বাড়িপরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না থাকে এক্সামিনেশন

ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না থাকে এক্সামিনেশন

পরীক্ষাকে ভয় পায় না এমন শিক্ষার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছোটবেলাতে আমরাও ভয় পেতাম। পরীক্ষার আগে আগে অনেককে দেখেছি অসুস্থও হয়ে পড়তে। সাধারণত আমাদের দেশে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বছরে তিনটি করে পরীক্ষা দিতে হয়। এর মাঝে আবার পঞ্চম শ্রেণি, অষ্টম শ্রেণি ও দশম শ্রেণির পর একটি করে পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। এরপর কিছু কলেজের জন্য আছে ভর্তি পরীক্ষা। এসব কিছুর পর একজন শিক্ষার্থী হয়ত কলেজে প্রবেশ করতে পারলেও নিস্তার নেই। কলেজভেদে নানা পরীক্ষা শেষ করে আবারও পাবলিক পরীক্ষা। হয়ত কলেজের পরীক্ষা শেষ করে কোনো শিক্ষার্থী ভাবল, এবার একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক; কিন্তু তার আর জো রইল কই? এরপর আসে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ‘ভর্তি পরীক্ষা’। এই পরীক্ষা অনেকের জীবনের মোড় পাল্টে দিতে পারে, তাই শিক্ষার্থীদের অনেককে দেখা যায় আদাজল খেয়ে লাগতে। একসময় ভর্তি হয় উচ্চ শিক্ষালয়ে। কিন্তু সেখানেও রেহাই নেই। নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর আছে নানা নামে নানা পরীক্ষা। শিক্ষার্থীর পুরো শিক্ষাজীবনে বুঝি আর নিস্তার নেই। এত এত পরীক্ষা, তাও যেন পরীক্ষাভীতি যায় না। তাই অনেকে বলে থাকে- ছাত্রজীবন সুখের জীবন, যদি না থাকে এক্সামিনেশন।

এতক্ষণ যে পরীক্ষাগুলোর কথা বললাম অর্থাৎ আমাদের দেশে পরীক্ষা বলতে যা বোঝায় তা সাধারণত মূল্যায়নের একটি কৌশল। আরও সহজভাবে বলতে গেলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়ন বলতে আমরা সাধারণত লিখিত পরীক্ষাকেই বুঝে থাকি।

শিক্ষা হলো ব্যক্তির আচরণের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন যা জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। ব্যক্তির এই আচরণ ও বিকাশ কতটা কীভাবে সংগঠিত হয় তা জানার জন্য প্রয়োজন হয় মূল্যায়নের। মূল্যায়নের সাহায্যে শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দেশ্য অর্জনে শিক্ষার্থী কতটুকু সফল হয়েছে বুঝতে পারা যায়। মূল্যায়ন শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল ও ত্বরান্বিত করছে। মূল্যায়ন প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে- গাঠনিক ও সামষ্টিক।

যে মূল্যায়ন ব্যবস্থা কোনো কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত চলে এবং অভীক্ষার ফলাফলের ওপর ফলাবর্তনের মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রমকে উন্নত করতে পারে তাই গাঠনিক মূল্যায়ন। গাঠনিক মূল্যায়নের ধরনগুলোর মাঝে আছে শ্রেণির কাজ, শ্রেণিপরীক্ষা, শ্রেণীকক্ষে মৌখিক প্রশ্ন, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, মাসিক পরীক্ষা, ষান্মাসিক পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, বাড়ির কাজ, টার্ম পেপার ইত্যাদি।

আর কোনো কার্যক্রম শেষে কার্যক্রমের সামগ্রিক ফলাফল, এর প্রভাব ও অর্জিত লক্ষ্য মাত্রা নির্ণয়ের জন্য যে মূল্যায়ন করা হয় তাই সামষ্টিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের অভীক্ষার ফলাফলের ওপর ফলাবর্তন প্রদান করা হয় না। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সামষ্টিক মূল্যায়নের তিনটি ধরন দেখা যায়- লিখিত অভীক্ষা (রচনামূলক ও নৈর্ব্যক্তিক), মৌখিক অভীক্ষা (ভাইভা, সাক্ষাৎকার) ও ব্যবহারিক অভীক্ষা।

শিক্ষার্থীরা সাধারণত যে পরীক্ষাগুলোর কথা শুনলে ভয় পায় তা হলো, দুইটি সাময়িক পরীক্ষা এবং একটি বার্ষিক অথবা সমাপনী পরীক্ষা। এই ভয় শুধু যে স্কুল-কলেজে ছিল তাই না, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও দেখতে পাই ইনকোর্সের ভয়ে আমরা ভীত থাকতাম। একটি শিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলছে কিনা, এর উদ্দেশ্য কতটা সফল হলো, তা জানার যখন আরও অনেক ধরন (বাড়ির কাজ, শ্রেণির কাজ, মৌখিক প্রশ্ন-উত্তর, ব্যবহারিক কাজ) আছে; তবে এই পরীক্ষা নামক জুজুর ভয় কেন আমাদের পোহাতে হবে? মূল্যায়নের বেশ কিছু কৌশল আমরা শিক্ষাবিজ্ঞানে দেখতে পাই, যার অনেকগুলোই মজার। যা শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করলে মূল্যায়নের উদ্দেশ্যেও সফল হবে আবার শিক্ষার্থীরাও মজা পাবে।

উদাহরণস্বরূপ, প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য কিছু খেলার কথা বলা যেতে পারে, যার দ্বারা সহজেই কোনো বিষয় সম্পর্কে কতটুকু বুঝতে পারল তা যাচাই করা যায়। বাস্তব কাজের মাধ্যমে দেখা যেতে পারে কতটুকু শিখতে পেরেছে (যেমন, বাজার করতে দিয়ে গণিত শেখার মূল্যায়ন করা)।

আরেকটু বড় শ্রেণিতে বেশি বেশি কুইজ, শ্রেণি পরীক্ষা, বাড়ির কাজ দেয়া, মৌখিক প্রশ্ন করা ইত্যাদির ব্যবস্থা বেশি করা আর সাময়িক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষার ওপর চাপ কমানো।

বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বেশি বেশি উপস্থাপনা, ব্যবহারিক ক্লাশ, অ্যাসাইনমেন্ট, খোলা বই পরীক্ষা, ইন্টার্নির ব্যবস্থা, বাস্তব কাজের সাথে জড়িত করে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা যাতে গতানুগতিক পরীক্ষার সংখ্যা বেশ কমে যায়। এতে যেমন পরীক্ষাভীতি কমবে, সাথে সাথে নানামুখী কাজের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনে চলার পথও মসৃণ করবে।

হয়তো সামনে সেই দিন আসবে যেদিন শিক্ষার্থীদের আর বলতে হবে না, ছাত্রজীবন সুখের জীবন যদি না থাকে এক্সামিনেশন! হয়ত সেই দিনে তারা যে কয়টি পরীক্ষা দিবে, তা আনন্দের সাথেই দিবে- এই আশাটুকুর বাস্তবায়ন দেখতে চাই।

আরও পড়ুন

মতামত

বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা আমাদের সবার জানা। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই যদি গলদপূর্ণ হয়, তাহলে আর কী কথা...

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোঃ তৌফিক ইমাম চৌধুরী লিখেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে একজনকে অনেকগুলো বিষয়ে পড়তে...
নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।

এই বিভাগের আরও লেখা

পাবলিক পরীক্ষার ফল : শিক্ষাব্যবস্থার আতঙ্ক?

‌আল্পনা শিরিন লিখেছেন পাবলিক পরীক্ষার ফল নিয়ে এবছর আমার ছোট বোনের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের...

এসএসসির ফল প্রকাশ : পরিমাণগত ও শিক্ষার মান এক নয়

অপেক্ষার পালা শেষ করে ৩১ মে প্রকাশিত হলো ২০২০ সালের এসএসসি ও সমমানের ফল...

সব শিক্ষার্থীর একসাথে পরীক্ষার ফল প্রকাশ: কতোটুকু নেতিবাচক?

মোঃ শাকিব হাসান শুভ লিখেছেন পরীক্ষার ফল প্রকাশ প্রসঙ্গে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এমনকি উচ্চশিক্ষায় বেশিরভাগ...

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থেকে শিখন চাই, নাকি ফলাফল?

সালাহউদ্দিন সোহাগ লিখেছেন প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা প্রসঙ্গে ১৭ নভেম্বর ২০১৯ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী...

পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে আরও গভীর ভাবনার প্রয়োজন

এসএসসি ও এইচএসসি পাবলিক পরীক্ষা দুটোতে দশ-বারোটি করে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। এতো বিস্তৃত...

বোর্ড পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কতোটা যথাযথ

বোর্ড পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে? রাজধানীর মতিঝিল মডেল আইডিয়াল স্কুল ও...

সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি কি সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক?

মোঃ ইব্রাহিম খলিল সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে ওপর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যতো বেশি আলোকপাত করা হয়েছে...

সুনাগরিক সৃষ্টিতে প্রয়োজন অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ

একজন কোমলমতি শিশু, যার প্রথম বিদ্যালয়ে যাওয়ার গল্পটি শুরু হয় প্রহসন দিয়ে, তাকে নিয়েই...