‘শিক্ষাবিজ্ঞান’ জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। শিক্ষাবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রকেন্দ্রিক ব্যাপক অনুশীলন ও গবেষণা চলছে বর্তমান বিশ্বে। প্রতিটি দেশে এ্যাকাডেমিক অঙ্গনে ঘটছে শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রসার। শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে অনেক শিক্ষার সংজ্ঞা তৈরি হচ্ছে।
আলোচ্য বিষয়সমূহ
শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রথম ক্লাস করি, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়র সাবেক পরিচালক বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিজ্ঞানী, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান স্যারের কাছে।
শিক্ষার নানা সংজ্ঞা নিয়ে ক্লাসে স্যারের বিস্তর আলোচনার মাঝে একটি সংজ্ঞা আমাদের মাথায় আটকে যায়- “শিক্ষা হলো মানুষের আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তন, যা সমাজ কর্তৃক আকাঙ্ক্ষিত।”
সংজ্ঞাটি অল্পকথার ও সহজ। কোনো এক পরীক্ষার আগে স্যারের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সহজ এই সংজ্ঞাটির বাইরে আর কোনো গ্রন্থ থেকে একটু কঠিন সংজ্ঞা পেতে পারি কিনা। স্যার কয়েকটি গ্রন্থের খোঁজ দিয়েছিলেন বৈকি। তবে প্রথমেই বলেছিলেন, “সহজ সংজ্ঞা সহজ কি?”
এরপর থেকে শিক্ষার সহজ এই সংজ্ঞাটি বিন্দুতে সিন্ধুর মতো প্রতিদিন নতুন নতুন গভীরতায় আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। বর্তমান নিবন্ধটি শিক্ষার সহজ এই সংজ্ঞাটির ঘনত্ব তালাশ করবার একটি কোশেশমাত্র। নিবন্ধটিতে আলোচনার ডালপালা বিস্তার করবে প্রধানত ‘মানুষ’, ‘আচরণ’ ও ‘সমাজ’ প্রত্যয়ত্রয়ীর পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে।
সংজ্ঞাটিতে প্রথমেই ‘মানুষ’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। মানুষ ভিন্ন অন্য কোনো প্রাণীর কথা বলা হয়নি। সাধারণ প্রাণীর আচরণের পরিবর্তনকে শিক্ষা বলা যায় না; বরঞ্চ এটি প্রশিক্ষণ কিংবা বিবর্তনের ধারায় পরিবর্তন। সাধারণ প্রাণীরা সক্রিয় চিন্তা থেকে আচরণে পরিবর্তন ঘটায় না।
অপরদিকে মানুষের চিন্তা সক্রিয়। বিবর্তনের ধারায় মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটে। মানুষ একইসাথে সক্রিয় চিন্তার কারণে যুগের হুজুগকে বদলে ফেলে নতুন ইতিহাস বিনির্মাণ করে।
কার্ল মার্ক্স তাঁর ক্যাপিটাল গ্রন্থে দেখিয়েছেন, মানুষ ইতিহাসের সন্তান। অন্যদিকে, মানুষের ইতিহাসও তার নিজেরই হাতের বুনন।
জার্মান ভাববাদী দার্শনিক ফ্রেডারিক হেগেলের উপপাদ্য ছিলো, মানুষের বাস্তবজীবন বদলাচ্ছে কোনো ‘চিরন্তন চিন্তা’র ইঙ্গিতে। হেগেল বললেন, ‘চিরন্তন চিন্তা’ থাকে বাস্তবের ক্রোড়ে; আবার শক্তি সঞ্চারিত করে বাস্তবের কোষে। মানুষের সক্রিয় সত্তা মুখ্য নয় হেগেলের দরবারে।
মার্ক্স হেগেলের ‘চিরন্তন চিন্তা’কে একটু উল্টে দিলেন। তিনি দেখালেন, হেগেলের ‘চিরন্তন চিন্তা’ বস্তুত মানুষেরই ক্রিয়াশীলতা, মানুষই প্রযোজক। মানুষের প্রযোজনা নিয়ত গড়ছে, ভাঙছে, নতুন রূপ নিচ্ছে। যিনি গৎবাঁধা লাইনের চিন্তাকে চূড়ান্ত বলে অলিন্দে আগলে ধরতে চান, তাঁর পরিবর্তন শিক্ষা নয়। বরং যিনি পরিবর্তনের নিয়মকে সত্য জ্ঞান করে নয়া যুক্তিকে বিবেচনা করেন, তাঁর পরিবর্তনই শিক্ষা (আচার্য, ১৯৮৭, পৃ. ১১২-১২২)।
ঠিক এই মোড় থেকে শুরু হয় গৎবাঁধা পেডাগজি আর ক্রিটিকাল পেডাগজির পাঞ্জা। ক্রিটিকাল পেডাগজি বা ক্রিটিকাল শিক্ষণবিদ্যার ধারণা আমাদের সামনে নিয়ে আসেন ব্রাজিলীয় তাত্ত্বিক পাওলো ফ্রেইরে।
ক্রিটিকাল পেডাগজি মানুষের সক্রিয়তাকে তার অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে বিবেচনা করে এবং সেই মোতাবেক শিক্ষাকাঠামো তৈরি করে। গৎবাঁধা পেডাগজি এই সম্পর্ক বুঝতে অক্ষম। মানুষের সক্রিয়তাকে বাঁধা-গৎ সাধারণ যৌক্তিক সমীকরণে খাপের খাপ বসিয়ে দিতে চায়।
ক্রিটিকাল পেডাগজি মানুষের সক্রিয়তাকে তার অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, উৎপাদন সম্পর্কের ভিত্তিতে বিবেচনা করে এবং সেই মোতাবেক শিক্ষাকাঠামো তৈরি করে। গৎবাঁধা পেডাগজি এই সম্পর্ক বুঝতে অক্ষম। মানুষের সক্রিয়তাকে বাঁধা-গৎ সাধারণ যৌক্তিক সমীকরণে খাপের খাপ বসিয়ে দিতে চায়।
গৎবাঁধা পেডাগজি ও ক্রিটিকাল পেডাগজি উভয় ক্ষেত্রে মানুষ প্রচলিত শিক্ষা, সমাজকাঠামো, সংস্কৃতির ধারা ইত্যাদিকে বিশ্লেষণ করে ঠিকই। ক্রিটিকাল পেডাগজি একটি বিষয় মাথায় রেখেই তা বিশ্লেষণ করে- শিক্ষা ও সমাজকাঠামোর রূপান্তর ঘটানো (ঋড়ষবু, গড়ৎৎরং, এড়ঁহধৎর ধহফ ডরষংড়হ, ২০১৫, ঢ়. ১১৩)।
আচরণ কী? সোজা কথায়, অভিজ্ঞতা ও অনুশীলনের সংমিশ্রণ-আচরণ। অভিজ্ঞতা ও অনুশীলন পুষ্ট হয় জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে (মালেক, বেগম, ইসলাম, রিয়াদ, ২০০৭, পৃ. ৫)।
অভিজ্ঞতা, অনুশীলন, জ্ঞান, দৃষ্টিভঙ্গি সবটা মিলে যে চেহারায় প্রকাশিত হয়, তাকে আমরা সংস্কৃতি বলি। সংস্কৃতি সামাজিক সৃজন। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের ব্যক্তিগত ও যৌথ ক্রিয়া-কান্ডের ফলে এর উন্মেষ (করিম, ২০০৬, পৃ. ১১৯)।
দ্বান্দ্বিকতার নিয়মে নিয়ত পরিবর্তনশীল সংস্কৃতি হল মানবমনের প্রত্যক্ষ প্রকাশ। এটি বিকশিত হয় শিল্প-সাহিত্যে, শিক্ষায়, আচরণে, দৃষ্টিভঙ্গিতে। সংস্কৃতির এমন নূতন মালমশলা সমাজদেহে প্রাণসঞ্চার করে নিত্য।
আহমদ শরীফ সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছেন: “সংস্কৃতি বদ্ধকুপের জিয়েল মাছ নয়, সংস্কৃতি নদীর প্রবহমান স্রোতের মতো প্রতি মুহূর্তে প্রাত্যহিক জীবনের ও সমাজের অভিব্যক্তি। ‘সংস্কৃতি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ পরিমার্জনা, উৎকর্ষ, পরিশীলন প্রভৃতি। ‘সংস্কৃতি’ অর্থে তাই শুভের-কল্যাণের ও সুন্দরের সাধনা ও প্রতিষ্ঠা বোঝায়” (শরীফ, ২০০৯ক, পৃ. ৭৬, ৭৭)।
সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ মানেই মঙ্গলকামী। একজন সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে নিপীড়ক না হয়ে সমাজের সবার সঙ্গে সমস্বার্থের পাটাতনে অবস্থান করেন। তিনি সর্বপ্রকার পীড়ন-বিরোধী এবং পীড়িতের বন্ধু। তিনি মনে ও আচরণে স্বাধীন।
সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ মানেই মঙ্গলকামী। একজন সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে নিপীড়ক না হয়ে সমাজের সবার সঙ্গে সমস্বার্থের পাটাতনে অবস্থান করেন। তিনি সর্বপ্রকার পীড়ন-বিরোধী এবং পীড়িতের বন্ধু। তিনি মনে ও আচরণে স্বাধীন। তাঁর চিন্তা-চেতনার জগতে দেশ-কাল-মানুষের প্রয়োজন ও কল্যাণকামিতা থাকলেও রাষ্ট্রত্রাসন ও অপবাদ তাঁকে সহজে কমজোর করতে পারে না (শরীফ, ২০০৯খ, পৃ. ৭৬, ৭৭)।
সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ তাই ক্রিটিকাল এবং তিনি ভবিষ্যতমুখী, অতীতমুখী নন। ফলে আচরণের পরিবর্তন মানে সংস্কৃতিবোধের পরিবর্তন, সংস্কৃতি চেতনার উন্নয়ন।
শিক্ষার সংজ্ঞা সমুদয় বাহাস সমাজকে কেন্দ্র করে কেন কিংবা কেন রাষ্ট্রকে নামঞ্জুর করা হলো, রাষ্ট্র ও সমাজ কি একই দ্যোতনা তৈরি করে, সমাজের আকাক্সক্ষাই বা কী- সওয়ালগুলো বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।
সাধারণ সংজ্ঞায় নির্দিষ্ট জনসংখ্যা, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, পূর্ণাঙ্গ সরকার ও সার্বভৌমত্বই হল রাষ্ট্রের মূল উপাদান (রশীদ, ২০১২ক, পৃ. ৩৪৩)। সমাজের উপাদান পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সমিতি ইত্যাদি রাষ্ট্র থেকে জন্মলাভও করেনি বা কোনোরূপ প্রেরণাও পায় নি। তেমনি রয়েছে প্রথা বা সামাজিক নিয়ম-পদ্ধতি, যা রাষ্ট্র কোনদিন সৃষ্টি করেনি। তথাপি রাষ্ট্র তাদের সংরক্ষণ বা পরিবর্ধন করতে পারে (ম্যাকাইভার, ১৯৭৭ক, পৃ: ২)।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি আপনা থেকে ঘটেনি। স্বর্গীয় তত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় রাষ্ট্রের উৎপত্তি। রুশোর সামাজিক চুক্তি তত্ত্ব অনুযায়ী প্রথমদিকে মানুষ ছিল স্বাধীন ও বাধামুক্ত; পরবর্তীকালে তারা নিজেরা নিজেদের সুবিধার জন্যই স্বেচ্ছায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
মার্ক্সীয় তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র হল শ্রেণিবিভক্ত সমাজে এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিসমূহকে উৎপীড়নের যন্ত্র (রশীদ, ২০১২খ, পৃ. ৩৪৩)। বস্তুত রাষ্ট্র অবস্থান করে সমাজের মধ্যে, যদিও তা সমাজের স্বরূপ নয় (ম্যাকাইভার, ১৯৭৭খ, পৃ. ২)। রাষ্ট্রের উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে যে, সমাজটি সমাধানের অসাধ্য এক অন্তর্দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। সমাজ থেকে উদ্ভুত হয়ে রাষ্ট্র সমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে (লেনিন, ১৯৯০, পৃ. ৬)।
বার্ট্রান্ড রাসেল মনে করেন, রাষ্ট্রের প্রধান কাজ-সমাজে অচলায়তন বজায় রাখা। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রই চায় নতজানু নাগরিক। যারা রাষ্ট্রে অচলায়তন বজায় রাখবে। আবার এই রাষ্ট্রই অতীতের যত চিন্তানায়কের মর্যাদা দিয়ে থাকেন, তাদেরই পুনরুত্থান ঠেকানোর জন্য সম্ভব সকল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন (রাসেল, ১৯৯৭ক, পৃ. ৪)। )।
রাসেল দেখলেন, রাষ্ট্র একারণে তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করে। প্রথমত, নৈতিক মিথ্যাচার-শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্র্যের বিদ্যমান ধনবৈষম্য যে অন্যায় নয় তা গেলাতে চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র অর্থনৈতিক মিথ্যাচার করে। অর্থাৎ চালু অর্থব্যবস্থা সকল অর্থব্যবস্থার মধ্যে মহত্তম- এটি বুঝানোর চেষ্টার করে। তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক মিথ্যাচার- বৈষম্য পৃথিবীর ইতিহাসের আদি থেকেই চলছে (রাসেল, ১৯৯৭খ, পৃ: ৮৮)।
অন্যদিকে রাষ্ট্রকে পুরোপুরি দোষও দিচ্ছেন না ম্যাকাইভার। তিনি বলছেন, আর যাই করুক না কেন রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়ন ও আইন প্রয়োগ, নিয়ন্ত্রণ করতেই হয়। এই কাজগুলো ঠিকভাবে করার জন্য রাষ্ট্রের যে গুণের প্রয়োজন, সেটাই রাষ্ট্রকে অন্যান্য হাজারো মঙ্গলজনক কাজ করতে অযোগ্য করে তুলেছে (ম্যাকাইভার, ১৯৭৭গ, পৃ. ১১১)।
এরিস্টটল ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থে প্রথম বললেন, “মানুষ স্বভাবতই সামাজিক জীব।” সমাজকে বাদ দিয়ে মানুষের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব। সমাজের বাইরে বসবাস করে তার নৈতিক উন্নতি অর্জন অসম্ভব (ইসলাম, ১৯৭৮ক, পৃ. ১৩৪)। ব্যক্তির উপর শৈশবে ও কৈশোরে সমাজের প্রভাব শিক্ষা-চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে (রাসেল, ১৯৯৭গ, পৃ. ৪৯)।
রাষ্ট্র ও সমাজের ভেদ এবং অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে, সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সমাজের অধিকাংশ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। কিন্তু রাষ্টব্যবস্থার ইরাদা কি তাই ছিল?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও আস্থা রাখতেন সমাজে, রাষ্ট্রে নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রের ফারাক করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’ প্রবন্ধে বলেছেন, “ইউরোপ স্বাধীনতাকে যে স্থান দেয়, আমরা মুক্তিকে সেই স্থান দিই।” স্বাধীনতা দরকার রাষ্ট্রের, মুক্তি প্রয়োজন সমাজের (চৌধুরী, ২০০৫খ, পৃ. ৩৫)।
আমাদের চারপাশের বিদ্যমান অনৈতিকতা, ভঙ্গুর শিক্ষা, অবক্ষয়ের সমাধান রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন সামাজিকতায়, রাষ্ট্রনীতিতে নয়। কেননা রাষ্ট্র পরের বিরুদ্ধে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উত্তেজিত করে। আর সমাজ চায় পাঁচমিশালি বিভাগ ও বিরোধের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে (চৌধুরী, ২০০৫গ, পৃ. ৫৪)।
রবীন্দ্রনাথ শুধু ব্যক্তিমানুষের মধ্যেই ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করেন নি; মানুষের সঙ্গে মানুষের বা সমাজের সংযোগসূত্রেই উদ্বোধিত হয় সেই ব্যক্তিত্ব (মাসুদুজ্জামান, ২০০৬, পৃ. ৭৯)। সমাজকেই রাষ্ট্রের দর্শন রচনার কাজটি করতে হয়। ব্যাপারটি উল্টো ঘটলে, রাষ্ট্র যদি সমাজের দর্শন মুসাবিদা করতে শুরু করে, মুসিবত ঘটে তখনই (চৌধুরী, ২০০৫ক, পৃ. ১৬)।
রাষ্ট্র মানেই একটি শ্রেণির শাসন। প্রায় সকল রাষ্ট্রব্যবস্থা এ যাবৎ মুষ্টিমেয় এলিট শ্রেণির শাসন হিসেবেই আমাদের সামনে ধরা দিয়েছে। ফ্রেইরের ভাবনায় এই এলিট শ্রেণির পক্ষে সাম্য, সামাজিক মর্যাদা, শোষণহীনতার পক্ষে অবস্থান সম্ভব নয় (ফ্রেইরী, ১৯৯৩ক, পৃ. ১২)। ফলে জনগণের অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষার দিকেই আমরা ঝুঁকে পড়ি।
রাষ্ট্র ও সমাজের ভেদ এবং অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষা বুঝতে, সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে সমাজের অধিকাংশ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। কিন্তু রাষ্টব্যবস্থার ইরাদা কি তাই ছিল? শেষ পর্যন্ত কি সমাজের অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষার কাছেই রাষ্ট্রকে পরাভূত হতে হয়নি?
জাঁ জ্যাক রুশো তাঁর সোসাল কন্ট্রাক্ট গ্রন্থে বলেছেন, রাষ্ট্রের বৈধ শক্তি ব্যতীত অপর কোনো শক্তিকে কোনো মানুষ মানতে নৈতিকভাবে বাধ্য নয় (রুশো, ২০০৮, পৃ. ২৭)। অধিকাংশ মানুষের মানবিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব হচ্ছে নিজেদেরকে মুক্ত করা এবং সেই সাথে শোষণকারীদেরও মুক্ত করা (ফ্রেইরী, ১৯৯৩খ, পৃ. ১২)।
অধিকাংশ মানুষের ইচ্ছা সবসময়ের জন্য যে প্রগতির পক্ষে থাকবে, তাও কথা নেই। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা এই বঙ্গসমাজের অধিকাংশের খায়েশ ছিল। কিন্তু সমাজের অধিকাংশের খায়েশই যে প্রগতির আকাঙ্ক্ষা বহন করে না, তা বুঝতে বেশি দেরি হয়নি আমাদের। আমরা আমাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করলাম ১৯৭১ সালে লাখো মানুষের রক্তের দামে।
ফরাসি দার্শনিক জাক লাকাঁর বয়ান অনুসারে, মানুষ জানে না সে কী চায়। কখনো অপরের বাসনাকেই সে নিজের বাসনা জ্ঞান করে (খান, ২০০৭, পৃ. ১৬৯)। অনেকসময় শোষিতরা মুক্তির প্রচেষ্টা চালানোর পরিবর্তে নিজেরাই পুরোদস্তুর অত্যাচারী বা ক্ষুদে অত্যাচারীতে পরিণত হন।
মানুষ হয়ে ওঠার আদর্শের বদলে তারা মনে করেন ‘মানুষ’ হওয়া মানে অত্যাচারী হওয়া। এ অবস্থায় তার আকাঙ্ক্ষাকে অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বিবেচনা করা যায় না (ফ্রেইরে, ১৯৯৩গ, পৃ. ৮-২৬)।
শোষিতরা মাঝেমাঝে নিজেদের অবমূল্যায়নও করেন। তারা ভাবেন, তারা কোনো কাজের নন, কিছু জানেন না, শিখতেও পারেন না ইত্যাদি। ফলে তারা সবকিছুকেই প্রশ্নাতীতভাবে গ্রহণ করেন (ফ্রেইরী, ১৯৯৩ঘ, পৃ. ৮-২৬)।
সক্রেটিস বারবার বলেছেন, নির্বিবাদে কোনকিছু মেনে না নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে এর যৌক্তিকতা পরীক্ষা করে দেখা মানুষ মাত্রেরই উচিত (ইসলাম, ১৯৭৮খ, পৃ. ৮৩)।
মুতাযিলা সম্পদ্রায়ভুক্ত মুসলিম চিন্তাবিদগণ, আল ফারাবি, ইবনে সিনাসহ অনেকেই একইভাবে স্বাধীন চিন্তার সমর্থক। তাঁরা যাচাই-বাছাই না করে কোনো মত বা কোনো শিক্ষাকে গ্রহণ করতে নারাজ (ইসলাম, ১৯৭৮গ, পৃ. ২৫৭-২৬২।
ব্যক্তিমানুষ হিসেবে একজন সমাজের অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষার সাথে একাত্ম হতে গিয়ে মেকি-সহানুভূতি প্রদর্শন বা কিছুটা কষ্ট হয়তো পেতে পারেন। কিন্তু তাতেই তিনি অধিকাংশের সাথে একাত্ম হয়ে যান না। একাত্ম হওয়া মানে অধিকাংশের পাশে থেকে মুক্তির যাত্রায় শামিল হওয়া। এখানে মেকি-সহানুভূতি বা দয়া-দাক্ষিণ্যের কোন সুযোগ নেই।
মেকি-করুণা বিতরণের কাঠামো বজায় রাখে যে প্রক্রিয়া, তার ধ্বংস সাধনের সংগ্রামই হচ্ছে অধিকাংশের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সত্যিকারের বিবেচনাবোধ। সেজন্য দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন হয় ভুয়া, না হয় প্রতারাণামূলক (ফ্রেইরী, ১৯৯৩ঙ, পৃ. ৯-২৬)।
ইতালির তাত্ত্বিক গ্রামশি বুদ্ধিজীবীদের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন- প্রথাগত ও জৈব বুদ্ধিজীবী। প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা চিন্তা করেন, বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু তাঁরা পরম্পরার প্রতিভূ। অন্যদিকে জৈব বুদ্ধিজীবীরা চিন্তা করেন এবং রূপান্তরের আশায় রূপান্তরের কাতারে নিয়োজিত হন (গ্রামশি, ১৯৯৩, পৃ. ২)। শিক্ষার্থীদেরও আমরা সেভাবে দেখতে চাইবো।
প্রথাগত শিক্ষার্থীরা শিখছেন, জানছেন। জৈব শিক্ষার্থীরা একইসাথে সমাজের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সমঝে নিয়ে পরিবর্তনের সংগ্রামে লড়ছেন। জৈব শিক্ষার্থীদের হয়তো ভুল ধরতে পারেন কেউ।
জ্ঞানকাণ্ডে চিরন্তন বলে কিছু নেই, সবকিছুই আপেক্ষিক। শিক্ষা প্রপঞ্চটিরও হয়তো সার্বজনীন কোনো ধারণা হতে পারে না। তথাপি সহজ হয়েও “শিক্ষা হল মানুষের আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তন, যা সমাজ কর্তৃক আকাঙ্ক্ষিত”- সংজ্ঞাটি আমাদের কালের জটিল জগতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
এমন সমালোচনার জবাবে ডিরোজিও বলেছিলেন, তরুণদের ধর্ম হলো ভুল করা। ইতিহাসের ধর্ম হলো তরুণদের সেই ভুল স্বাভাবিক বলে স্বীকার করা। ভুলের ধ্বংসস্তুপের ওপর নির্ভুলের ইমারত গড়ে তোলা যায়। মানব ইতিহাস আমাদের তাই বারবার দেখিয়েছে। ‘ভুল’ আর ‘মিথ্যা’ এক নয় (ঘোষ, ১৯৮০, পৃ. ১৯)। তরুণরা ভুল করতে পারে; মিথ্যার আশ্রয় না নেয়া পর্যন্ত তারাই ইতিহাস নির্মাতা।
জ্ঞানকাণ্ডে চিরন্তন বলে কিছু নেই, সবকিছুই আপেক্ষিক। শিক্ষা প্রপঞ্চটিরও হয়তো সার্বজনীন কোনো ধারণা হতে পারে না। তথাপি সহজ হয়েও “শিক্ষা হল মানুষের আচরণের অপেক্ষাকৃত স্থায়ী পরিবর্তন, যা সমাজ কর্তৃক আকাঙ্ক্ষিত”- সংজ্ঞাটি আমাদের কালের জটিল জগতে খুবই প্রাসঙ্গিক।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান! বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের…
নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল…
বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির…
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের…
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, "কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক…
মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে…
View Comments
ধন্যবাদ স্যার।অনেক কিছু জানতে পারলাম।।।
আসসালামু-আলাইকুম। শিক্ষা যে একটা বিস্তর আলোচনার বিষয়বস্তু এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের এ বিষয়ে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা যে কতটুকু তা বুঝতে পারলাম। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ স্যার, এত সুন্দর করে বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ।
৮ম ব্যাচ,চবি