অসহিষ্ণু শিক্ষার্থী: এ কিসের আলামত?

গত ৫ সেপ্টেম্বর গলাচিপায় একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসানকে তার সহপাঠীরা অস্ত্রের আঘাতে জখম করে। বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মারামারির অসংখ্য দৃশ্য আমার চোখের সামনে ঘটেছে। তাই এককভাবে একজন শিক্ষার্থীকে কেউ জখম করার খবরটি হয়তো আমার জানার বাইরেই থেকে যেত। কিন্তু খবরটি যখন আমি আমার সহকর্মীর কাছে প্রথম শুনতে পাই, তখন আমার মাথায় কিছু ভাবনা চলে আসে। ওই ছেলেটি আমার সহকর্মীর অত্যন্ত প্রিয় একজন কাজিন। তাই যখন সহকর্মী আমাকে ঘটনাটির কথা বলে, তখন আমি ভাবতে থাকি আমার শিক্ষাজীবনের কথা। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পার করে আসার সময় অসিহষ্ণু শিক্ষার্থী নিয়ে আমি বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি; যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমাদের পাশের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের একটি প্রতিযোগিতা চলতো- কারা কত ভালো রেজাল্ট করতে পারে। এছাড়া আমি আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকার সময় কারও সাথে মারামারি বা কথা কাটাকাটি হয়েছে এমন ঘটনা মনে করতে পারি না। তবে মাঝে মাঝে হালকা মারামারি হত, সেটা একেবারেই নগণ্য।

এরপর মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। মাধ্যমিকে ভর্তির পর থেকে দেখেছি বাৎসরিক একটা মারামারি হতো। তবে সেটা ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে। বিদ্যালয়গুলোতে আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবলের প্রতিযোগিতা হয়। এ খেলা সাধারণত হয় উপজেলা পর্যায়ে। আমাদের বাছাই পর্বের ফাইনাল খেলা হতো আমাদের বিদ্যালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরে। খেলায় জেতাটা ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। এ কারণেই যে বিদ্যালয়কে খেলার আয়োজন করতে দেওয়া হতো তারা কিছুটা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতো। বিশেষ করে সেই বিদ্যালয়টি যদি এমন স্থানে অবস্থিত হয় যে সেই স্কুলের পাশ দিয়ে আমাদের শহরে যাতায়াত করতে হতো, তবে তারা অবশ্যই জোর করে জেতার চেষ্টা করতো। এর ফলে শুরু হতো মারামারি। আমাদের বিদ্যালয় খেলায় ভালো ছিল, তাই ওদের সাথে মারামারি করতেই হতো। তবে সেটা যে খুব একটা বেশি কিছু ছিল তা না। সাধারণ হাতাহাতি। তা কখনই মারাত্মক কিছুতে রূপ নিত না। এছাড়া মাধ্যমিকে পড়াকালীন সময়ে আমি কখনও মারামারি হতে দেখি নি।

কলেজে থাকাকালীন ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া দেখেছি, তবে তা এতো হিংস্র ছিল না। হয়তো একদল মিছিল করছে, তাদের পাশ দিয়ে আরেকদল মিছিল নিয়ে যাচ্ছে। মাঝখানে কথাকাটাকাটি। তবে তা উৎসবের মতোই লাগতো। কখনও এটি মারামারিতে রূপ নিতো না। হয়তো তখনও শিক্ষার্থীদের মাঝে মানবতা ছিল। একে অপরকে বন্ধুই মনে করতো। প্রতিপক্ষ না। হয়তো তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন ছিল। কিন্তু তারপরও তারা ছিল একে অপরের বন্ধু।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার দেখা সব অংক পাল্টে গেল। এখানে এসে দেখলাম তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মারামারি, লাঠালাঠি, ক্ষেত্রবিশেষে অস্ত্রের ঝলকানি। এটা কি সময়ের প্রয়োজন, না পরিবর্তনের হাওয়া? হয়তো আগেও মারামারি হতো, তবে এত করে চোখে পড়ে নি। কে যেন বলেছিলেন, মন যা জানে না চোখ তা দেখে না। তাই হয়তো আমি ভর্তি হওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব ঘটনার কথা জানা হতো না।

একসময় বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করলাম। চাকুরিকালীন সময়ে দেখলাম যুগের পরিবর্তন। চারদিকে লক্ষ্য করে দেখলাম শিক্ষার্থীরা আর আগের মতো নেই। তাদের প্রধান কাজ পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে মারামারিতেও লিপ্ত হচ্ছে। তারা এখন তুচ্ছ ঘটনাকে সামনে নিয়ে একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে।

পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় এক স্কুলের শিক্ষার্থীরা আরেক স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। আর বর্তমানকালের শিক্ষার্থীরা এতোটাই হিংস্র হয়ে পড়েছে যে, তারা কথায় কথায় অস্ত্রের প্রদর্শনীও করতে পিছপা হয় না। তার সর্বশেষ ঘটনা রাইফেলস কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মাঝে মারামারি। এছাড়াও বর্তমানে আমরা দেখতে পাই তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সাথে মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে। সামান্য ঘটনায় (যতদুর শুনেছি, লেখার শুরুতে মাহমুদুলের ঘটনা ছিল খুবই সামান্য। মাহমুদুল প্রায়ই পরিষ্কার জামাকাপড় পড়ে আসতো, কিছুটা ফ্যাশনেবল জামাকাপড় পড়তো। আর এটা সহ্য করতো না তার সহপাঠিদের কেউ কেউ। এটা নিয়েই ঝগড়ার সূত্রপাত। তার জের ধরে সহপাঠিরা রক্তাক্ত করে মাহমুদুলকে) এতো বড় কাণ্ড!

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করা হয়। এ জন্য ফান্ডও থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও গবেষণার সুযোগ করে দেয়। এখন সময় এসেছে ভিন্ন কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা করার। কেন বর্তমানকালের শিক্ষার্থীরা এত অস্থিতিশীল আচরণ করছে? কেন তারা এত হিংস্র? কিসের অভাবে ও কিসের প্রভাবে তাদের এই আচরণ তা গবেষণা করে খুঁজে বের করতে হবে। সেই মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা যদি অসুখের কারণ না জানি তবে অসুখ দূর করবো কী করে? এই বিষয়ে যদি সরকার এখনই নজর না দেয় তবে দিন দিন শিক্ষার্থীরা আরও হিংস্র হয়ে যাবে। তখন তারা তাদের প্রধান কাজ পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গিয়ে হয়ে পড়বে একেকজন অপরাধী। এমন করে চলতে থাকলে হয়তো সেই দিন আর দূরেও নেই, যেদিন শিক্ষালয় থেকে বের হবে একেকজন দুর্ধর্ষ ক্যাডার। আমরা কি সেই দুর্দিনের কথা মনে করে একটুও চিন্তিত হবো না?

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং শিক্ষার গুণগত মান

    আমাদের দেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয় যে সরকারকে সব বই বিনামূলে বিতরণ করতে হবে। তাছাড়া সরকারের সে ক্ষমতাও ভালোভাবে নেই। শিক্ষাখাতে রয়েছে প্রচুর সমস্যা, বোর্ডের বই কেনা খুব একটা সমস্যা নয় অনেকের জন্যই। এমনটি নয় যে, বোর্ডের বইয়ের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করতে পারছে না।

    ফাদার পিশোতো : একজন মহান মানুষকে নিয়ে স্মৃতিচারণ

    জাহিদুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করেছেন ফাদার পিশোতোকে নিয়ে ‘৯৪ সালের কোনো...

    শিক্ষায় বিনিয়োগ: এক এবং একমাত্র ভাবনা

    মিরন কুমার ভৌমিক, আকলিমা শরমিন, আসমা জাহান মুক্তা, তৌফিক...

    শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়: পর্ব ১

    এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হিসেব মতে, দেশে বেসরকারি...

    সাক্ষাৎকার: দরকার সঠিক প্রস্তুতি

    যেকোনো চাকরির পরীক্ষায় আবেদনের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো...

    কোভিড-১৯ পরিস্থিতি : বাংলাদেশের শিক্ষার আদ্যোপান্ত ও কিছু প্রস্তাব

    সৌভাগ্যবশত আমাদের সন্তানদ্বয়ের একজন প্রাথমিক এবং অন্যজন মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী।...

    লেখাপড়া সমাচার: কোচিং সেন্টার

    কোচিং সেন্টার থেকে যারা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়, তাদের ভালো করার পেছনে খুব সামান্য কৃতিত্বই থাকে কোচিং সেন্টারের। কারণ, যেখানে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী তাদের পড়ার গতির সাথে তাল ধরেই রাখতে পারে না, সেখানে যারা চান্স পায় তারা যদি সত্যিকারই মেধাবী না হয়ে থাকে তাহলে টিকে থাকা মুশকিল।

    আর নয় ঝরে পড়া, আনন্দ স্কুলে পড়াশোনা

    উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দেওয়াই আনন্দস্কুলের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ বিদ্যালয়ের সময়সূচী হবে নমনীয়। স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে এ সময়সূচী নির্ধারণ করা হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবই অনুসারে আনন্দ স্কুলের পাঠদান প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে।

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।