কৃষি শিক্ষা বনাম প্রযুক্তি শিক্ষা

নবম-দশম শ্রেণীতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে যে কয়টি বিষয় দেওয়া আছে তার মধ্যে দুইটি হলো কম্পিউটার শিক্ষা ও কৃষি শিক্ষা অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী তার চতুর্থ বিষয় হিসাবে কৃষি শিক্ষাও নিতে পারে আবার কম্পিউটার শিক্ষাও নিতে পারে। এই দুটিই ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। একটি কৃষি যা মানুষের আদিম পেশাগুলোর মধ্যে একটি ও আমাদের বাংলাদেশের সিংহভাগ লোকের পেশা তা নিয়ে আলোচনা করে, অপরটি আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করে।

বাংলাদেশের প্রায় আশি ভাগ লোকের পেশা কৃষি। কৃষির উপর নির্ভর করে সচল হয় আমাদের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু আমরা কৃষিতে এখনো আধুনিক হতে পারি নি। আমাদের দেশের কৃষক এখনো সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ পরিচালনা করে থাকে। তারা অনেকে জানে না কৃষিতে কী কী আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আমি আমার গ্রামের কৃষি পদ্ধতির কথাই বলতে পারি। তারা এখনো গরু দিয়ে হাল চাষ করে। চাষের জন্য তারা ট্রাকটর ব্যবহার করতে নারাজ। ধান কাটার পর তারা মাড়াই করতে ব্যবহার করে প্রাচীন মাড়াই পদ্ধতি। কিন্তু তারা আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন না। এভাবে তারা প্রতি ধাপে ধাপে প্রাচীন সেই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে- যা কৃষির উন্নতিকে ব্যহত করে। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারে এমন কৃষক গ্রামে নেই বললেই চলে। গ্রামের বেশির ভাগ চাষিই তাদের পূর্বপুরুষের পেশাকে ধরে রাখতে গিয়ে চাষাবাদ করছে মাত্র। তাদের বেশির ভাগই আবার নিরক্ষর, তাই তারা আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ।

আবার উল্টো কথাও বলা যায়। আমি যখন আমার প্র্যাকটিস টিচিং শুরু করি তখন একটি পরীক্ষা চালিয়েছিলাম আমার ক্লাশের শিক্ষার্থীদের সাথে। ঢাকার একটি স্বনামধন্য বিদ্যালয়ে আমার ক্লাশ নেয়ার সুযোগ হয়েছিল। ক্লাশের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক বেশির ভাগই ছিলেন বাংলাদেশকে সচল রাখার কারিগর। অর্থাৎ প্রশাসনের প্রাণ। একদিন আমি ক্লাশে বললাম, তোমরা কি জানো, ধানগাছ থেকে ধান আহরণ করার পর সেই গাছ দিয়ে কি করা হয়? অনেকেই জানে না। দুই-একজন জানে বললো। আমি বললাম, বলো তো কী হয়? জবাবে যা বললো তা শুনে আমার মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হলো। জবাবটি ছিল, ধানগাছ দিয়ে কাঠ হয়। সেই কাঠ দিয়ে আমরা আসবাবপত্র বানাই।

আমার কিছু বলার ছিল না। কী বা বলার থাকতে পারে? তাদের অনেকের কখনো ধানগাছ দেখার সৌভাগ্য হয় নি। তাই এমন উত্তরে আমি অবাক হই নি। এতে তাদের কী দোষ? তাদের জানানোর দায়িত্ব ছিল যাদের তারা জানাতে পারেন নি। তাদের জানার একটা উপায় আছে তা হলো কৃষি শিক্ষা। আমরা অপশন দিয়ে তাদের সেই সুযোগটাকেও ছিনিয়ে নিচ্ছি। এ কারণে দেখা যাচ্ছে গ্রামের শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ কৃষি শিক্ষা নিচ্ছে, আবার শহরের শিক্ষার্থীরা নিচ্ছে কম্পিউটার শিক্ষা। আবার নম্বরের উপরও নির্ভর করছে কোনটা নিবে। মেয়েদের জন্য তো অপশন আরো আছে, গার্হস্থ্য শিক্ষা। হয় তুমি গৃহ কন্যা হও, মানে গার্হস্থ্য শিক্ষা নাও নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হও। এটা কেমনতর কথা?

বর্তমান সময় তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আবার আমাদের দেশ হচ্ছে কৃষিপ্রধান দেশ। তাই আমাদের উচিত দুটো দিকেই তাকানো। একটির মুখোমুখি আরেকটিকে দাঁড় না করিয়ে দুটোকে যদি সমন্বয় করা যায় তবে শিক্ষার্থীরা অঙ্কুর থেকেই যেমন প্রযুক্তির বিদ্যা লাভ করতে পারবে, তেমনই শ্রদ্ধা জানাবে আমাদের চাষি সমাজকে। তাদের নানান প্রয়োজনে তাদের সাথে এসে দাড়াতে পারবে।

অনেকে বলতে পারেন, একজন শিক্ষার্থী কি করে একই সাথে একাধিক বিষয়ে শিখবে? তাদের জন্য আমার জবাব হলো, বিষয় বিশেষজ্ঞ বানানো তো নবম দশম শ্রেণীর কাজ না। এসময়ে তারা শিখবে কিছু মৌলিক জিনিস। যা তারা কোন কারণে পড়াশোনা শেষ করলেও তাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারবে। যেমন- কৃষি ক্ষেত্রে বাগান করা, মাছ চাষ করা, ফসল ফলানো ইত্যাদি আর প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কম্পিউটার ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজ করা- টাইপ করা, ইন্টারনেট ব্রাউজ করা, মেইল করা ইত্যাদি। এজন্য খুব বেশি বইয়ের পরিধি বাড়ানো দরকার হবে না। দরকার হবে শুধু পরিবর্তনের মানসিকতা। জানি সেই মানসিকতা আমাদের দেশের লোকের আছে।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    নতুন কারিকুলাম এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

    আমরা সাইকেল চালানো শিখি মাঠে। তার অর্থ এই নয় যে, সাইকেল সবসময় মাঠেই চালাতে হবে। মূলত রাস্তায় সাইকেল চালানোর প্রস্তুতি আমরা নেই মাঠে। একইভাবে আমাদের পাঠ্যবই জীবনের প্রস্তুতির জন্য, শুধু পাঠ্যবই নিযে ব্যস্ত থাকার জন্য নয়।

    শিক্ষকরা কেন শিক্ষার্থী নির্যাতন করেন

    বাংলাদেশে যেকোনো শিক্ষার্থীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন না করার...

    ক্রিয়াপদের অন্তে ‘ও-কার’ দেওয়া নিয়ে হিমশিম

    মোরশেদ হাসান লিখেছেন ক্রিয়াপদের অন্তে ও-কারের ব্যবহার নিয়ে - লিমন...

    লেখাপড়া সমাচার: কোচিং সেন্টার

    কোচিং সেন্টার থেকে যারা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায়, তাদের ভালো করার পেছনে খুব সামান্য কৃতিত্বই থাকে কোচিং সেন্টারের। কারণ, যেখানে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী তাদের পড়ার গতির সাথে তাল ধরেই রাখতে পারে না, সেখানে যারা চান্স পায় তারা যদি সত্যিকারই মেধাবী না হয়ে থাকে তাহলে টিকে থাকা মুশকিল।

    শিশুশিক্ষা, প্রতিযোগিতা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

    আমাদের জীবনধারণের জন্য কোনটি বেশি দরকারি—  সহযোগিতা নাকি প্রতিযোগিতা?...

    শিক্ষা নিয়ে আতঙ্কের বছরে জেএসসি ও জেডিসির ফল

    হরতালের মধ্যে বিগত পরীক্ষার ফলাফলে নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় আমরা বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবার তা উত্তরণের পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু সেটি কী? সেটি কি বেশি নম্বর দিয়ে দেওয়া? না অন্য কিছু?

    বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপক: ডিগ্রি অর্জনের বাস্তবতা, পদন্নোতি ও শিক্ষকদের সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা

    বিভিন্ন সময়ে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি ছাড়া অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ে...

    শিক্ষা ব্যবস্থা বনাম নিয়োগ ব্যবস্থা

    শাহরিয়ার শফিক লিখেছেন নিয়োগ ব্যবস্থা নিয়ে কাউকে যদি জিজ্ঞেস করা...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।