্বোপরি, নিজস্ব কৃষ্টি-কালচার ধারণ, লালন ও অনুশীলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে আমরা বিশ্ব দৌড়ে অংশ নেব অবশ্যই, তবে অপ-সংস্কৃতিতে দ্রবীভূত হবো না। আমার দেশ আমার অহংকার, আমরা মনের মতো করে এ দেশকে গড়ে তুলবো। সঠিক ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতিই হবে দেশ গড়ার প্রধান হাতিয়ার।
শিক্ষাবিদ হতে পেরেছি কিনা বা পারবো কিনা জানি না, হয়তো সময়ই এর উত্তর দেবে। কিন্তু, শিক্ষাবিজ্ঞানের একজন আজীবন শিক্ষার্থী হিসেবে মনে করি পেশাগত ও অ্যাকাডেমিক বিষয়গুলোর সিদ্ধান্তের ভার পেশাবিদ ও দক্ষ শিক্ষাবিদদের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। এতে হয়তো পরিবর্তন একটু দ্রুত আসবে।
লেখক পরিচিতি
মো: সাইদুল হক বাংলাদেশে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় শিক্ষাবিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।