কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি বলেন, তার লেকচার নিয়ে কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি নেই তবে তিনি মিথ্যে বলছেন। এরকমই এক সময়ে আমার মনে হয়েছে, আমি আমার শিক্ষার্থীদের হয়তো পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছি। বিস্মৃতিতে যারা তখনও তলিয়ে যায়নি, তারাও কৌতুহলশূন্য ও নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই ব্যর্থতা কাটাতে আমি আশ্রয় নেই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের। এতো দিন পরও আমি এখনও আমার শিক্ষার্থীদের ওভারহেড থেকে বুলেট পয়েন্টগুলো পড়ানোর সেই জোরালো কণ্ঠস্বর শুনতে পাই এবং সেগুলো তাদের কাছে পড়ানোর দৃশ্যগুলো চোখে ভাসে।
সৌভাগ্যবশত, আমার এরকম পাঠদান সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা কী ভাবতো তার কিছুই আমি মনে করতে পারছি না। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, আমি নিজেই নিজেকে একঘেয়েমীপূর্ণ করে তুলছি, তখন সেটি নিজের কাছেই বেদনাদায়ক ছিলো। এরকম উপলব্ধি যখন আসে, তখন বুঝতে হবে নিজেকে পরিবর্তন করার সময় হয়েছে। আর এ কারণেই লেকচার দেওয়ার জন্য পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেই।
একটি লেকচার শিক্ষার্ত্থীদের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপিত হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। যেমন, অপরিকল্পিত কোর্স, অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি, লেকচারের দিনে অনুপ্রেরণাহীন মনে হওয়া, নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী, ভীড় ও কোলাহল, অপরিকল্পিতভাবে সাজানো ক্লাসরুম ইত্যাদি। এই বিপর্যয়ের তালিকাতে এক সময়ে আসে পাওয়ারপয়েন্ট।
শিক্ষার্থীরা যখন সাথে সাথেই দেখতে পায় তার শিক্ষক কী কী বিষয়ে কতটুকু কথা বলবে, তখন শিক্ষককেও প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। অন্যদিকে প্রতিটি স্লাইড দেখার পর শিক্ষার্থীরা লেকচারের চেয়ে বেশি স্লাইডে মনোযোগ দেয় এবং আরও আকর্ষনীয় স্লাইডের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
শিক্ষার্থীদের সরাসরি লেকচার দেওয়া হলো একটি মিশ্র ও জটিল প্রক্রিয়া, যেখানে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পাঠ্যবিষয়, তাত্ত্বিক সমস্যাসহ শিক্ষন-শিখন কার্যক্রমের যাবতীয় উপাদান পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এই যোগাযোগ সীমিত করে লেকচারকে সংকীর্ণ করে তোলে। ফলে পুরো ব্যাপারটি এমন হয় যেখানে শিক্ষকের নিজস্ব প্রস্তুতি ছাড়া অন্য কোনো উপাদান কাজ করে না। শিক্ষার্থীদের সক্রিয়তা, প্রশ্ন করার প্রবণতা, সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ কমে আসে।
এই বিষয়গুলোই ক্রমান্বয়ে প্রেজেন্টেশনকে একঘেয়েমী করে তোলে। শিক্ষার্থীরা যখন সাথে সাথেই দেখতে পায় তার শিক্ষক কী কী বিষয়ে কতটুকু কথা বলবে, তখন শিক্ষককেও প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হয়। অন্যদিকে প্রতিটি স্লাইড দেখার পর শিক্ষার্থীরা লেকচারের চেয়ে বেশি স্লাইডে মনোযোগ দেয় এবং আরও আকর্ষনীয় স্লাইডের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষকদের জন্য নয়
কোনো বক্তব্যকে আকর্ষণীয় ও প্রাসঙ্গিক করতে হলে শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা ও পরীক্ষা বা অনুসন্ধান করা, তাদের সমাধান ও ফলাফল দেওয়া নয়। দুর্ভাগ্যবশত, ফলাফল ও সমাধান উপস্থাপনের জন্যই পাওয়ারপয়েন্ট তৈরি। মূলত ম্যাকিন্টোশের জন্য তৈরি হলেও মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট বাজারে নিয়ে আসে। বাজারে আসার পর সফটওয়্যারটি পেশাদার ব্যবসায়ীদের নজরে পড়ে, বিশেষত কনসালটেন্ট এবং ব্যস্ত বিক্রয়কর্মীদের।
কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে সাধারণত কর্পোরেশন অফিসগুলো পাওয়ারপয়েন্ট বেশি করে ব্যবহার শুরু করে; কারণ মাইক্রোসফট অফিস প্যাকেজের অংশ হওয়ার পর পাওয়ারপয়েন্টের সাহায্যে সারসংক্ষেপ, এক লাইনের বর্ণনা, সর্বত্র প্রদানযোগ্য, কার্যপরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সহজেই ব্যাখ্যা করা যেতো। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকদের ওপর শিক্ষকতার চাপও বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে কাজ সহজ করতে শিক্ষকদের মাঝে পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আর এটিই পাওয়ারপয়েন্টকে এ্যাকাডেমিয়াতে স্থান করে নিতে সাহায্য করে। পাশাপাশি জ্ঞানের সাগরে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থী, কঠোর দিকনির্দেশনা পাওয়ার জন্য তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদাও ছিলো।
কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, পাওয়ারপয়েন্ট এ্যাকাডেমিয়াকে সমৃদ্ধ করতে পারেনি। এখানে মূল সমস্যা ছিল, পাওয়ারপয়েন্টে পয়েন্ট করে নেওয়া লেকচারগুলো। কারণ শিক্ষকের কাজ শুধু শিক্ষার্থীদের এসব বুলেটপয়েন্ট বুঝানো নয়; বরং শিক্ষকের উচিৎ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি। এ-ধরনের শিখন প্রক্রিয়া শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ। তাই সময় বাঁচাতে ও কাজ সহজ করতে শিক্ষকরা পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করতে থাকেন। তবে কাজ সহজ করলেও পাওয়ারপয়েন্ট বোকামিও তৈরি করে। হয়তো এ-কারণেই অনেকে, যেমন আমেরিকান পরিসংখ্যানবিদ এডওয়ার্ড টাফ্ট পাওয়ারপয়েন্টকে ক্ষতিকর বলেছেন।
অবশ্যই Prezi, SlideRocket বা Impress-এর মতো নতুন প্রেজেন্টেশন টেকনোলজি ডিজিটাল প্রেজেন্টেশনের জগতে অনেক নতুন কৌশল ও থ্রিডি এ্যানিমেশন যুক্ত করেছে। তবুও আমি বলবো, এগুলো বিষয়টিকে আরও খারাপ করে তুলছে। শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময়ে তাদের মাঝে কৌতুহল তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় পাওয়ারপয়েন্টের বুলেট পয়েন্টগুলো কোনোভাবে সাহায্য করেনা। সত্যি কথা হচ্ছে, পাওয়ারপয়েন্ট অনুসরণ করা কঠিন। একটি তর্কযোগ্য বিষয়বস্তু এই ধরনের কোনো অদ্ভুত উপায় দ্বারা প্রাসঙ্গিক করা যায় না। আপনি যদি কোনো পয়েন্ট মিস করেন, তাহলে অনেক কিছুই হারাবেন।
এর সাথে আবার সংযুক্ত হয়, সেই বুলেটপয়েন্ট গুলোর বিস্তারিততে কী আছে তা মনে রাখা। আমার লেকচারে যে কথাগুলো স্লাইডে লেখা থাকে সেগুলো আসলে আমার ব্যক্তিগত এবং বেশিরভাগ সময়ে আমার চিন্তাগুলোই তাড়াহুড়ো করে লেখা। আমার অন্যান্য প্রকাশিত বা লিখিত কাজের মত আমার পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড গুলোকে কেউ কখনো দেখেনি বা সমালোচনা করেনি। অথচ শিক্ষার্থীরা সেগুলোকেই প্রমাণ হিসেবে ধরে নেয়। অনেক সময়ে দেখা গেছে তারা কোর্সের মূল বর্ণনা না পড়ে, নিজেকে থেকে নতুন কিছু চেষ্টা না করে স্লাইডের পয়েন্টগুলোই তাদের অ্যাসাইনমেন্টে হুবহু তুলে দিয়েছে।
পাওয়ারপয়েন্ট থেকে মুক্তি
কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুলের দর্শন ও ব্যবসায় শিক্ষার মাস্টার্স প্রোগ্রামে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সফলভাবে নিষিদ্ধের পর সম্প্রতি আমরা শিক্ষকদের পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহারও নিষিদ্ধ করেছি। এক্ষেত্রে আমরা আমেরিকান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছি। তাদের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হার্বার্ট ম্যাকমাস্টার পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন কারণ এটি সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্বল ভূমিকা পালন করে। এই সিদ্ধান্তের সাথে আমরা একমত না হয়ে পারিনি। যদিও ছবি, ভিডিও বা কোনো লেখকের উদ্ধৃতি দেখানোর জন্য শিক্ষকদেরকে এটি ব্যবহার করতে দেওয়া হয়।
পাওয়ারপয়েন্ট ছেড়ে এখন শিক্ষকরা ব্ল্যাকবোর্ডে চক বা হোয়াইট বোর্ডে মার্কার কলম দিয়ে লেখেন। পাওয়ারপয়েন্টের সাহায্যে যা করা যেতো, তার চেয়েও অনেক সক্রিয় কার্যক্রম এখন করা যায়। যেমন, আমরা যে পয়েন্ট বা বিষয় সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে আসি, সেগুলোর সাথে শিক্ষার্থীদের পয়েন্ট বা মতামতের সংযোগ ঘটানো যায়। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই অবশ্য এখনও মাইক্রোসফটের একচেটিয়া ব্যবস্থাকে সমর্থন দিচ্ছে প্রজেক্টর ও পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে।
পাওয়ারপয়েন্ট ছেড়ে এখন শিক্ষকরা ব্ল্যাকবোর্ডে চক বা হোয়াইট বোর্ডে মার্কার কলম দিয়ে লেখেন। পাওয়ারপয়েন্টের সাহায্যে যা করা যেতো, তার চেয়েও অনেক সক্রিয় কার্যক্রম এখন করা যায়।
পাওয়ারপয়েন্টের অস্বস্তিকর বোঝা শিক্ষকদের ওপর থেকে নেমেছে ঠিকই, একই সাথে তাদের পরিকল্পনার দিকে চাহিদাও অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা আমাদের মাস্টার্স প্রোগ্রামে লেকচারের প্রতিটি মুহূর্তে কী কী ঘটতে পারে তা আমরা শিক্ষক হিসেবে সেই বিষয়ে পরিষ্কার পরিকল্পনা রাখি, কিন্তু মূল বিষয়বস্তু প্রয়োজনানুসারে বদলে যাওয়া উচিত ও উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের নাম দৃশ্যমান রাখার ব্যবস্থা করেছি এবং শিক্ষার্থীরা প্রথম ক্লাসেই নিজেকে সবার সামনে পরিচয় ও উপস্থাপন করেছে। এভাবে তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় শিক্ষার্থীও তাদের ধারণা প্রকাশ করতে পারে এবং শিক্ষার্থী ব্ল্যাকবোর্ডে এসে উত্তর দিতে পারে অথবা নিজ জায়গায় বসেও দিতে পারে।
প্রচলিত পদ্ধতিতে আমি যখন পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করতাম, তখন শিক্ষার্থীরা লেকচারের পূর্বেই পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড না পাওয়ার অভিযোগ করতো। কিন্তু এখন তারা পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড না থাকা নিয়ে মোটেই কোনো অভিযোগ করে না। তারা শুধু ব্ল্যাকবোর্ডে আমার আরও ভালো করার দাবি করে। তারা আসলে ঠিক, কিন্তু পাওয়ারপয়েন্টের বাধাধরা প্রেজেন্টেশনের তুলনায় ব্ল্যাকবোর্ডে কাজ প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে উন্নত করা সম্ভব।
নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে এখন পাওয়ারপয়েন্টে আকর্ষণীয় স্লাইডের প্রলোভন নেই। শিক্ষার্থীরা এখন শিক্ষকের ওপর আগের চেয়ে বেশি নির্ভরশীল। এটি মনে হয় পাওয়ারপয়েন্ট নিষিদ্ধের অন্যতম অর্জন।
মূল লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে দ্যা কনভারসেশন ওয়েবসাইটে। লেখকের অনুমতিক্রমে বাংলাদেশের শিক্ষা ওয়েবসাইটে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে।
মূল লেখক বেন মেয়ার সোরেনসেন: অধ্যাপক, দর্শন ও বাণিজ্য, কোপেনহেগেন, ডেনমার্ক।
লেখক পরিচিতি
হিয়া মুবাশ্বিরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।