একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি বা উন্নয়নের জন্য ৪০ বছর সময় খুব বেশি না হলেও একেবারে কমও নয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৪০ বছর পার করছে। স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে এসে অনেকে হিসেব-নিকেশ করতে চাইবেন- এই লম্বা সময়ে বাংলাদেশ কতোটুকু এগিয়েছে। বিশেষত স্বাধীনতার পর গণমানুষ একটি স্বাধীন দেশের কাছ থেকে যে মাত্রার উন্নতি ও অগ্রগতি আশা করেছিল, সেই প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যকার ফারাক কতোটুকু সেটি দেখার সময় হয়েছে এখন।

ব্যক্তি মানুষের অগ্রগতি এবং দেশের অগ্রগতি মাপার কৌশল এক নয়। ব্যক্তি মানুষের অগ্রগতি যতো সহজে মাপা যায়, একটি দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি মাপা ততোটাই দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। এর একটি কারণ হলো- একটি নির্দিষ্ট সময় পর আমরা দেশকে কোন জায়গায় দেখতে চাই, সে সম্পর্কিত সূচক, ধারণা বা পরিকল্পনার অভাব। স্বাধীনতার পর নানা সূচকে দেশের অবস্থা কীরকম ছিল, সে সম্পপর্কিত খুব কম তথ্য পাওয়া যায়। তার চেয়েও বড় বিষয় হলো, স্বাধীনতার ১০, ২০ বা ৫০ বছর পর দেশকে কোন জায়গায় দেখতে চাই, সেরকম পরিকল্পনার অভাব আমাদের সবসময়ই ছিল। ফলে কীসের ভিত্তিতে দেশের অগ্রগতি নির্ধারণ করা হবে, সেই বিষয়টিও তর্কসাপেক্ষ হয়ে যায়। তারপরও মানুষের কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। থাকে চাওয়া-পাওয়া। সেগুলোর ভিত্তিতে দেশের অগ্রগতি কিছুটা হলেও মাপা যায় বা মাপা সম্ভব। অন্য দেশের তুলনায় নিজ দেশের অবস্থা জেনেও অগ্রগতি বুঝার একটি চেষ্টা করা যায়। সবচেয়ে ভালো হয়, স্বাধীনতার সময় অর্থনৈতিক শক্তিতে যে সব দেশ বাংলাদেশের সাথে একই কাতারে ছিল, তাদের সাথে তুলনা করে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থান নির্ধারণ করতে পারলে। ৪০ বছরের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দৌড়ে আমরা অবশ্যই কিছু না কিছু উন্নতি করেছি; কিন্তু সেটির গতি অন্যদের তুলনায় কম না বেশি, সেটিই আসলে মূল বিবেচ্য।

এ ধরনের কাজে অর্থনীতিবিদরা প্রায়শই নানা সূচক, সংখ্যা বা উপাত্ত ব্যবহার করে দেশের অবস্থা বিচার করেন, বিভিন্ন দেশের মধ্যকার অবস্থার তুলনা করেন। যেসব ডিসিপ্লিনে এ ধরনের সংখ্যাগত ফলাফল পাওয়া যায়, সেগুলো দিয়ে দেশের অবস্থা স¤পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা বা এ ধরনের সামাজিক অবস্থার অগ্রগতি বা উন্নতি নির্ধারণ করা এক অর্থে কঠিন কাজ। দেশে কতোটি বিদ্যালয় আছে, কতোজন শিক্ষার্থী আছে ইত্যাদি বিষয় স¤পর্কে তথ্য-উপাত্ত সহজেই বলে দেওয়া গেলেও এসব তথ্য থেকে দেশের শিক্ষার সার্বিক অগ্রগতি স¤পর্কে ধারণালাভ অসম্ভব। ফলে শিক্ষার অগ্রগতি নিয়ে কথা বলতে গেলে একটু অন্যভাবে বিষয়গুলো দেখতে হবে।

যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তাদের কাছে শিক্ষার গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাগুলোর একটি হচ্ছে- শিক্ষা মানুষের মধ্যে এমন ইতিবাচক পরিবর্তন আনে যা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ শিক্ষাকে ধরা হয় মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে সহায়ক একটি পদ্ধতি হিসেবে। এই জায়গাতে বাংলাদেশ কতোটা এগিয়েছে? সন্দেহ নেই- গত ৪০ বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে, প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিতের হার বেড়েছে, নানা বিষয়ে দক্ষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, নানা ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে, বেড়েছে শিক্ষাসম্পর্কিত সচেতনতাও। কিন্তু সত্যিকার অর্থে শিক্ষিত হতে পেরেছি আমরা কজন? শিক্ষিত হওয়া যদি বুঝায় মানুষের নৈতিক অবস্থার উন্নতি, মানবতাবোধের উন্নতি, সংস্কারমুক্ত হওয়ার দিকে অগ্রসর হওয়া; তাহলে এগুলোর বিচারে আমরা কজন নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করতে পারবো? তাত্ত্বিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ালেখা করে শিক্ষিত হওয়ার সাথে মানুষের মানবিক গুণাবলী বিকাশের একটা ইতিবাচক যোগসূত্র থাকার কথা। আমাদের রাষ্ট্রীয় নানা নীতিতেও সে ধরনের কথা বলা আছে। কিন্তু বর্তমানে একজন ব্যক্তি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করার পরও তার মানবিক গুণাবলীসমূহ অন্তত একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় বিকশিত হয়েছে বলে দাবি করতে পারবেন কি? বোধহয় না। কারণ আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে চাকুরির জন্য প্রস্তুত করে ঠিকই, কিন্তু মানবিক গুণাবলী শেখার বিষয়গুলো সেখানে উপেক্ষিত, কোথাও বা পুরোপুরিভাবেই অনুপস্থিত। আজকে যখন দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের শীর্ষ তালিকায় থাকে এবং প্রধানত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরাই এসব দুর্নীতির মূল কারিগর; তখন সহজেই বুঝা যায়, সার্টিফিকেট অনুসারে দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়লেও সত্যিকার অর্থে শিক্ষার মান নিম্নগামী, শিক্ষার প্রভাব নেতিবাচক। আজকে যখন বিদ্যালয় থেকে শুরু করে অফিস-কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের নিজ কাজে অবহেলা করতে দেখা যায়, তখন সহজেই বুঝা যায় প্রচলিত শিক্ষা আমাদেরকে কাজে ফাঁকি দেয়া শিখিয়েছে। অথচ গত ৪০ বছরে এই মানুষগুলোই শিক্ষিত হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে কাজ করছে! তাহলে এ সময়ের শিক্ষা মানুষকে কি শুধু সার্টিফিকেটই দিয়েছে, শিক্ষিত করতে পারে নি?

শিক্ষার কাজ ব্যক্তির উন্নয়ন, সমাজের উন্নয়ন, দেশের উন্নয়নে মূল ভূমিকা পালন করা। নানা দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এই দুর্বলতাগুলোর একটি হলো শিক্ষার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নীতি না থাকা। স্বাধীনতার পর একটি দেশের নানা প্রায়োরিটি থাকে। হাজারো প্রায়োরিটির ভিড়ে শিক্ষা পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। স্বাধীনতার বছর চারেকের মধ্যে এই দেশ একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সময়ের তুলনায় আধুনিক শিক্ষা পরিকল্পনা পেয়ে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির সংস্কৃতি শিক্ষাকে কখনোই সুস্থির জায়গায় পৌঁছাতে দেয় নি। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকার আগের কমিশন রিপোর্টগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে নতুন করে প্রতিবেদন প্রণয়ন করিয়েছে- তাদের ইচ্ছা ও দলীয় আদর্শ অনুসারে। রাষ্ট্রের আদর্শও অবশ্য ইতোমধ্যে বদলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন যে চার মূলনীতিকে কেন্দ্র করে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদন রচিত হয়েছিল, রাষ্ট্র এখন সেখান থেকে বেশ দূরে। এর প্রভাব পড়েছে পরবর্তী সময়ের প্রতিবেদনগুলোতেও। অর্থাৎ শিক্ষাকে সব সরকারই অত্যন্ত স্থূলভাবে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং করেছেও। ফলে চল্লিশটি বছর ধরে বাংলাদেশের শিক্ষা চলে এসেছে নির্বাহী আদেশের জোরে। এমনটা আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! এক্ষেত্রে যে পরিবর্তনটুকু এসেছে, সেটি একেবারেই সাম্প্রতিক।

এ ধরনের ব্যর্থতার উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যাবে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ৪০ বছর আগে কীরকম ছিল? তখনকার মতো মেধাবী, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের বদলে এখন দলীয় লেজুড়বৃত্তি শিক্ষকদেরই প্রাধান্য দেখতে পাই। যে মালয়েশিয়া, হংকং বা কোরিয়া থেকে একসময় শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতো, এখন তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায়। দেশে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমছে উল্লেখযোগ্য হারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় কোরিয়া ও মালয়েশিয়ার সার্বিক অবস্থা বাংলাদেশের মতোই ছিল। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এবং পরিকল্পনামাফিক সব পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি নজর দিয়ে আজ তারা কোন পর্যায়ে? এই হিসাবগুলো এখন নির্মোহভাবে করা দরকার। এই দেশগুলোর সাথে আমাদের অবস্থার তুলনা সমাজের প্রতিটি স্তরে দেখানো দরকার। শিক্ষা নিয়ে আমরা যারা নানা সময়ে উদাসীন থেকেছি, তাদের উপলব্ধি করানো দরকার- শিক্ষা কোনো রুটিন কাজ নয়; একে নিয়ে ভাবতে হয়, সযত্নে পরিচর্যা করতে হয়। আর সেই কাজগুলো করা গেলেই কেবল অগ্রগতির আশা করা যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যর্থতার পাশাপাশি আমাদের অনেক সাফল্যও আছে, কিন্তু সেগুলো সামগ্রিক উন্নয়নকে প্রতিনিধিত্ব করে কম। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে এ দেশের সাফল্য এখন বর্হিবিশ্বে উচ্চারিত হয় অহরহ। দেশের প্রচুর মেধাবী তরুণ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা সাফল্য দেখাচ্ছে। বিভিন্ন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতায় নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রায়শই হারাচ্ছে আমাদের সীমিত স¤পদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তরুণরা। স্বল্প সুযোগে এসব সাফল্য হতাশার আড়ালে বড় কোনো সুসংবাদের বার্তাই প্রদান করে। কিন্তু ছোট সাফল্য নিয়ে বসে থাকার দিন এখন ফুরিয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার সামগ্রিক ও বিস্তারিত পরিকল্পনা যেখানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী উভয় ধরনের চিন্তাভাবনা প্রতিফলন দেখা যাবে। স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর আমরা পার করেছি অনেক অবহেলায়। আর মাত্র দশটি বছর পরই উদযাপিত হবে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর। পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ব্যর্থতায় ঠাসা লেখার বদলে যেন সাফল্যের তুষ্টিতে ভুগতে পারি, সেজন্য অনেকে আগে থেকেই নানা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। এই অব্যাহত ব্যর্থতা আর যেন আমরা লালন না করি!

Sending
User Review
0 (0 votes)

লেখক সম্পর্কে

গৌতম রায়

গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

মন্তব্য লিখুন