শিক্ষা ও শিক্ষার সঙ্কট নিয়ে কয়েকটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করা যায়।
The mind is not a vessel to be filled, but a fire to be kindled.
Plutarch (46-120), On Listening to Lectures
Education is not preparation for life; education is life itself.
John Dewey (1859-1952)
The greatest sign of success for a teacher… is to be able to say,
‘The children are now working as if I did not exist’.
Maria Montessori (1870-1952)
আমরা এমন একটা সময়ে এসে উপনীত হয়েছি, যেখানে একদিকে যেমন অর্জনের প্রাচুর্য, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে সঙ্কটের বাড়াবাড়ি। আর সব সঙ্কটের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার সঙ্কট : শিক্ষায় যদি সঙ্কট থাকে তাহলে সব চেষ্টা করেও অন্যসব দিকের সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে না। কেননা ‘উন্নয়ন’ বা ‘প্রবৃদ্ধি’ কিংবা ‘অগ্রসরতা’ কেবল কতিপয় ধারণামাত্র; এর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে শিক্ষাই মূল মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখে।
আলোচ্য বিষয়সমূহ
ছেলে-মেয়েরা শুধু পরীক্ষা পাস করছে, কিছু শিখছে না; ওদের পড়ালেখায় আগ্রহ নেই; শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত নয়; শিক্ষার নামে ব্যবসা হচ্ছে; শিক্ষার্থী-পরীক্ষার্থী দ্বন্দ্ব; প্রশ্ন ফাঁস; দেশে প্রচলিত অ্যাকাডেমিক বিষয় ও পাঠ্যসূচির সাথে চাকরির বাজারের সাযুজ্য নেই… এমন হাজারো সমস্যার কথা প্রতিনিয়ত বলা হচ্ছে। আরো চিন্তার বিষয় হলো, শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর মানসিক দূরত্ব বাড়ছে এমনকি তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত তৈরি হচ্ছে। এমন দ্বন্দ্বের কারণে সম্প্রতি একাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর গণমাধ্যমে বেরিয়েছে। এমন ঘটনা অতীতেও ঘটেছে, হয়তো ভবিষ্যতেও ঘটবে। কেবল বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ প্রবণতা রীতিমতো আতঙ্কজনক; তথাকথিত উন্নত দেশগুলোতেও এমন ঘটনা একেবারে বিরল নয়।
কিন্তু এসব সমস্যার মূলে কেউ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে না; সব সঙ্কটের মূল কারণ হলো, শিক্ষার যে দর্শন, তা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি।
কয়েক হাজার বছর ধরেই শিক্ষার দর্শনকে নানাভাবে ভাবা হয়েছে; কতকগুলো উদ্দেশ্য সমন্বিতভাবে শিক্ষার দর্শনকে প্রতিভাত করে। এসবের মধ্যে একটি উদ্দেশ্য হলো : উৎকর্ষ অর্জন অর্থাৎ নিজের পরিপূর্ণ বিকাশ। একজন বিদ্যার্থীর বা শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্ভাবনার যে বীজ অন্তর্নিহিত রয়েছে, সুপ্ত রয়েছে, শিক্ষার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়ে ফুলে-ফলে শোভিত একটি বৃক্ষে পরিণত হবে – শিক্ষা দান ও গ্রহণের একটি উদ্দেশ্য হবে এটি। প্রাচীন গ্রন্থ উপনিষদে শিক্ষার তিনটি উদ্দেশ্যের কথা বলা হয়েছে : এক. শিক্ষার্থীকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা; দুই. অসত্য থেকে সত্যে নিয়ে আসা; এবং তিন. মৃত্যু থেকে অনন্ত জীবনে নিয়ে আসা। অর্থাৎ শিক্ষা আমরা তাকেই বলবো যা একজন শিক্ষার্থীর মনকে কলুষমুক্ত করবে – তার মধ্যে মুক্তবুদ্ধি ও উদারতার প্রসার ঘটাবে; যা তাকে সত্যনিষ্ঠ করবে, তার মধ্যে ভালো-মন্দের পার্থক্য করার মতো বোধ তৈরি করবে এবং যা শিক্ষার্থীকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অর্জনে সহায়তা করবে, যার মাধ্যমে সে মানুষের কল্যাণ করবে।
শিক্ষার্থী কে? বা, একজন শিক্ষার্থীর বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? প্রাচীন শাস্ত্রে সংস্কৃত এক শ্লোকে এর উত্তর দেয়া হয়েছে : ‘কাকচেষ্টা, বকধ্যানম, শননিদ্রা তথৈবচ/অল্পাহারী, গৃহত্যাগী, বিদ্যার্থী পঞ্চলক্ষণম’। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্য থাকবে : এক. কাকচেষ্টা: একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে কাকের মতো অনবরত ‘চেষ্টা’ করে যাওয়ার দৃঢ়তা থাকতে হবে; অর্থাৎ তাকে ধৈর্য্যশীল ও কঠোর পরিশ্রমী হতে হবে। ধৈর্য্য ও চেষ্টা ছাড়া একজন শিক্ষার্থীর জ্ঞানলাভ হয় না, সে তার মধ্যে সুপ্ত অনন্ত সম্ভাবনার বিকাশ ঘটাতে পারে না। এক্ষেত্রে কেবল বুদ্ধি ও ধৈর্য্যরে ফলে কলসির তলানি থেকে পানি পানে কাকের সফলতার গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে। দুই. বকধ্যান: একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে বকের মতো ধ্যান তথা অধ্যবসায়ের গুণ থাকতে হবে। বকের কথা এখানে এজন্যে বলা হয়েছে, বক যখন মাছ শিকার করে, তখন সে এক পা গুটিয়ে নিয়ে অন্য পায়ে ভর রেখে পানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে অপলক তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে সে কোনো ধরনের নড়া-চড়া থেকে বিরত থাকে। এর ফলে পানি স্থির হয়ে আসে এবং পানির নিচের সবকিছু দৃশ্যমান হয়। এরপরও সে অপেক্ষা করে, একেবারে ক্ষুদ্রাকৃতির মাছগুলোকে সে চলে যেতে দেয়; যা দিয়ে তার পেট ভরবে না সেদিকে সে অযথা মনোযোগ দেয় না বা সময় ব্যয় করে না। এর ফলে একসময় অপেক্ষাকৃত বড় মাছগুলো – যা তার দরকার – সেগুলো তার কাছে ধরা পড়ে। এর মধ্য দিয়ে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তা হলো : জীবনে ছোট-বড় অনেক ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকবে, ভালো-মন্দ অনেককিছুই থাকবে; এর মধ্য থেকে ঠিক বিষয়টির ওপর ফোকাস করতে হবে – অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে সময় নষ্ট করা যাবে না। বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অপ্রয়োজনীয় বিষয় আঁকড়ে ধরে থাকলে বড় লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। তিন. শননিদ্রা: এর অর্থ হলো ‘কুকুরের মতো ঘুম’ – তবে এখানে ঘুম নয় বরং এর উল্টোটা অর্থাৎ সতর্কতার কথা বোঝানো হয়েছে। কুকুর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে থাকলেও তার কান সতর্ক বা সজাগ থাকে যে কারণে তার পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেই সে তা বুঝতে পেরে জেগে ওঠে; এখানে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। একজন শিক্ষার্থী সবসময় নিজের ও তার পরিবেশ-প্রতিবেশের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীর চোখ বা মন বইয়ে বা কেবল তার পড়ার বিষয়ে নিবদ্ধ থাকলেও, এর পাশাপাশি তার চারপাশের ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনা থেকেও যে শেখার আছে অনেককিছু, সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। চার. অল্পাহার: শিক্ষার্থীকে হতে হবে অল্পাহারী। এখানে অবশ্য কেবল মুখ বা জিভের খাবারের কথা বলা হয়নি; মানুষের প্রতিটি ইন্দ্রিয়েরই ‘খাবার’ রয়েছে : চোখের খাবার হলো দৃশ্য, কানের খাবার শব্দ, নাকের খাবার গন্ধ, ত্বকের খাবার স্পর্শ ও জিভের খাবার স্বাদ বা স্বাদযুক্ত বস্তু। এখানে প্রতিটি ইন্দ্রিয় ব্যবহারের ক্ষেত্রেই পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে বলা হয়েছে। যতোটুকু প্রয়োজন, কেবল ততোটুকুই গ্রহণ করতে হবে; না হলে অপ্রয়োজনীয় তথ্যে শিক্ষার্থীর মস্তিষ্ক কেবল ভারাক্রান্ত হবে, তাকে ঠিক ‘জ্ঞানলাভ’ হচ্ছে বলা যাবে না। পাঁচ. গৃহত্যাগ: এর আক্ষরিক অর্থ হলো ঘর ছেড়ে বেরোনো। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, বিদ্যালাভের প্রয়োজনে শিক্ষার্থীকে ঘর ছেড়ে বেরোতে হবে। ঘর হচ্ছে একজন মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়, নিশ্চিন্ত জায়গা, আরামের জায়গা; এখানে মূলত সেই ‘আরাম’টুকুই ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। নিজের ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে না বোরোলে জ্ঞানলাভ হয় না। সেজন্যেই বলা হয়, ‘কষ্ট ছাড়া কেষ্ট মেলে না’!
এখনকার শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের চেষ্টা বা তাদের মধ্যে এগুলো উৎসাহিত করার চেষ্টা কতোটুকু রয়েছে?
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, মানবজীবনের সমগ্র আদর্শকে জ্ঞানে ও কর্মে পূর্ণ করে উপলব্ধি করাই শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাঁর মতে, মানবকল্যাণই হলো শিক্ষার্থীদের ব্রত ও উদ্দেশ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রাচীন ভারতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে ও প্রকৃতির সহযোগ ঘটিয়ে শিক্ষা দান ও অর্জনের যে চল ছিলো, সেটিই আদর্শ পদ্ধতি। তিনি মনে করতেন, অতীতের সেই শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্প্রবর্তন দরকার। তাঁর মতে, মানুষ বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবসংসার – এই দুইয়ের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, অতএব এ দুইকে একত্র করে শিক্ষায়তন গড়লে তবেই শিক্ষার পূর্ণতা ও মানবজীবনের সমগ্রতা লাভ হয়। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, বিশ্বপ্রকৃতির যে আহ্বান, তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে জোর করে শিক্ষার আয়োজন করলে শুধু শিক্ষাবস্তুকেই জমানো হয়; যে মন তাকে গ্রহণ করবে তার অবস্থা হয় ভারবাহি জন্তুর মতো; শিক্ষার উদ্দেশ্য তাতে ব্যর্থ হয়। সেজন্যে রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার যে দর্শনে বিশ্বাস করতেন, শান্তিনিকেতনকে তিনি সেই আদলে গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিলো, শিক্ষাচর্চা হবে সমস্ত রকমের সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। তিনি সবসময়ই চেয়েছেন, শিক্ষাব্যবস্থা এমন হবে যা হবে সর্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চার কেন্দ্র; তিনি চাইতেন, স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতের জন্য যে বিশ্বজাতিক মহামিলনযজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, তাঁর প্রথম আয়োজন হবে শান্তিনিকেতনে।
রবীন্দ্রনাথ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন, শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। এ ব্যাপারে তাঁর ভাষ্য ছিলো, ইংরেজি ভালো করে শিখতেই হবে, তবে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে সব জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখাতে হবে।
সেই কতো বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ একদিকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত একটি একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে স্থানিক সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি তাতে একটি আধুনিক বৈশ্বিক যোগ স্থাপনের বিষয়টিও ভেবেছিলেন!
রবীন্দ্রনাথ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতেন, শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা। এ ব্যাপারে তাঁর ভাষ্য ছিলো, ইংরেজি ভালো করে শিখতেই হবে, তবে বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে সব জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখাতে হবে। তাঁর ভাষ্যে অনুপ্রাণিত ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার মাইকেল স্যাডলার (যিনি একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের সঙ্গেও কাজ করেছিলেন) নিজেও সেই কমিশনের রিপোর্টে বলেছিলেন, এত আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কথা বলে গেছেন তা সারা বিশ্বেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষার জন্য উপযুক্ত আদর্শ হয়ে উঠতে পারতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার্থীদের ধনের গর্বে স্ফীত না হতে এবং মিথ্যাকে বাদ দিয়ে সত্যকে জানবার উপদেশ দিতেন। তাদের তিনি এমনভাবে গড়ে ওঠার পরামর্শ দিতেন যে তারা যেখানেই থাকবে সেখানেই মানুষের মঙ্গল হবে, তাদের মাধ্যমে সকলের ভালো হবে। রবীন্দ্রনাথের মতে, সকলের ভালো করার এই আকাক্সক্ষাই হলো শিক্ষার মহান ব্রত, আর এই ব্রতকেই মুক্তির উপায় বলে বিশ্বাস করে এর উপযুক্ত একটি শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলতেন তিনি।
আজকের যুগে এই মহৎপ্রাণ চিন্তক শিক্ষকদের সঙ্কট রয়েছে; কেবল পরীক্ষা পাস আর চাকুরির চিন্তা কেবল শিক্ষার্থী নয় – এখন শিক্ষকদেরও যেন তাড়িয়ে বেড়ায়! কীভাবে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠা যায়, এ নিয়ে ভাবনা শিক্ষার্থীর মনে জাগ্রত করবেন শিক্ষক; কিন্তু অবস্থার চাপে একজন শিক্ষক কেবল তার ছাত্র কিংবা ছাত্রীটিকে পাস করিয়ে একটা চাকরি যোগাড়ের উপযুক্ত করে তোলাকেই উভয়ের মূল দায়িত্ব ভেবে নিয়েছেন এবং এতেই যেন জগতের সব কল্যাণ নিহিত রয়েছে!
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, শিক্ষাগ্রহণ হলো এক ধরনের ধর্ম; এ ধর্মে ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্ক হবে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক। তিনি বলতেন, শিক্ষা কখনো পণ্য রূপে বিক্রি হতে পারে না – এতে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ব্যাহত হয়। তিনি আরো বলতেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপকেরা তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করবেন; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিক এবং অধ্যাপকদের মধ্যে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক থাকবে না বরং উভয়েই একে অন্যের সহযোগী হয়ে কাজ করবেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ব্যপারেও তিনি বলতেন, তাঁদের তিনি তাঁর অধীন বলে মনে করেন না বরং এই শিক্ষকদের কাছে তিনি প্রত্যাশা করতেন যে তাঁরা স্বাধীন শুভবুদ্ধির দ্বারা স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করে যাবেন।
‘আধুনিক ও উন্নত’ সময়ে এসে আমরা এর ঠিক বিপরীত চিত্রটিই দেখছি যেখানে (বিশেষ করে বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘মালিকেরা’ শিক্ষকদের কেবল ‘বেতনভুক্ত কর্মচারি’ ভাবতেই পছন্দ করে এবং শিক্ষকরাও নিজেদেরকে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক না ভেবে শিক্ষার্থীদের কেবল ‘কর্পোরেট দাস’ হিসেবে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাকেই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং অনেকটাই ‘নিয়তি’ বলে মেনে নিয়েছেন।
কিন্তু ‘আধুনিক ও উন্নত’ সময়ে এসে আমরা এর ঠিক বিপরীত চিত্রটিই দেখছি যেখানে (বিশেষ করে বেসরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘মালিকেরা’ শিক্ষকদের কেবল ‘বেতনভুক্ত কর্মচারি’ ভাবতেই পছন্দ করে এবং শিক্ষকরাও নিজেদেরকে স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক না ভেবে শিক্ষার্থীদের কেবল ‘কর্পোরেট দাস’ হিসেবে উপযুক্ত করে গড়ে তোলাকেই নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং অনেকটাই ‘নিয়তি’ বলে মেনে নিয়েছেন।
শিক্ষার দর্শন প্রসঙ্গে দার্শনিক জাঁ-জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮)-এর ভাবনাও রবীন্দ্রনাথের মতোই; রুশোও মনে করতেন, মানুষের মৌলিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জীবন-ধারণের উপযুক্ততা অর্জন করা, ‘মানুষ’ হয়ে উঠা। এজন্যে তিনিও শৈশব থেকেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে সমর্থন করেছেন; তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির শৃঙ্খলা মানবজীবনের বা মানুষের অস্তিত্বের প্রতিটি বিষয়কে স্পর্শ করে, প্রভাবিত করে এবং প্রকৃতির সান্নিধ্য ব্যক্তিকে তার অন্তর্নিহিত সত্ত্বার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে, তার প্রতিবেশের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে এবং অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে সহায়তা করে।
দার্শনিক সক্রেটিস (খ্রি. পূ. ৪৭০/৪৬৯-৩৯৯) মনে করতেন, প্রশ্ন করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ভেতরের সুপ্ত ভাবনাকে জাগ্রত করতে হবে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো সত্যের আবিষ্কার এবং কেবল ‘দ্বান্দ্বিকতা’র মাধ্যমেই এ সত্যের উন্মোচন সম্ভব।
দার্শনিক প্লেটো (খ্রি. পূ. ৪২৭-৩৪৭) মনে করতেন, শৈশব থেকেই ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞান, দক্ষতা, শৃঙ্খলার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে রাষ্ট্রের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা দরকার এবং তা হতে হবে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে। সঙ্গীত ও শিল্পের প্রশিক্ষণকে তিনি সার্বিক ও সমন্বিত (হোলিস্টিক) শিক্ষণ প্রক্রিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি শরীর ও আত্মাকে আলাদা বিবেচনা করে এ দুয়ের সমন্বয়ে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন।
অ্যারিস্টটল (খ্রি. পূ. ৩৮৪-৩২২) তাঁর বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ করেছেন, শিক্ষার মাধ্যমে স্বাভাবিক জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি মানুষের মানবিক বৈশিষ্ট্য বা চরিত্র, অভ্যাস ও যুক্তির বিকাশ ঘটানোও দরকার। শিক্ষার এই প্রক্রিয়া কেমন হবে, এ বিষয়ে অবশ্য তাঁর ভাবনা সক্রেটিসের ভাবনার একেবারেই বিপরীত; অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার্থীকে শেখানোর দায়িত্ব মূলত একজন শিক্ষকের; শিক্ষক পদ্ধতিগত উপায়ে শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলবেন। অ্যারিস্টটল শিক্ষার অংশ হিসেবে তাত্ত্বিক চর্চার পাশাপাশি প্রায়োগিক দিকটিকেও গুরুত্ব দিয়ে এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। পুরো শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মধ্যে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে পড়া-লেখা ও গণিত, সঙ্গীত, শারীরিক শিক্ষা, সাহিত্য ও ইতিহাস, এবং বিজ্ঞানের নানা দিক Ñ এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি তিনি ক্রীড়াকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে প্লেটোর মতোই অ্যারিস্টটলও বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্যই হলো এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্যে উপযুক্ত ও নীতিবান নাগরিক তৈরি করা। এমন শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে তিনি সুশাসনের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক বলে মনে করতেন। অ্যারিস্টটল এমনটি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ভর করে যুবাদের শিক্ষার মানের ওপর।
নিজের জীবদ্দশায় তেমন আলোচনায় না এলেও জার্মান দার্শনিক হেগেল (১৭৭০-১৮৩১) প্রায় ২০০ বছর আগে শিক্ষা, শিক্ষকতা ও বিজ্ঞানসম্মত যুক্তির চর্চা বিষয়ে যা বলেছেন ও লিখেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলো এখন বলছে, তা কেবল এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণই নয় আজো প্রাসঙ্গিক বটে। হেগেল দুই শতাব্দি আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ‘জোর করে গেলানো’র প্রবণতা কখনোই মঙ্গলজনক নয় বরং শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক একটা শিক্ষণ প্রক্রিয়া প্রণয়ন ও অনুসরণ করাই বেশি কার্যকর। অ্যারিস্টটলের মতোই হেগেলও বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার মূল চ্যালেঞ্জ হলো একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি মনে করতেন, শৈশব থেকেই ব্যক্তির মধ্যে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া জরুরি।
পশ্চিমে ‘আভিসেনা’ নামে খ্যাত পারস্যের মনীষী ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) লিখেছিলেন, শিক্ষার্থীদের বাসায় প্রাইভেট বা টিউশনের মাধ্যমে পড়ানো উচিত নয় কেননা এতে শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয় না। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীকে কেবল শ্রেণিকক্ষেই পাঠদান করতে হবে; সবার সাথে পড়লে একটি প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে এবং শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিবেশ থেকেও অনেককিছু শিখতে পারে যার ফলে একটি সার্বিক শিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়।
ইংরেজ দার্শনিক জন লক (১৬৩২-১৭০৪) ধারণা দিয়েছিলেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য কোনো বিশেষ একটি বিষয়ে শিক্ষার্থীকে পণ্ডিত করে তোলা নয় বরং বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞানকে প্রয়োজনের সময় সে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে, সেই শিক্ষা দেয়া জরুরি। তিনি মনে করতেন, শিক্ষাই একজন ব্যক্তিকে গড়ে তোলে; সে ভালো বা মন্দ কিংবা কাজের বা অকাজের Ñ এর দশ ভাগের নয় ভাগই আসলে ওই ব্যক্তির শিক্ষা। অনেক পণ্ডিত মনে করেন, মানুষের চিন্তা ও মননের জগত সম্পর্কে জন লক-এর ধারণার অনেকখানিই ইবনে তুফাইল-এর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত।
পশ্চিমের দেশগুলোতে ‘আবুবাসের’ বা ‘ইবনে তোফায়েল’ হিসেবে পরিচিত আন্দালুসিয়-আরবীয় দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক ইবনে তুফাইল (১১০৫-১১৮৫) প্রস্তাব করেছেন, মানবশিশুকে সমাজ থেকে দূরে (এক অর্থে দ্বীপান্তরে) রাখতে হবে যেখানে সে সবকিছু শিখবে নিজের প্রত্যক্ষ ‘অভিজ্ঞতা’ থেকে।
ইতালির দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববেত্তা সেন্ট থমাস অ্যাকুইনাস (১২২৫-১২৭৪) শিক্ষাবিষয়ক আলোচনায় ধর্মকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন – সবকিছুকে তিনি ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন।
অ্যারিস্টটল ও থমাস অ্যাকুইনাস-এর ভাবধারায় বিশ্বাসী মার্কিন দার্শনিক মর্টিমার জেরোমে অ্যাডলার (১৯০২-২০০১) মনে করতেন, চিরকালীন ও স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে আবেদন রয়েছে Ñ এমনসব বিষয় শিক্ষার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত; এজন্যে নীতিশিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে Ñ ঘটনার ওপর নয়। যেহেতু আমরা মানুষ, তাই যন্ত্র বা কৌশলের চেয়ে প্রথমে মানবিক বা মানবসুলভ বিষয় শেখানোর ওপরই মনোযোগ দেয়া দরকার।
শিক্ষার দর্শন বিষয়ে পোলিশ শিক্ষাবিদ হ্যারি এস. ব্রাউডি (১৯০৫-১৯৯৮)-এর ধারণায় সত্যতা, উদারতা ও সৌন্দর্য গুরুত্ব পেয়েছে। বাস্তবতাবাদ ও অস্তিত্ববাদের ধারণায় প্রভাবিত এ শিক্ষাবিদ শিক্ষার আদর্শে দুটি ধারণা দিয়েছেন : এক. সত্য এবং দুই. শিক্ষা ও আদর্শ জীবনের একটি সার্বজনীন ভিত্তি স্থাপনে মানবজাতির লড়াই। তিনি মনে করতেন, বহুধা বিভক্ত সমাজকে একত্র করার মাধ্যম হলো শিক্ষা।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) বিশ্বাস করতেন, শিক্ষণ (শিক্ষা) ও প্রশিক্ষণ দুটি ভিন্ন বিষয় কেননা ‘চিন্তা’ শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ কিন্তু প্রশিক্ষণে চিন্তার অংশগ্রহণ থাকে না। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তির চরিত্র ও নৈতিকতা গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যুক্তির চর্চা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি সার্বজনীন শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং মনে করতেন, প্রয়োগের মাধ্যমেই শেখাটা বেশি জরুরি।
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) বিশ্বাস করতেন, শিক্ষণ (শিক্ষা) ও প্রশিক্ষণ দুটি ভিন্ন বিষয় কেননা ‘চিন্তা’ শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ কিন্তু প্রশিক্ষণে চিন্তার অংশগ্রহণ থাকে না। তিনি মনে করতেন, ব্যক্তির চরিত্র ও নৈতিকতা গড়ে তোলার জন্যে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় যুক্তির চর্চা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি সার্বজনীন শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন এবং মনে করতেন, প্রয়োগের মাধ্যমেই শেখাটা বেশি জরুরি।
মার্কিন দার্শনিক, মনোবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক জন ডিউই (১৮৫৯-১৯৫২)-এর মতে, শিক্ষা মূলত জীবনের সামাজিক ধারাবাহিকতা; শিক্ষাকে তিনি গোষ্ঠীবদ্ধ বা দলগতভাবে জীবনকে অবিরত বা চলমান রাখার একটি উপায় হিসেবে দেখেছেন। তিনি শিক্ষার প্রথাগত আধিপত্যবাদী ধারায় সংস্কার আনায় বিশ্বাসী ছিলেন এই যুক্তিতে যে, এমন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল তথাকথিত ‘জ্ঞান বিতরণ’ সম্ভব হয় কিন্তু এ জ্ঞান অনুধাবনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব হয় না।
স্কটিশ শিক্ষাবিদ এ. এস. নিল (১৮৮৩-১৯৭৩)-এর চিন্তাধারার সাথে জন ডিউই-এর ধারণার অনেক মিল রয়েছে; নিল গণতান্ত্রিক একটা শিক্ষাধারার পক্ষপাতী ছিলেন যেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক স্বাধীনভাবে ও সমানভাবে শিক্ষণ পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত নানা কর্মকা- ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নেবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুখী মনোভাব থাকা দরকার আর পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ছাড়া এ মনোভাব তৈরি হতে পারে না। তাঁর মতে, শৈশবে স্বাধীনতার অভাবে সৃষ্ট অ-সুখী মনোভাবই পরিণত বয়সে ব্যক্তির যাবতীয় মনোক্লেশের কারণ ঘটায়।
মার্কিন চিন্তক ও শিক্ষাবিদ উইলিয়াম হার্ড কিলপ্যাট্রিক (১৮৭১-১৯৬৫) জন ডিউই-এর ধারণা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন অনেকখানিই। কিলপ্যাট্রিক-এর মতে, শিক্ষকের কাজ শিক্ষার্থীকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা নয় বরং কেবল একজন ‘গাইড’ হিসেবে তাকে দিকনির্দেশনা দেয়া। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিশুরাই তাদের আগ্রহ ও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের শিক্ষার ধরন ও ধারা ঠিক করবে; এজন্যে শিশুদেরকে তাদের চারপাশের জগতকে নিজেদের মতো করে দেখার ও বোঝার সুযোগ করে দিতে হবে।
ফরাসি দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও সাহিত্য সমালোচক মিশেল ফুকো (১৯২৬-১৯৮৪) প্রায় একই ধারণা পোষণ করেছেন; তিনি মনে করেছেন, শিক্ষার্থীদের পূর্বনির্ধারিত পরিচয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে রাখা আসলে তাদের নৈতিক চরিত্রে বলীয়ান ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।
ব্রিটিশ শিক্ষাবিদ শার্লট ম্যাসন (১৮৪২-১৯২৩), বলা যায়, তাঁর পুরো জীবন কাটিয়েছেন শিশুদের শিক্ষার মান কীভাবে উন্নত করা যায়, সে কাজে। তাঁর যে শিক্ষার দর্শন, সেটিকে প্রায়ই এ দুইভাবে উল্লেখ করা হয় : এক. শিক্ষা হলো একটি বাতাবরণ বা পরিম-ল, একটি শৃঙ্খলা, একটি জীবন; এবং দুই. শিক্ষা হলো সম্পর্কের বিজ্ঞান। ম্যাসন বিশ্বাস করতেন, জন্মলগ্ন থেকেই শিশুরা একেকটি পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব এবং তাদেরকে স্বাধীন চিত্ত ও যুক্তিবাদী মানস গঠনের শিক্ষা দেয়াই বেশি জরুরি।
ইতালিয় চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরি (১৮৭০-১৯৫২) পরীক্ষামূলক এক শিক্ষণ পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন, যেখানে শিশুদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয় এবং তাদেরকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় তারা চারপাশ থেকে কীভাবে শিখছে। এই পদ্ধতিতে শিশুরা স্বাধীনভাবে শেখে এবং একজন শিক্ষক কেবল তাদের সহযোগির ভূমিকায় থাকেন। তাঁর এ পদ্ধতি বেশ সফল হয় যার ফলে পরবর্তী সময়ে অনেকেই এই পদ্ধতির ওপর নির্ভর করতে শুরু করেন; এই পদ্ধতি একসময় ‘মন্তেসরি মেথড’ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
অস্ট্রিয়ান দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক ও স্থপতি রুডলফ স্টেইনার (১৮৬১-১৯২৫) একটি মানবিক শিক্ষাধারার পক্ষে মত দেন। তাঁর মতে, শিক্ষণ হচ্ছে একটি আন্তঃবিষয়ক বা পরস্পরনির্ভর প্রক্রিয়া যেখানে ব্যবহারিক, শৈল্পিক ও ধারণাগত উপাদানের সমন্বয় দরকার। স্টেইনার শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর মধ্যে কল্পনাশক্তি, চিন্তাশক্তি, সৃষ্টিশীলতা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা গড়ে তোলাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। তিনি প্রস্তাব করেছেন, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা হওয়া উচিত শিল্পনির্ভর যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌন্দর্যের চেতনা গড়ে তুলবে; মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম এমন হবে যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধা বা মানসিক দক্ষতা ও বিচারক্ষমতা গড়ে তুলবে; এবং উচ্চতর পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থীরা ‘সত্যের’ সন্ধান করবে। স্টেইনারের শিক্ষার এই স্তরবিন্যাস শিশুর মনোজাগতিক গঠনের পর্যায় সম্পর্কে মনোবিদ জ্যঁ পিয়াজে-এর প্রস্তাবের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ।
সুইস মনোবিজ্ঞানী ও দার্শনিক জ্যঁ পিয়াজে (১৮৯৬-১৯৮০) কেবল জ্ঞান অর্জন নয়, বরং জ্ঞানের গুণগত মানের ওপর মনোযোগ দিতে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি শৈশবের শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
মার্কিন মনোবিজ্ঞানী জেরোমে ব্রুনার (১৯১৫-২০১৬) প্রস্তাব করেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিক্ষার নানা স্তরেই পুনরাবৃত্তি করা দরকার; কেননা প্রতিটি শিক্ষার্থীই জীবনের কোনো না কোনো স্তরে এসে একটা বিষয় সার্বিকভাবে অনুধাবনে সক্ষম হয়। পুনরাবৃত্তি থাকলে সবারই সবকিছু শেখার একাধিক সুযোগ তৈরি হয়। তিনি এটিও বিশ্বাস করতেন, ‘গ্রেড’-এর মতো বাহ্যিক প্রণোদনা নয় বরং শিক্ষার্থী কিছু শিখতে পারলে তার মধ্যে যে প্রণোদনাটি তৈরি হয়, শেখার জন্যে সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা অতীতের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে নতুন কিছু জানতে বেশি পছন্দ করে যাকে উৎসাহিত করা জরুরি।
মার্কিন নারীবাদী, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক নেল নডিংস (জন্ম : ১৯২৯) মনে করেন, শিক্ষার দর্শন মূলত যতœ ও নৈতিকতা – এ দুয়ের মধ্যে আবর্তিত হওয়া দরকার। তিনি মনে করেন, শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীর প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল হওয়া; এর মাধ্যমে একজন শিক্ষক তাঁর প্রতিটি শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও প্রয়োজন সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে পারবেন এবং তাদের মঙ্গল সাধন করতে পারবেন।
ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরি (১৯২১-১৯৯৭) শিক্ষার দর্শনে ধ্রুপদী ধারা থেকে শুরু করে আধুনিক চিন্তাধারাকে সমন্বয় করেছেন। এজন্যে তিনি প্লেটো থেকে মার্কস এবং উপনিবেশবাদবিরোধী সমসাময়িক চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাকে কাজে লাগিয়েছেন। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত ‘পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড’ বইয়ে তিনি শিক্ষাকে, খুব সহজ কথায়, মুক্তির পথ হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে এজন্যে তিনি শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের মধ্যকার সনাতনী ‘দাস-প্রভু’ সম্পর্ক-কাঠামোকে ভাঙ্গার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, এখনকার শিক্ষাব্যবস্থার গলদ হলো, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কটি হচ্ছে বুর্জোয়া আর প্রলেতারিয়েতের মধ্যকার সম্পর্কের মতো; এই কাঠামো ভেঙ্গে ক্ষমতাহীন একটি সমান্তরাল ও সরল কাঠামোর ওপর শিক্ষাব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে না পারলে এ থেকে আমরা কোনো ভালো ফল লাভের প্রত্যাশা করতে পারি না।
জার্মান চিন্তাবিদ মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬)-এর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণাকে এক সূত্রে প্রোথিত করে এর মাধ্যমে জ্ঞানের নানা শাখায় প্রচলিত যেসব সনাতনী ধারণা চলে আসছে, সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত।
‘শিক্ষার উদ্দেশ্য কী?’ – এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা উপস্থাপন করেছেন ইংরেজ দার্শনিক, গণিতবিদ, ঐতিহাসিক, সমালোচক ও নোবেলজয়ী সাহিত্যক ব্রার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০)। রাসেল তাঁর মনোজগতে যে বিশ্বকে ধারণ করতেন সেখানে অসত্যের ওপর সত্যের, ঘৃণার ওপর ভালোবাসার, ধ্বংসের বিপরীতে সৃষ্টিশীলতা, নিপীড়নের স্থলে স্বাধীনতা এবং যুদ্ধের ওপর শান্তির জয় বিরাজমান। তাঁর মতে, একমাত্র শিক্ষাই এটি সম্ভব করতে পারে। তবে সেই শিক্ষা এমন হতে হবে যা ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র গঠন করবে, ব্যক্তির মননের বিকাশ ঘটাবে, তার মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করবে, তাকে সংবেদনশীল করবে, তাকে সুনাগরিক করে তুলবে। তবে রাসেল মনে করতেন, শিক্ষার মহত্তম উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তির মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদের বিকাশ ঘটানো। তবে রাসেল মনে করতেন, এজন্যে সেই শিক্ষা হতে হবে সুপরিকল্পিত – বিভিন্ন বয়সের অনুপাতে তিনি পাঠক্রম সাজানোর সুপারিশ করেছেন। যেমন, প্রথম স্তর (১ থেকে ৩ বছর): এ বয়সে কেবল মৌলিক শারীরবৃত্তিয় ব্যাপারগুলো শেখানো দরকার; পাশাপাশি চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞানলাভও এ সময়ে জরুরি। দ্বিতীয় স্তর (৩ থেকে ৫ বছর): নাচ, গান, ছবি আঁকা, পড়তে ও লিখতে শেখা এবং মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষা শিক্ষা এ সময়ের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয় স্তর (৫ থেকে ১৪ বছর): বীরত্বের গাথা, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষা এ সময়ের মধ্যে সম্পাদন করতে হবে। চতুর্থ স্তর (১৪ থেকে ১৮ বছর): উঁচু মানের সাহিত্য, গণিত ও বিজ্ঞান এবং মানবিক ইতিহাস তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে এ সময়ের মধ্যে শেখাতে হবে। পাশাপাশি বাধ্যতামূলকভাবে শারীরবিজ্ঞান, স্বাস্থ্য ও যৌন শিক্ষা এই তিন শ্রেণিতে রাখতে হবে। পঞ্চম স্তর (১৮ বছর থেকে পরবর্তী): শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পেশাগত দক্ষতার জন্যে দরকারি বিষয়সমূহের ওপর শিক্ষাদান করতে হবে। তাঁর মতে, শিক্ষার্থীরা নিজেরা প্রয়োগ থেকে শিখবে আর পুরো শিক্ষণ প্রক্রিয়া একেবারেই ‘ভয়মুক্ত’ হতে হবে বলে তিনি জোর মত দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের মেধা ও প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরকারের কথাও তিনি বলেছেন।
যুগে যুগে আমরা স্বীকার করে এসেছি, প্রতিটি ব্যক্তির মানস-চরিত্র আলাদা। তাহলে সেই বিচারে প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা এবং তাই প্রত্যেকের ভাবনা-চিন্তা, আদর্শ, আগ্রহ, সামর্থ্য-দুর্বলতা মাথায় রেখে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত করে গড়ে তোলার মানসিকতা শিক্ষকদের মধ্যে থাকা দরকার।
যুগে যুগে আমরা স্বীকার করে এসেছি, প্রতিটি ব্যক্তির মানস-চরিত্র আলাদা। তাহলে সেই বিচারে প্রতিটি শিক্ষার্থী আলাদা এবং তাই প্রত্যেকের ভাবনা-চিন্তা, আদর্শ, আগ্রহ, সামর্থ্য-দুর্বলতা মাথায় রেখে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত করে গড়ে তোলার মানসিকতা শিক্ষকদের মধ্যে থাকা দরকার। কিন্তু কেবল পরীক্ষা পাসের যে শিক্ষাব্যবস্থা দিনে দিনে গড়ে উঠেছে সেখানে আমরা কোনো জ্ঞানতাপস বা বিদ্যার্থী তৈরি করা দূরে থাক নিছক একটা নিদেন পক্ষে ভালো মানুষ বা সুনাগরিক তৈরিরও ধারে-কাছে নেই – কেবলই ‘চাকরিপ্রার্থী’ আর ‘চাকুরে’ তৈরি করছি; কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি, কেবল কিছু ‘পরীক্ষার্থী’, ‘চাকরিপ্রার্থী’ আর ‘চাকুরে’ আমাদের কোন্ কাজে আসবে?
একটি যুক্তবাদী, চিন্তাশীল ও বিজ্ঞানমনস্ক মন কেবল ব্যক্তি নয় গোটা দেশ এমনকি গোটা বিশ্বের মঙ্গলের জন্যে জরুরি। এজন্যে দরকার সত্যের উন্মোচন আর সত্য উন্মোচনের জন্যে জানতে হবে আর জানতে হলে প্রশ্ন করতে হবে। কয়েক হাজার বছর আগেই দার্শনিকেরা এ সত্য উপলব্ধি করেছেন। ‘দ্য আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’ বইয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন, ভারতীয় সংস্কৃতিতে হাজারো বছর ধরেই গঠনমূলক তর্কের চল ছিলো। কিন্তু কয়েক হাজার বছর পরে এসেও আমরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করাকে রীতিমতো ‘ঔদ্ধত্য’ বা ‘বেয়াদবি’ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না! ক্লাসরুমে কোনো প্রশ্ন তোলা যায় না – স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় – সবখানেই এই এক চিত্র। অথচ সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল বা আইনস্টাইন – চিন্তা ও জ্ঞানের জগতে গুরুত্বপূর্ণ প্রায় প্রতিটি মানুষই প্রশ্ন করাকে জ্ঞানলাভের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে দেখেছেন এবং অবিরতভাবে প্রশ্ন করাকে উৎসাহিত করেছেন। অমর্ত্য সেন-এর কথার সূত্র ধরেই যদি বলি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীকে ‘না’ বলতে শেখানো, শিক্ষার্থীর দ্বিমত-ভিন্নমত নির্ভয়ে প্রকাশের সাহস যোগানো; কেননা দ্বিমত-ভিন্ন-মত-তর্ক ছাড়া জ্ঞান তৈরি হয় না, সমাজ এগোয় না। কিন্তু শিক্ষার্থীর প্রশ্ন কিংবা ভিন্নমত উৎসাহিত করার এই উদারতা কতোজন শিক্ষকের মধ্যে রয়েছে তা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি।
শেখা আর শেখানোর মধ্যে ‘দ্বান্দ্বিকতা’ দরকার; না হলে শেখার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণতা লাভ করে না। কিন্তু এর বদলে শিক্ষক-প্রধান একরৈখিক একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে যেখানে শিক্ষক আর শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক সহযোগির না হয়ে ‘দ্বান্দ্বিক’ হয়ে উঠেছে। শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষার্থীর বিশ্বস্ত বন্ধু; যার কাছে শিক্ষার্থী মন খুলে নিজের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সহমত-ভিন্নমতের সৎ বয়ান তুলে ধরতে পারবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক এমনটি না হলে একজন শিক্ষক কখনোই তাঁর শিক্ষার্থীর আগ্রহ, প্রয়োজন বা সামর্থ্যরে বিষয়টি বুঝতে পারবেন না এবং তাকে ‘শেখাতেও’ পারবেন না।
শিক্ষক তাঁর নিজের জ্ঞানের আলোতে সবাইকে আলোকিত করবেন; নিজের প্রচ্ছায়া নয়, শিক্ষার্থীদের তিনি স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিজেকে উৎসর্গ করবেন। তাদের মধ্যে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম হবে শিক্ষা। এজন্যে উভয়ের মধ্যে একটি আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষক অনুসন্ধিৎসাকে উৎসাহিত করবেন, চাটুকারিতা নয়। আর তা সম্ভব কেবল ভীতিমুক্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থেকে যা আসতে পারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে আনুভূমিক যোগাযোগ কাঠামো থেকেই; শিক্ষকক্রেন্দ্রিক না হয়ে শিক্ষাব্যবস্থাটা আরো বেশি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক হওয়া দরকার; না হলে শিক্ষার্থীরা ক্রমেই বৃত্তের বাইরের দিকে যেতে থাকবে।
শিক্ষার্থীদের সর্বান্তকরণে ‘বিদ্যার্থী’ (বিদ্যা+অর্থী=বিদ্যা লাভে আগ্রহী) করে তুলতে হবে; এজন্যে দুজনের মধ্যে আন্তরিক যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। আর কেবল বইয়ের পড়া মুখস্থ করানো কোনো শিক্ষকের কাজ হতে পারে না; একজন শিক্ষক শেখাবেন না – তিনি যা শেখাতে চান, তা নিজের জীবনে যদি ধারণ করেন, প্রয়োগ করেন, তবে শিক্ষার্থীরা তাঁকে অনুসরণের মাধ্যমেই জীবনের প্রকৃত শিক্ষাটি অর্জন করবে। পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরেও শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে পড়তে ও জানতে উৎসাহিত করবেন – এটিই কাম্য। গ্রেডসর্বস্ব সার্টিফিকেটের চেয়ে সত্যিকার অর্থে জানার গুরুত্ব, একটি আলোকিত মানস অর্জনের গুরুত্ব বোঝাতে হবে শিক্ষার্থীদের। একজন শিক্ষার্থীকে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে পরিপূর্ণ মানুষ ও আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা আজকের সময়ে খুব বেশি প্রয়োজন। একজন শিক্ষার্থীকে কেবল চাকরির বাজারের জন্যে প্রস্তুত করলে চলবে না এর পাশাপাশি তাকে একজন যুক্তিবাদী চিন্তাশীল মানুষ হিসেবেও গড়ে তোলা চাই। আর এ দায় শিক্ষার্থী বা শিক্ষক একার নয় – দুজনেরই।
আমরা কি এই উদ্দেশ্য নিয়েই পড়ছি বা পড়াচ্ছি? প্রশ্নটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক – উভয়েরই জন্যে।
তথ্যসূত্র
সজীব সরকার: সহকারি অধ্যাপক, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।
নোট: লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে প্রকাশিত যোগাযোগ জার্নাল ২০১৯-এর ‘অগ্রায়ন’ সংখ্যায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটে লেখাটি পুনঃপ্রকাশের অনুমতির জন্য সম্পাদকবৃন্দকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান! বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের…
নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল…
বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির…
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের…
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, "কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক…
মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে…