যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষা: কীভাবে লিখবেন স্টেটমেন্ট অফ পারপাস

স্টেটমেন্ট অফ পারপাস- এ এমন এক রচনা, যার উপরে উচ্চতর পর্যায়ে ভর্তির অনেক কিছুই নির্ভর করছে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ম হলো, মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে পড়ার আবেদন করার সময়ে নিজের উপরে একটা রচনা লিখতে হয়। এতে বলতে হয় নিজের সম্পর্কে, কেনো এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বা এই বিষয়ে পড়তে আগ্রহী, এসব কিছু।

সমস্যা হলো, স্কুল কলেজ থেকেই আমরা “নতুন বাংলা রচনা” ধাঁচের লেখা মুখস্ত করে চলি, কাজেই নিজে থেকে রচনা লেখার অভ্যাসটা অনেকেরই থাকে না। কিন্তু ভর্তির আবেদনের এই স্টেটমেন্টটা অবশ্যই লিখতে হবে নিজেকে, একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। তাই এখানে তুলে ধরছি এই গুরুত্বপূর্ণ রচনাটি লেখার জন্য কিছু পরামর্শ।

করো নাকো কপিপেস্ট

বছর সাতেক আগে যখন ভর্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তখন দেখতাম, বুয়েটে আমার সহপাঠী কিংবা সিনিয়র ভাইদের কম্পিউটারে বিভিন্ন ততোধিক সিনিয়র ভাইদের স্টেটমেন্টের কপি (“চোথা”) থাকতো। সময় বাঁচাতে অনেকেই আরেকজনের স্টেটমেন্ট এদিক সেদিক করে চালিয়ে দিতো। কিন্তু মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির লোকজন এতো গাব নয় মোটেও। বছরের পর বছর ধরে একই লেখা দেখতে দেখতে তারাও বিরক্ত, কাজেই এরকম রিসাইকেল করা লেখা পেলে সেটার ফল কী হয়, বলাই বাহুল্য।

কাজেই স্টেটমেন্ট লেখার জন্য প্রথম পরামর্শ হলো, অন্য কারো নমুনাকে এদিক সেদিক করে চালাবার কাজটা কখনোই করবেন না। নিজে লিখুন।

বিরত থাকুন GRE-বিদ্যা জাহির করা থেকে

স্টেটমেন্ট অফ পারপাস লেখার সময় আরেকটা ভুল হলো, বিশাল বড় বড় সব বাক্য, আর জিআরইতে সদ্য শেখা জটিল সব শব্দের ব্যবহার। একটা ধাক্কা যুক্তরাষ্ট্রে এসে সবাই খায়, তা হলো, আমাদের দেশে শেখা “ভালো ইংরেজি” এখানে অনেকটা অচল। আমরা বিশাল বিশাল, একাধিক বাক্যাংশের যে রীতিতে বাক্য লিখতে শিখি, মার্কিনিরা তা মোটেও পছন্দ করে না। কাজেই এক বাক্য এক লাইনের বেশি গেলেই ওদের পড়তে/বুঝতে সমস্যা হয়, খেই রাখতে পারে না। কাজেই বাক্য যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতে হবে, আর একাধিক বাক্যাংশের জটিল বাক্যগঠনের অভ্যাস বাদ দিতে হবে। শব্দচয়নের ক্ষেত্রেও তাই। জিআরই-এর জন্য যেসব শব্দ শেখা হয়, ওগুলো বাস্তব জীবনে কেউ ব্যবহার করে কি না সন্দেহ, তাই নিজের বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে ওসব শব্দ ব্যবহার করলে পাঠক চরম বিরক্ত হবে নিঃসন্দেহে।

তাহলে কী লিখবেন?

স্টেটমেন্ট অফ পারপাস তাই লিখুন নিজের কথা। কেনো পড়তে আগ্রহী হলেন আপনার বিষয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে কোন কোর্স কেনো ভালো লাগলো, কীরকম কাজ করেছেন তা গল্পের ভাষায় (সিভিতে কোর্সের বিশাল বৃত্তান্ত আছেই, কাজেই এখানে গল্পাকারে লিখতে হবে)। কেন উচ্চতর শিক্ষা চান (চাপা না মেরে লিখুন), কেন বেছে নিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়। আসলে, এটা লেখার সময়ে ধরে নিন, আপনার সামনে বসে আছে ভর্তি কমিটি, তাদের পটিয়ে ভর্তি হতে হবে, কাজেই নিজেকে যথাযোগ্য প্রার্থী হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করতে মাত্র ৫ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবেন। সেই সময়ে কী বলবেন, তাই লিখতে হবে আপনার স্টেটমেন্টে।

লিখুন সময় নিয়ে

স্টেটমেন্ট অফ পারপাস কিন্তু হুট করে লিখে ফেলার কিছু না। এটা লেখার জন্য ২/৩ সপ্তাহ সময় নিন। একবার লিখুন, তার পর কয়েকদিন পরে পড়ে দেখুন পাঠকের দৃষ্টিতে, কী লিখেছেন। দরকার হলে বন্ধু বা সিনিয়র কাউকে দেখান। যারা ইতিমধ্যেই উচ্চতর পর্যায়ে আছেন, তাদের বলুন একটু দেখে দিতে। বানান শুদ্ধ রাখুন। বানান বা ব্যকরণ ভুল হলে কিন্তু সুন্দর করে লেখা একটি স্টেটমেন্টও কাজ দেবে না। স্পেল চেকারের উপরে ভরসা করবেন না, স্টেটমেন্ট লিখে প্রিন্ট করে তার পর কাগজটা লাইন বাই লাইন পড়ে দেখুন ঠিক আছে কি না।

ফরম্যাটিং

আর স্টেটমেন্ট দেখতে কেমন, তাও কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। ফন্ট খুব বেশি ছোট ব্যবহার করবেন না। ১১ বা ১২ হলে ভালো। অনেক প্রফেসরের বয়সই কিন্তু ৪০ এর উপরে, আর চশমার কারণে তারা ১০ ফন্টের লেখা পড়তে পারেন না বা অনেক কষ্ট করে পড়েন। টেক্সট লেফট জাস্টিফাইড, আর স্পেসিং সিঙ্গল বা ১.৫ স্পেসিং দিলে ভালো। ৫/৬ প্যারার বেশি না লেখাই ভালো। সব মিলিয়ে দেড়পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ করা উচিৎ। এর বেশি আসলে কেউ পড়ার ধৈর্য্য রাখতে পারে না।

স্টেটমেন্ট অফ পারপাস ভর্তির একটি গুরুতপূর্ণ নিয়ামক। কাজেই সময় নিয়ে, চিন্তা ভাবনা করে, তবেই লিখুন।

বুয়েটে আমার পরের ব্যাচের ছাত্র হেলালী মর্তুজা (এখন মাইক্রোসফটে আছেন) একটা চমৎকার পরামর্শ নিবন্ধ লিখেছেন এই ব্যাপারে, এটা পড়ে দেখতে পারেন

লেখক পরিচিতি

রাগিব হাসান

ড. রাগিব হাসান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এ অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা...

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    বাংলাদেশের প্রান্তিক নারীদের শিক্ষা : সমস্যা ও উত্তরণের উপায়

    বাংলাদেশের শিক্ষায় পুরুষদের তুলনায় নারীরা নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে...

    বিদ্যালয় ও পরীক্ষাকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হোক

    বিএনপির ডাকা সাম্প্রতিক তিনদিনের হরতাল এবং এতে সম্ভবত সবচেয়ে...

    যত দোষ সান্ধ্যকোর্স? : পর্ব ২

    ড. শিশির ভট্টাচার্য্য প্রশ্ন করেছেন সব দোষ সান্ধ্যকোর্সের কি...

    দ্য আর্ট অফ টিচিং সাইন্স

    বিজ্ঞান শিক্ষণের ক্ষেত্রে প্রেষণা প্রদান না করলে বিজ্ঞান শিখনের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে না। এই সমস্যার সমাধান হলো, বিজ্ঞান শিক্ষণের কৌশল সম্পর্কে জানা অর্থাৎ আর্ট অফ সাইন্স টিচিং সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।

    উচ্চ শিক্ষা ডিলেমা – মার্স্টাস, পিএইচডি না এমবিএ?

    এস এম মাহবুব মুর্শেদ লিখেছেন উচ্চ শিক্ষায় ডিলেমা নিয়ে আমি...

    যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষা: রেকমেন্ডেশন লেটার নিয়ে বিভ্রান্তি

    মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তির আবেদনের অপরিহার্য অংশ...

    গবেষণা বিষয় নির্বাচন: অ্যাকাডেমিক গবেষণার প্রথম চ্যালেঞ্জ

    গবেষণা শুরু বা পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম ও সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ...

    শিক্ষার্থীরা কেন উইকিপিডিয়া ব্যবহার করবে?

    উইকিপিডিয়া হচ্ছে একটি বহুভাষিক, ওয়েবভিত্তিক, মুক্ত বিষয়বস্তু-বিশিষ্ট বিশ্বকোষ প্রকল্প।...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।