বাড়ি গবেষণা উচ্চশিক্ষায় গবেষণার গুরুত্ব

উচ্চশিক্ষায় গবেষণার গুরুত্ব

গবেষণার গুরুত্ব রয়েছে সবসময়ই; ছবিসূত্র: Leverage Edu
গবেষণার গুরুত্ব রয়েছে সবসময়ই; ছবিসূত্র: Leverage Edu

এম. আমিনুল হক লিখেছেন গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে

শিক্ষাজীবন আমাদের সামাজিক জীবনেরই এক বৃহত্তর ক্ষেত্র। এখানেও রয়েছে বিভিন্ন সমস্যা, প্রতিকুল পরিবেশ। শিক্ষা প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে তিনটি প্রধান স্তর দেখা যায়। প্রথম স্তরের কাজ হলো শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা। শিক্ষার লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য দ্বিতীয় স্তরের কাজ হলো শিক্ষার উপযুক্ত বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতি নির্ধারণ করা। সর্বশেষ এবং তৃতীয় স্তরটির কাজ হলো শিক্ষা প্রচেষ্টার ফলাফল বিচার করা। শিক্ষাকে যতভাগেই ভাগ করা হোক না কেন, সব ভাগেরই প্রধান উদ্দেশ্যে হল এই পরিবর্তশীল সমাজের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নতুন প্রয়োজন মিটানো এবং তার সাথে শিক্ষার্থীকে সেই পরিবর্তিত সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করার যোগ্যতা অর্জনে সাহায্য করা। তাই সমাজের চাহিদা মেটানোর জন্য শিক্ষাকে গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল করতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন রাতারাতি সম্ভবপর নয় এবং সব পরিবর্তন সব সময়ে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এজন্য আমাদের যা করতে হবে তা হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সূচিত করার পূর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যাচাই করা এবং ছোট আকারে তা প্রয়োগ করে দেখা। এ পরিবর্তন শিক্ষার নতুন দিগন্তের জন্য কতটুকু প্রযোজ্য, গ্রহণযোগ্য এবং উপযোগী হবে- তা যাচাই করার পরই বড় পরিসরে তা বাস্তবায়ন করা উচিত।

মানুষের সমাজ জীবন ক্রমেই জটিল হয়ে আসছে। সাথে সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক সমস্যাও। ফলে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর কারণে পৃথিবীর  প্রতিটি দেশে সামাজিক গবেষণার কার্যক্রম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, নৃবিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে গবেষণার নতুন নতুন কলাকৌশল ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে সামাজিক জীবনে নানবিধ সমস্যা বিদ্যমান এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যা সংযোজিত হচ্ছে, সেখানে সামাজিক গবেষণার গুরুত্ব আরো বেশি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার, সামাজিক সমস্যা বর্ণনাকরণ, সামাজিক সমস্যার সমাধান, জাতীয় উন্নয়ন, সামাজিক কল্যাণ বিধান, তত্ত্ব উদ্ভাবন ইত্যাদি কারণে সামাজিক গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি সামাজিক গবেষণা সমাজ জীবনের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত পরিবর্তনশীল সমাজে নতুন নতুন সমস্যা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে সমাজকে কীভাবে সংগঠিত করতে হবে, কীভাবে সর্বাধিক কার্যোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, কীভাবে লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম করতে হবে- এ সংক্রান্ত বিষয়ে পয়োজনীয় কর্মপন্থা ও সুপারিশ সমাজিক গবেষণাই সঠিকভাবে প্রদান করতে পারে। কাজেই সামাজিক গবেষণা কেবল তত্ত্বগত উন্নয়নে নয় বরং সামগ্রিকভাবে সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

শিক্ষাবিজ্ঞান সামাজিক বিজ্ঞানের একটি বিষয়। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন শিক্ষাবিজ্ঞানী এবং চিন্তাবিদগণ শিক্ষা-সংক্রান্ত বিভিন্ন মূল্যবান তথ্য রেখে গেছেন। যেমন, প্লেটো তিন ধরনের শিক্ষাক্রমের কথা বলেছেন, তিন ধরনের স্কুলের কথা বলেছেন। রুশো প্রকৃতিবাদী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একইভাবে পোস্তালাৎসি, হকিট, ফ্লোয়েবেল মন্টেসরি, জন ডিউই, হোয়াইট হেড, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনিষীগণ শিক্ষা সম্পর্কে এবং শিক্ষাদান পদ্ধতির ক্ষেত্রে তাঁদের নিজস্ব দর্শন, মতামত ও মূল্যবান বক্তব্য রেখে গেছেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের এসব মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্যসমূহকে বিশ্লেষণ ও গবেষণার মাধ্যমে সঠিক মূল্যায়ণ করে আমরা বাস্তব জীবনে শিক্ষাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে আমাদের প্রচলিত শিক্ষার বিভিন্ন দিককে আরও উন্নত ও সমৃদ্ধশালী করে তুলতে পারি।

মানব ইতিহাসে শিক্ষাসমৃদ্ধ জ্ঞান আহরণ করার প্রয়াজনীয়তা বর্তমানের মতো অতীতে এতো গভীরভাবে অনুভূত হয়নি। বিগত অর্ধশতাব্দীতে শিক্ষাজগতে যে পরিবর্তন ঘটেছে, সেসবের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে শিক্ষবিদদের পূর্ব ধারণা ছিল না। শিক্ষা-সমস্যা সম্বন্ধে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুষ্ঠ কোনো পদ্ধতিও ছিল না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত শিক্ষাবিদদের ধারণা ছিল না যে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে শিক্ষাসমস্যার সমাধানে প্রয়োগ করা যেতে পারে। আমরা সাধারণত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে বারো ক্লাস বা উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বুঝায়। অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির বিদ্যাপিঠকে উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপিঠ বা বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়ে থাকে।

গবেষণা শব্দটিতে এ পর্যন্ত অসংখ্য অর্থ আরোপিত হয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তি গবেষণা শব্দটিতে বিভিন্ন অর্থের বর্ণনা করলেও তাদের সবার মধ্যে একটা মিল পাওয়া গেছে। সাধারণ অর্থে গবেষণা হল সত্য ও জ্ঞানের অনুসন্ধান। কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক ও সুসংবদ্ধ অনুসন্ধানকে গবেষণা বলা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, গবেষণা হলো বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধানের একটি কলা বা আর্ট। The Advanced Learner Dictionary of Current English পুস্তকে গবেষণাকে বলা হয়েছে জ্ঞানের যে কোনো শাখায় নতুন তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপক ও সযত্ন তথ্যানুসন্ধান। ফলে গবেষণা হলো নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের পদ্ধতিগত ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ ও রেকর্ডকরণ যা সার্বিকীকরণনীতি বা তত্ত্বের বিকাশের দিকে পরিচালিত করে। এসব সার্বিকীকরণনীতি বা তত্ত্ব বহু ঘটনার চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ, যা ভবিষ্যদ্বাণী থেকে উদ্ভুত এবং যা হতে পারে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের কারণ বা পরিণতি। পদার্থবিজ্ঞানের মতো শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে গবেষণার একটি নতুন দিগন্ত উদঘাটিত হয়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সমাজ চিন্তাবিদগণ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় গবেষণাকে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করে শিক্ষাকে বাস্তবমুখী ও যুগোপযোগী করতে সচেষ্ট হন। আধুনিক শিক্ষাকর্মের তত্ত্ব সমস্যা সমাধানের বিভিন্ন পদ্ধতির আবিস্কার হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ জ্ঞানের বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, মনোচিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভন্ন বিষয়ে গবেষণা ও তার ফলাফল থেকে আমরা মানুষের সমস্যার বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে সচেতন হয়েছি এবং এসব সমস্যার সমাধানকল্পে নতুন নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার হয়েছে এবং হচ্ছে।

অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার ভিন্নতার দরুণ শিক্ষার সমস্যাবলীও ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন, পাশ্চাত্যের কোনো উন্নত দেশের শিক্ষাকর্মীরা যে সমস্ত সমস্যার সমাধানে নিয়োজিত আমাদের দেশের সমস্যা তা থেকে অনেকাংশেই পৃথক। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে পারস্পরিক সম্পর্কজনিত, অসামজ্ঞস্যপূর্ণ সমস্যাবলী ও অন্যান্য মানসিক সমস্যা অধিকতর প্রকট। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাবজনিত সমস্যাই অধিকতর তীব্র ও ব্যাপক। এখানে শিক্ষাকর্মী দারিদ্র, অসুস্থতা, অপুষ্টি, শিক্ষা উপকরণের অভাবজনিত সমস্যাবলী নিয়ে অধিকতর ব্যাপৃত। শিক্ষা কল্যাণের প্রয়োজনে তাই শিক্ষাকর্মীকে শিক্ষার্থীদের বিশেষ বিশেষ সংস্কার, মূল্যবোধ, নিয়মকানুন ও তাদের বিশেষ বিশেষ সমস্যার প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে সেসবের সমাধানে সচেষ্ট হতে হয়। বিশেষ শিক্ষার্থীর উপযুক্ত বিশেষ শিক্ষা পরিস্থিতিকে জানবার জন্য তাই গবেষণার প্রয়োজন। শিক্ষাক্রম ও শিক্ষা পরিবর্তনশীল, শিক্ষার পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষার নিয়মকানুন, মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটে। একমাত্র গবেষণালব্ধ জ্ঞানই শিক্ষাকর্মীকে শিক্ষা পরিবর্তন, শিক্ষার গতি ও ধারা সম্বন্ধে সচেতন রাখতে, উপযুক্ত কল্যাণমূলক কর্মসূচী গ্রহণে ও সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে। ব্যক্তিগত বা দলীয় শিক্ষার্থীর অর্থনৈতিক বা সামাজিক সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে বহু গবেষণার পর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে। যেমন, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতি, শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতি, পরীক্ষামূলক পদ্ধতি, পরিকল্পনামূলক পদ্ধতি, প্রশ্ন-উত্তর পদ্ধতি, বক্তৃতামূলক পদ্ধতি, প্রদর্শন পদ্ধতি, আবৃত্তিমূলক পদ্ধতি, আলোচনামূলক পদ্ধতি ইত্যাদি। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের জন্য কোন পদ্ধতিটি অধিকতর উপযুক্ত তা গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়। এছাড়া শিক্ষাকে বাস্তবমুখী, বিজ্ঞানমুখী, শিক্ষার্থীর গ্রহণোপযোগী, মানব কল্যাণোপযোগী, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষা পাঠ্যক্রম প্রণয়নের জন্যও গবেষণার প্রয়োজন। কেবল গবেষণার মাধ্যমেই সুষ্ঠ তত্ত্ব প্রবর্তন করা সম্ভবপর। সামগ্রিকভাবে এও বলা যায় যে, গবেষণার মাধ্যমে সমাজ ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেওয়া যায়। কারণ, জ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গবেষণাকর্ম একটি উল্লেখযোগ্য আসন অধিকার করে আছে। জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গবেষণা চাবিকাঠি স্বরূপ। বর্তমানকালে শিল্প, চিকিৎসা, ভৌত ও রসায়ন বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান এবং সমাজ বিজ্ঞানের উন্নয়নের জন্য গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এদেশে শিক্ষার বিভিন্ন দিকেও অনগ্রসরতা রয়েছে। শিক্ষার প্রশাসনিক অবস্থা, শিক্ষাদান পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণ, বইপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষার্থীর মান নির্ণয়, শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মান নিম্ন হওয়ার কারণ ইত্যাদি প্রশ্নে আরও গুরুত্বারোপ করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষভাবে পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে সময়মতো শক্তি, অর্থ, মেধা ইত্যাদির অযথা অপচয় না ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমাদের দেশে গৃহীত জনশিক্ষা পরিকল্পনা যা গবেষণা ছাড়া, পরীক্ষ-নিরীক্ষা ছাড়া, যাচাই করা ছাড়া, কোনো নমুনা দর্শনের ওপর প্রয়োগ করা ছাড়াই অবৈজ্ঞানিক পন্থায় আমাদের দেশের নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও, অনেক মেধাশক্তির অপচয় হওয়ার পরে তা বিফলে যেতে বাধ্য হয়েছে।

স্বীকৃত সমস্যাও অনেক সময় গবেষণার মাধ্যমে এং সময়ের ব্যবধানে অসত্য হয়ে যায়। শিক্ষা যুগোপযোগী ও গতিশীল, কখনও স্থবির নয়। দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে অহরহ নতুন নতুন জ্ঞানের সাথে মানুষের পরিচয় হচ্ছে। প্রতিনিয়ত দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে যাচ্ছে। তাই ব্যক্তির প্রয়োজনে, সময়ের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তথা মানব কল্যাণের পয়োজনে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তনশীলতা ও গতিশীলতার গুণাবলী থাকা প্রয়োজন। সেকারণেই শিক্ষাক্ষেত্রে ও শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়ের ওপর অবিরত গবেষণার প্রয়োজন। দুঃখের বিষয়, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশসমূহে গবেষণার তেমন ব্যবস্থা নেই। উন্নত দেশসমূহ থেকে আমদানি করা জ্ঞান ও তথ্যের ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয়। বিভিন্ন দেশের সাথে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ভিন্নতার কারণে এসব পদ্ধতি আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজনীয় নাও হতে পারে। তাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে পারি না। অবশ্য কিছু কিছু সত্য আছে যা সর্বত্রই সব সময়ে সমানভাবে পযোজ্য। তাই সময়ের প্রয়োজনেই শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তনশীল ও গতিশীল করা দরকার। সে পরিবর্তনকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হলে প্রয়োজনীয় গবেষণা দরকার। কেনোনা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্যও প্রয়োজন গবেষণা। একটা কথা আছে- ‘কোনো শিক্ষাব্যবস্থাই শিক্ষকের চেয়ে অধিকতর ভালো না’- একথার সার্থকতা আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। শিক্ষক সত্যিই যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থার উর্ধ্বে। কেনোনা শিক্ষাব্যবস্থা যে ধরনেরই হোক না কেন, শিক্ষক আপন নিষ্ঠার দ্বারা সফল শিক্ষাদানে ব্রতী হতে পারেন। আর তাঁরাই নিষ্ঠাবান এবং নিবেদিতপ্রাণ যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থাসংক্রান্ত এবং শিক্ষাদান-সংক্রান্ত সমস্যাবলীর সমাধান সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেন। অর্থাৎ, যাঁরা শিক্ষা গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। এককথায় বলতে গেলে শিক্ষাদানকার্যকে যাঁরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করবেন, তাঁরা সে-সক্রান্ত বহু সমস্যার সম্মুখীন হবেন, আর শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা প্রশাসন বিষয়ে যাঁরা আত্মনিয়োগ করবেন, তাঁরাও সে-সংক্রান্ত বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হবেন। যে শিক্ষক শিক্ষাদান কাজে উদ্ভুত সমস্যা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেন না, তিনি প্রকৃত নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হতে পারেন না। আবার শিক্ষা প্রশাসন-সংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে যিনি গভীরভাবে চিন্তা করেন না, তিনিও প্রকৃত শিক্ষা প্রশাসক বা শিক্ষাবিদ হতে পারেন না। এককথায়, প্রকৃত শিক্ষাবিদ শিক্ষকমাত্রই গবেষক- এ এক গভীর চিন্তা যা এলামেলোভাবে করলে কোনো ফলোদয় হবে না। তার জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত নৈর্ব্যক্তিক ও তথ্যানুসন্ধান প্রক্রিয়া যার নাম গবেষণা।

বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের উন্নত দেশগুলির শিক্ষাব্যবস্থা যতখানি অগ্রসর, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ততখানি অগ্রসর নয়। একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, এসব উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনুকরণ করে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করা আদৌ সম্ভবপর নয়। কেনোনা, আমাদের দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা অথবা ভৌগোলিক অবস্থান কোনোটাই ওসব দেশের সমপর্যায়ভুক্ত নয়। কাজেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কীরকম হওয়া উচিত তা শুধু অনুমান করে বললেই চলবে না। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা কর্মসূচি।

উন্নত দেশগুলো গবেষণার মাধ্যমেই তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নততর করতে সক্ষম হয়েছে। এজন্য আমাদের দেশের উচ্চতর শিক্ষার্থী অর্থাৎ উচ্চতর ক্লাসের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদদের গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। তার পরেও অনেক সমস্যা থেকে যায়। আমাদের সমস্যাগুলো কেবল সংখ্যায় বিপুল বা স্বাতন্ত্র্যে ভিন্নতর নয়। আমাদের সমস্যাগুলো এমন যে এদের দ্বারা শুধু যে আমাদের শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে তা নয়, এগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পাশ্চাতের দিকে টানছে। সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থা দিন দিন পঙ্গুতর হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। আমাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি পর্যাপ্ত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। কেন পারছে না- এ প্রশ্নের কারণ বের করতে হলে এবং নতুন কোনো পদ্ধতি চালু করার পূর্বে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটা নির্ধারণ করার পর বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করা দরকার। কোন অবস্থায় এবং কী ধরনের শিক্ষা অধিকতর ফলপ্রসু হবে সেটাও গবেষণা দ্বারাই নির্ধারিত করা সম্ভব।

১৯৮১ সালে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কর্মঅভিজ্ঞতা নামক একটি কোর্স চালু ছিল, কিন্তু ১৯৮২ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে সিইনএড-কে দুই বছর মেয়াদ এবং উক্ত কোর্সটি ইন্টারমিডিয়েট ডিগ্রির সমতুল্য বলে চালু ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই কোর্সকে পূর্বের পর্যায়ে নেয়া হয়েছে। ১৯৭৯ সালে বিএ ইন এডুকেশন নামে একটি কোর্স চালু ছিল, কিন্তু এটিও বিলুপ্ত হয়। উপর্যুক্ত কোর্সগুলো বিলুপ্ত বা পরিবর্তন হবার পিছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ হচ্ছে কোর্সগুলো চালু করার পূর্বে উপযুক্ত গবেষণা না করেই কোর্স প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই উপযুক্ত গবেষণা ছাড়া হঠাৎ করে জনগণের ওপর কোনো কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কর্মসূচি যদি জনগণের অনূভুত প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে এবং সেই কর্মসূচি গ্রহণে জনগণের মতামতকে যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে উক্ত কর্মসূচিতে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ আশা করা যায়।

দেশে ও বিদেশে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বা এর অনুমোদিত/অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণাকার্য হয়ে থাকে। আর গবেষণার সংখ্যা ও মানের ওপর নির্ভর করেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুনগতমান নির্ভর করে। বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাং কিং করা হয়ে থাকে তা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের মানের ও সংখ্যার ওপর নির্ভর করেই। আমাদের দেশে গবেষণা খুব কম পরিমাণে হয়। গবেষণা বাবদ খুব অল্প পরিমানে অর্থবরাদ্দ দেয়া হয়। আমাদের দেশে গবেষণায় পর্যাপ্ত অর্থ দেয়ার সাথে সাথে গবেষণাকর্মে শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে উৎসাহী করতে হবে। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণালব্ধ ফলাফল বা মতামত বা তত্ত্ব সরকারি উদ্দ্যোগে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। তাহলেই আমাদের দেশ একদিন উন্নত দেশে পরিণত হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় মানে সেখান থেকে পড়াশুনা করে শুধু ডিগ্রি নেয়ার জায়গা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও আহরনের উৎকৃষ্ট জায়গা। এ নতুন জ্ঞানসৃষ্টিকে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না। আমরা জানি, এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষা একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞানের সাধারণ ভিত্তি তৈরি করে। আর উচ্চশিক্ষায় সেই ভিত্তিটাকে অবলম্বন করে উচ্চতর জ্ঞান আহরণের সাথে সাথে গবেষণার মাধ্যমে আরও নতুন নতুন জ্ঞান বা তত্ত্ব আবিস্কারের মাধ্যমে নতুন কিছু দিয়ে দেশ, জাতি তথা পৃথিবীকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ অগ্রগতি একমাত্র গুণগত গবেষণার মাধ্যমেই সম্ভব। ফলে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার গুরুত্ব কতটা তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

এম. আমিনুল হক: প্রভাষক, গণিত, শিবগঞ্জ মহিলা ডিগ্রী কলেজ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

5 মন্তব্য

  1. আমিনুল হক,
    আপনি সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে লিখতে গিয়ে নৈর্ব্যক্তিকতার কথা বলেছেন। নৈর্ব্যক্তিকতা অবাস্তব ধারণা এটা প্রায় ১০০ বছরের পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত মত। এ বিষয়ে আরোও জানতে পজিটিভিস্ট/পজিটিভিজম ও তার সমালোচনা সম্পর্কে পড়ে নিতে পারেন। সাথে ক্রিটিকাল থিওরী বা ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের উদ্ভবের সময়ে তারা এই এই নৈর্ব্যক্তিকতা বা অবজেক্টিভিটি নিয়ে কী বলেছিলো সেটাও দেখতে পারেন। সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণা পদ্ধতির আলোচনায় এগুলো একদম শুরুর দিকেই পড়ানোর কথা।

    • জনাব হাসিব মাহমুদ, আপনার মন্তব্যটি ভালো, কিন্তু এ বিষয়ে কোথা থেকে কী জানা যায় সেটির লিংক দেয়া হলে উপকৃত হতাম। তবে আপনি যেটি বলেছেন, এ ধরনের অ্যাডভান্স বিষয় সম্ভবত বাংলাদেশের অনেকেরই জানা নেই। বাংলাদেশের একটি উপজেলার একজন শিক্ষক গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে লিখছেন, এটা প্রশংসার দাবি রাখে, কারণ এসব বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই লিখেন না। সেখানে আপনার বক্তব্যটি লিংকসহ থাকলে তিনি বোধহয় আরো বেশি উপকৃত হতেন।

  2. অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং বাস্তবতা নিংড়ানো নির্যাস এই লেখাটি । আশা করছি সংশ্লিষ্ট দায়িত্ববানদের নিদ্রা ভাঙ্গবে এবং খুব শীঘ্রই তারা শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version