স্কুল ও কলেজে ইংরেজি ভাষা শেখানোর শিক্ষক নেই, ব্যতিক্রম ছাড়া। ভাষা শেখানোর মত প্রশিক্ষিত ও দক্ষ শিক্ষক আমরা আসলে তৈরি করতে পারি নি অথচ ইংরেজির গুরুত্ব দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় ব্যক্তিগত ও বেসরকারি পর্যায়ে শুরু হয়েছে ইংরেজি শেখানোর বিভিন্ন পদ্ধতি ও প্রচেষ্টা। কে কতটা সফল এবং বাস্তবমুখী তার নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান এবং গবেষণা। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে নিজেরাই প্রচার করে নিজেদের সাফল্যের কথা। আমি দু-একটি অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় দেখেছি। শিক্ষক নিজে পুরো কথাটাই বাংলায় বলছেন। বাংলার মাধ্যমে যেভাবে ইংরেজি শেখানোর প্রচেষ্টা চলছে তাতে ইংরেজি শেখানো হচ্ছে না; হয়ত ‘বাংরেজি’ কিছুটা হচ্ছে। ভাষা শেখানোর জন্য দরকার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, গবেষণা, প্রচুর পড়াশোনা ও একাগ্রতা। এই বিষয়গুলো আমাদের স্কুল ও কলেজেই যেহেতু নেই- প্রশ্ন জাগে তাহলে এইসব জায়গায় কারা পড়ান ইংরেজি?
ছাত্রজীবনে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি শেখার জন্য ইংরেজি পড়ে নি। পরীক্ষায় পাশ করার জন্য পড়েছে। পরীক্ষায় পাশ করে এসেছে কিন্তু ইংরেজি শেখা হয় নি। বাস্তবজীবনে এসে যখন দেখল তাদের ইংরেজি পড়া এবং বাস্তবজীবনে ইংরেজি ব্যবহারের মধ্যে অনেক তফাৎ, তখনই তারা আবার এই ভাষা শেখার জন্য লেগে যায়। এই সময় যেহেতু স্কুল ও কলেজে আর যাওয়া যায় না তাই তারা বিকল্প খোজে আর এই বিকল্প জায়গাই দখল করেছে কোচিং সেন্টারগুলো। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ও প্রচার দেখে মনে হয় এই কোচিংগুলোর ব্যবসা রমরমা । আর দেখা দিয়েছে প্রতিযোগিতা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের মধ্যে। অনেক স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়েছেন এখানে শিক্ষাদান করাতে। তাদের প্রতিষ্ঠানে তারা ব্যর্থ হয়েছেন ইংরেজি শেখাতে, এখানে আসছেন ব্যবসা জমাতে, ইংরেজি শেখাতে নয় ।
এইসব কোচিং-এ যেসব চাকুরীজিবিরা ইংরেজি শিখতে যান তাদের মনে রাখতে হবে যে, হাতুড়ে ডাক্তার দ্বারা যেমন কোনো চিকিৎসা হয় না বরং রোগ বেড়ে যাওয়া বা বিপদজনক দিকে টার্ন করানোর সম্ভাবনা থাকে বেশি, ঠিক একইভাবে তথাকথিত কোচিং সেন্টারগুলোতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কোনো শিক্ষক নেই। একটি বিদেশি ভাষা পড়ানো বা শেখানো চাট্টিখানি কথা নয়। এজন্য দরকার অগাধ পড়াশোনা, গবেষণা, সঠিক পরিবেশ এবং সঠিক প্রশিক্ষণ। এর কোনটিই এইসব কোচিং সেন্টারের শিক্ষক কিংবা শিক্ষক নামধারী ছাত্রদের নেই। বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে এবং পত্রিকার পাতা ভর্তি করে বিজ্ঞাপন দিয়ে চলছে এদের রমরমা ব্যবসা। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কারণ এসব জায়গায় অন্তত কিছু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। তাছাড়া ভুল হোক বা ভাঙ্গাচোড়া যাই হোক, কিছু ইংরেজির চর্চা তো হচ্ছে বলে মনে করেন কর্তৃপক্ষ।
স্কুলে যখন পড়তাম তখন ভাবতাম যে যত বেশি কঠিন ভয়েস চেইঞ্জ করতে এবং উক্তি পরিবর্তন করতে পারে; সে তত ভালো ইংরেজি জানে বা ভালো ইংরেজি শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হলাম দেখলাম ব্যাপার পুরো আলাদা। ক্যাডেট কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে ইংরেজি পড়াতে গিয়ে অনেক কিছু টের পেলাম। আবার যখন ইএলটি-র প্রশিক্ষণ নিলাম তখন দেখলাম ভাষা সম্পর্কে সেটি আবার আর এক জগত। কোচিং সেন্টারগুলোতে কারা পড়াচ্ছেন ইংরেজি? কলেজ পর্যায়েই নেই ভাষা পড়ানোর মত শিক্ষক। বেকার কিছু ছাত্র-ছাত্র কিংবা স্কুলের পুরনো ধ্যানধারনার কিছু শিক্ষক ইংরেজি পড়াচ্ছেন কোচিং সেন্টারগুলোতে। আর স্কুল পর্যায়ের কিছু তথাকথিত নামকরা শিক্ষক যাদের ভাষা শেখানো সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা নেই তারা পড়াচ্ছেন ইংরেজি। এসব শিক্ষক জানেন না ছাত্রছাত্রী কিংবা বয়স্ক শিক্ষার্থীদের কিভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে ইংরেজি পড়াতে হয়। তারা শুধু জানেন কিভাবে কঠিন কঠিন গ্রামারের নিয়ম পড়ানো যায়। কিভাবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করা যায়, কিভাবে শিক্ষার্থীদের নিজেদের ইংরেজি লেখার ও বলার অভ্যাস করাতে হবে তা তারা জানেন না বা প্রাকটিস করান না।
কোচিং সেন্টারে যারা ইংরেজি পড়ান আমি তাদের কয়েকজনকে প্রশ্ন করেছি তারা কোন কোন ইংরেজি পত্রিকা পড়েন। অবাক কাণ্ড তাদের কেউ ইংরেজি পত্রিকা পড়েন না। অথচ ইংরেজি শেখার জন্য ইংরেজি পত্রিকা পড়া অন্তত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্য একান্ত প্রয়োজন এবং একটি সঠিক লার্নিং ম্যাটেরিয়াল।
ইংরেজি ভাষার চারটি দক্ষতার মধ্যে মাত্র দুটো দক্ষতার পরীক্ষা হয় আমাদের পারলিক পরীক্ষাগুলোতে এবং তার উপরই আমরা ছাত্রছাত্রীদের গ্রেডিং করে থাকি এবং সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকি যে সে, ইংরেজিতে খুবই ভালো। ইংরেজিতে এ প্লাস পাওয়া মানে ৮০% কিংবা তার বেশি মার্কস পাওয়া অর্থাৎ এ প্লাসধারী একজন ছাত্র বা ছাত্র ইংরেজিতে খুবই ভালো। সে ইংরেজিতে কথা বলতে পারবে, তার জানা যে কোনো বিষয়ে লিখতে পারবে, ইংরেজি শুনে বুঝতে পারবে এবং ইংরেজিতে লেখা যে কোনো বিষয় বুঝতে পারবে। কিন্তু আমাদের এ প্লাস পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান কোথায় তা পাঠকই বিবেচনা করবেন। কোচিং সেন্টারগুলোতে যদি বাকি দুটো দক্ষতার উপর কোনো ধরনের গুরুত্বারোপ করা হতো কিংবা সঠিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে বুঝতাম যে, তারা কিছু একটা করছে। তাতো না, তারা সিলেবাস অনুযায়ী একই ধারায় এগুচ্ছে। ইংরেজির আন্তর্জাতিক টেস্টিং সিস্টেম ও সার্ভিসগুলো চারটি দক্ষতার উপরই পরীক্ষা নেয় এবং সে অনুযায়ী গ্রেডিং করে থাকে।
ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকরা কোচিং-এর শরনাপন্ন হন কারণ স্কুল কিংবা কলেজে একই ক্লাসে অনেক ছাত্রছাত্রী থাকে বলে দুর্বল এবং অধিক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী গুরুত্ব পায় না। তারা মনে করে বিশেষ কোনো কোচিং-এ গেলে তারা উপযুক্ত গুরুত্ব পাবে। কিন্তু এখানে অবস্থা তো আরও খারাপ। স্কুলে শিক্ষকগণ অন্তত সিলেবাস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের যদিও আধুনিকতার ছোঁয়া তেমন একটা নেই। কোচিং-এ কী হয়? একই বিষয় চেপে ধরে বার বার মুখস্থ করানো হয় আর বার বার পরীক্ষা নেয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিষয়টি মোটেই আকর্ষণীয় নয় এবং এই বিষয়টি একেবারেই সৃজনশীল নয়। সৃজনশীল না হলে এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে স্থান করে নেয়া খুবই কঠিন। দেখা যায় অনেক ছাত্রছাত্রী অনেক ভালো ফলাফল করেও ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না কিংবা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকুরি পায় না, কয়েকটি কারণের মধ্যে সৃজনশীলতার অভাব একটি। তাই ছাত্রছাত্রীদের কোচিংমুখী না করে বাসায় পড়ানো, নিজেরা একটু সময় দেয়া, ইংরেজি ও বাংলা পত্রপত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলানো উচিত। আর চাকুরীজিবি যারা ইংরেজি শিখতে কোচিং সেন্টারে যান তারা নিজেরা নিয়মিত ইংরেজি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, ভালো কোনো শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকুন এবং ইংরেজি খবর শোনার ও মুভি দেখার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দেখবেন আপনার অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হবে। কোচিং-এ আপনার যাদের কাছে ইংরেজি পড়েন তারা নিজেরাই ইংরেজি পত্রিকার খবর রাখেন না, অথচ এইসব পত্রপত্রিকায় প্রচুর ম্যাটেরিয়ালস ও গাইডলাইন থাকে যা ইংরেজি শেখার জন্য যথেষ্ট সহায়ক এবং কার্যকরী ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. আশরাফুল ইসলাম কোচিং সেন্টার বলেন, “কোচিং সেন্টারগুলো ইংরেজি ভাষার দৈন্যদশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে । সেন্টারগুলো পরীক্ষা পাশের জন্য কিংবা বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত পথ দেখিয়ে দেয় যা ছাত্রছাত্রীদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।” প্রফেসর মনজুরুল ইসলাম বলেন, “আমি একদিন কোনো এক কোচিং সেন্টারের পরিচালককে ইংরেজি ক্লাস নিতে দেখলাম। ঐ একটি ক্লাসের মধ্যে সে সাতটি ভুল ইংরেজি শিখিয়েছে।” মীরপুর বাংলা হাইস্কুলের একজন শিক্ষার্থী বলছে, “ স্কুলে আমাদের ইংরেজি শিক্ষক আমাদের নিয়ে মজা করেন। ইংরেজি ক্লাস আদৌ আকর্ষনীয় নয়, বরং ভীষণ বোরিং। শুধু ধরাবাধা কিছু গ্রামারের নিয়ম দিনের পর দিন পড়ান যা শিক্ষার্থীদের একেবারেই আকর্ষণ করে না। ফলে ছাত্রছাত্রীরা কোচিং-এ ভর্তি হয়, কিন্তু এখানকার অবস্থাও একই। কোথায় যাব আমরা সঠিক ও আকর্ষণীয় উপায়ে ইংরেজি শিখতে?“ এই প্রশ্ন শুধু একজন ছাত্রের নয়, এ প্রশ্ন অগণিত ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকের । কে দিবে এর উত্তর ?
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।
আমার মনে হয় সমস্যাটা আমাদের মূল শিক্ষাতেই। আমার পরিচিতদের দেইখা আমার ধারণা, স্কুলে বার বছর ইংরেজি পড়াইয়া যা অর্জন করা যাইতেসে, ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং তার ধাচে তৈরি বিভিন্ন কোচিং সেন্টার কয়েক মাসে তারচেয়ে বেশি কাজ করতেসে। একটা ভাষায় কথা বলা, পড়া, লেখা, বুঝা শিখতে বার বছর লাগার কথা না। ব্যক্তিগতভাবে আমি দুইটা ভিন্ন ভাষা শিখসি টেলিভিশন দেইখা; সেই তুলনায় স্কুলের ইংরেজি আমার কোনো উপকারে আসছে বইলা মনে হয় না।
কোচিং সেন্টারগুলার অস্তিত্ব আছে মূলধারার ব্যর্থতার কারণেই।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হলে ইংরেজি শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রয়োজন। বর্তমানে সারাদেশে ইংরেজি শিক্ষকের তীব্র সংকট চলছে। এমতবস্তায় ওয়েব সাইট এর মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে, যেমন http://www.jompesh.com বিভিন্ন বিষয়ে ভিডিও এর মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করছে সম্পূর্ণ বিনামূল্য ।