আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর সব কিছুই পূর্ব-পরিকল্পিত এবং বিন্যাসিত। আর এই পূর্ব-পরিকল্পিত ও বিন্যাসিত যে ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট থাকে, আধুনিককালে তাকে বলা হয় শিক্ষাক্রম। শিক্ষাক্রমেই মূলত সবকিছুর উল্লেখ থাকে। নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি ও মূল্যায়নের সময় এগুলোর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কাকে, কখন, কোন জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা, কীভাবে, কোন উপকরণ ব্যবহার করা হবে এবং এর মূল্যায়ন কীভাবে হবে এসবের বিস্তারিত বিবরণই শিক্ষাক্রম। আর দেশে দেশে শিক্ষাক্রম তৈরির ভিত্তি এবং উদ্দেশ্যও ভিন্ন। কেনোনা জাতিতে জাতিতে রয়েছে ভিন্নতা। তাই তাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়বস্তুতেও ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক।
একটি সমাজ, দেশ কিংবা জাতির পরিপূর্ণ বিকাশের মূলে থাকে তাঁর সংস্কৃতির বিকাশ। নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ ছাড়া একটি সমৃদ্ধ জাতি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র বিনির্মাণ কি সম্ভব? অন্যদিকে আধুনিক জীবনব্যবস্থায় শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির উন্নতি কল্পনা করা যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশের মানুষের জীবন, জীবিকা, সংগ্রাম, টিকে থাকা, উৎপাদন, বিপণন, ভাষা, পোষাক, উৎসব-অনুষ্ঠানাদি, ধর্মীয় মূল্যবোধ, আচার, প্রথা, বৈচিত্র্য ও প্রকৃতির সমন্বয়ে যে সংস্কৃতি, তাকে বাদ দিয়ে কি সেই জাতি উন্নত বা সম্মৃদ্ধ দেশ কিংবা সমাজের আসনে আরোহণ করতে পারে? যে জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে না, সেই জাতির কোনোদিন সমৃদ্ধির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করতে পারার কথা নয়।
একটি দেশ বা সমাজে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন। সবার সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজে আসে সমৃদ্ধি। সময়ের সাথে সাথে বিশ্ব বদলাচ্ছে। উন্নততর হচ্ছে এর প্রযুক্তি। বিশ্ব আজ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এ কথা সত্য। আগামীতে টিকে থাকতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে দক্ষ লোকবলের প্রয়োজন এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই; কিন্তু রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য কি শুধু বিশ্ব শ্রমবাজারের যোগ্য দক্ষ শ্রমিকনির্ভর সমাজই যথেষ্ট? দার্শনিক ছাড়া সমাজ হয় কি? ইতিহাস চেতনা ছাড়া কি রাষ্ট্রের ভিত্তি শক্ত হতে পারে? রাষ্ট্র গঠন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছাড়া কি সম্ভব? সমাজবিজ্ঞানের আলো ছাড়া কি একটি সমাজের গঠন বিচার করা সম্ভব? প্রযুক্তিগত দক্ষ লোকবলের পাশাপাশি দর্শন, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ অপরাপর বিষয়গুলোতে জ্ঞান এবং দক্ষতার সমান গুরুত্ব রয়েছে একটি সমাজ বিকাশের জন্য।
১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, সেই রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল মন্ত্র ছিলো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তি লাভ। দেশ ঠিকই স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু এখনো এ-দেশের মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিপূর্ণ স্বাধীনতা আসেনি। এর পিছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। আছেও নিশ্চয়। কিন্তু জাতিগঠনের মূল হাতিয়ার; সেই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গলদ থেকে যাচ্ছে বার বার।
স্বাধীনতা-উত্তর দেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন হয়েছে। একাধিকবার পরিবর্তন হয়েছে শিক্ষাক্রম। সর্বশেষ ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১২ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষাক্রমের আমূল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।
প্রস্তাবিত এই নতুন শিক্ষাক্রমের অনেক ভালো দিক আছে। যেমন, এখানে শিক্ষার্থীদের শিখন মূল্যায়নে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আরও একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন হচ্ছে প্রাক-প্রাাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর জন্য একমুখী পাঠের ব্যবস্থা।
প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে— সেসব কথাও উঠে আসছে অনেকের আলোচনায়। যেমন, যাঁদের হাত দিয়ে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হবে, সেই শিক্ষকদের যোগ্যতা এবং শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব দেখা যাচ্ছে এই শিক্ষাক্রম পরিকল্পনায়। কিন্তু এসবের বাইরে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এই শিক্ষাক্রমে। সেগুলো হলো একটি সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, দর্শন এবং সংস্কৃতিকে পাশ কাটিয়ে চতৃর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলায় যোগ্যতাভিত্তিক কারিগরি দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে নতুন এই শিক্ষাক্রমে।
হাজার বছরে যে বাঙালি সংস্কৃতি, সেই ইতিহাসকে উপেক্ষা করে এ জাতি কি সম্মানের সাথে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? যে সমাজ বা জাতি তার ঐতিহ্যকে লালন করে না, সেই সমাজ কখনো উন্নত ও সম্মৃদ্ধ সমাজ হতে পারে না। অর্থনৈতিক উন্নতিই সব কিছু নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল মন্ত্রণাগুলোর একটি হলো মানবিক মর্যাদাবোধ। দর্শন, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মতো বিষয়গুলো উপেক্ষা করে বা কম গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতানার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব?
প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে পাঁচটি ভিত্তির ওপর ভর করে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে, তার প্রথম ভিত্তি হলো দার্শনিক ভিত্তি। এই দার্শনিক ভিত্তি নির্ধারণে আবার অপর চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো, অপরিবর্তনশীলতা বা অবিনশ্বরবাদ, অপরিহার্যতাবাদ, প্রগতিশীলতাবাদ এবং পুনর্গঠনবাদ।
প্রশ্ন হলো, যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হলো, সেই ভিত্তি কোথায় গেলো? যেহেতু বিশ্ব শ্রমবাজার বা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সে-কারণে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে উল্লিখিত দশটি শিখন ক্ষেত্রের মধ্যে ইতিহাস, ভূগোল কিংবা যুক্তিবিদ্যার স্থান স্বতন্ত্রভাবে হয়নি। একটি সমাজ তার ইতিহাস, ভূগোলচর্চা বাদ দিয়ে বিশ্ব সমাজের অংশ হবে কীভাবে?
অন্যদিকে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিষয়টি পৃথকভাবে উল্লেখ করা হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নৈতিক শিক্ষার নামে ধর্মশিক্ষা যুক্ত করা হয়েছে। মূলত এখানে ধর্মীয় জ্ঞান, বিধিবিধান এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মূল্যবোধ ও নৈতিকতা বিষয়টি কি শুধূ ধর্মীয় শিক্ষায় অর্জন সম্ভব? ধর্মীয় জ্ঞান, বিধিবিধান ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন ও নৈতিক মানুষ গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখলেও জাগতিক সমাজে নৈতিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরিতে সহায়তা করার জন্য ধর্মশিক্ষার বাইরেও নৈতিকতা বিষয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনা করা প্রয়োজন।
নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির সময় দশটি শিখন ক্ষেত্রের মধ্যে প্রাথমিক স্তরের জন্য মোট আটটি (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, ভালো থাকা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) বিষয় পাঠ্য হিসেবে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির জন্য প্রাথমিকের আটটি বিষয়ের সাথে দুটি (জীবন ও জীবিকা এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি) বিষয় যুক্ত করে মোট দশটি বিষয় পাঠ্য রাখা হয়েছে।
এক্ষেত্রে ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি, ব্যবসায় শিক্ষা, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলো কোন যুক্তিতে উপেক্ষা করা হয়েছে? পৃথক জ্ঞানকাণ্ড হিসেবে এসব বিষয়ের গুরুত্ব কি ফুরিয়ে গেছে বিশ্ব থেকে? ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভূগোলের জ্ঞান ছাড়া বিশ্ব নাগরিক হওয়া কীভাবে সম্ভব? নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে এ সব বিষয় নিয়ে আরও ভাববার অবকাশ রয়েছে।
লেখক পরিচিতি
মো. সাইফুজ্জামান বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে লেখালেখি করেন।
Visitor Rating: 5 Stars
Visitor Rating: 3 Stars
Visitor Rating: 1 Stars
Visitor Rating: 4 Stars