বাড়ি শিক্ষাতত্ত্ব শিক্ষা বনাম জ্ঞান: একটি মৌলিক বিবেচনা

শিক্ষা বনাম জ্ঞান: একটি মৌলিক বিবেচনা

শিক্ষা ও জ্ঞান
শিক্ষা ও জ্ঞান; ছবিসূত্র: গণকমিটি

মুহাম্মাদ মিজানুর রশীদ শুব্র লিখেছেন শিক্ষা ও জ্ঞান প্রসঙ্গে

শিক্ষা ও জ্ঞান – এর মাঝে যেমন গুরুত্বপুর্ণ পার্থক্য রয়েছে, তেমনি শিক্ষিত ও জ্ঞানীর মাঝে একই ধারার এক অপরিহার্য এবং বিশেষ বিবেচ্য পার্থক্য রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে শেষোক্ত প্রসঙ্গের সঠিক অনুধাবন সমাজ থেকে ‘বিলুপ্ত প্রাণী’ প্রায়।

প্রথমেই এই বিভক্তির মূলে চলে যাই। তা হলো—  এদের শাব্দিক অর্থের ভিন্নতায়। ‘জ্ঞান’ শব্দটি সম্পর্কিত অজানাকে জানার সাথে, শিক্ষার সাথে নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমরা অনেকেই আজকাল আমাদের অবচেতন মনে শিক্ষা এবং জ্ঞানকে সমার্থে বিবেচনা করি। শিক্ষা জ্ঞানার্জনের পূর্বশর্ত তখনই যখন জ্ঞানার্জনকে একটি পদ্ধতিলব্ধ অর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।


‘জ্ঞান’ শব্দটি সম্পর্কিত অজানাকে জানার সাথে, শিক্ষার সাথে নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও আমরা অনেকেই আজকাল আমাদের অবচেতন মনে শিক্ষা এবং জ্ঞানকে সমার্থে বিবেচনা করি। শিক্ষা জ্ঞানার্জনের পূর্বশর্ত তখনই যখন জ্ঞানার্জনকে একটি পদ্ধতিলব্ধ অর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।


বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মধ্যে বিবেচ্য পার্থক্যটি হারাতে বসেছি। যেমন ধরুন, যে শিশু শিক্ষালয়ে গিয়ে শিক্ষিত হচ্ছে, আমরা ধরে নিচ্ছি তাতেই তার জ্ঞানার্জন নিশ্চিত হচ্ছে। একেবারেই যে জ্ঞানার্জন হচ্ছে না তা যেমন নয়, জ্ঞানার্জনের উদ্দ্যেশ্যটিও যে পুরোপুরি হচ্ছে না সে-ও এক অবাঞ্চিত সত্য। এমন নির্বিকার অনুধাবনে আমাদের দোষ খুবই কম। তার কারণ হলো— প্রশ্নাতীতভাবেই সব দেখে এসেছি এভাবে, শুনে এসেছি, মেনে এসেছি।

যদিও যথার্থ যে সূক্ষ্ম বিষয়টির পার্থক্য করতে আমরা ভুলে যাই, সেটি হলো শিক্ষা একটি পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ামাত্র; আর জ্ঞান হলো অর্জিত, আরোপিত বা স্থানান্তরিত জাগতিক সত্য সম্পদ। আমাদের গতানুগতিক ধারায় যে ধারণা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত, সে অনুযায়ী অনায়াসেই আমরা ভাবছি শিক্ষিত হলেই বুঝি সেই স্তর অর্জন তথা জ্ঞান অর্জিত হয়। তার একটি কারণ হলো, সত্যকে আমরা অনেকেই কেবল ধরে নেই কতোগুলো তথ্যের সমাহার।

অথচ জ্ঞান হলো তথ্যের উৎসে, জাগতিক সত্য সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে জেনেশুনে আত্মস্থ করা, নিজের অস্তিত্বের অংশ করে নেওয়া। তবেই একজন জ্ঞানী। সাথে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুই পদ্ধতিগতভাবে এই জ্ঞানার্জন। শিক্ষা স্বয়ং জ্ঞানের সেই অর্জন নিশ্চিত করতেও পারে, নাও করতে পারে। এ নিশ্চয়তা নির্ভর করছে শিক্ষাদান পদ্ধতির সামগ্রিকতার ওপরেই, যা বেশ কয়টি উপকরণের সমন্বিত অত্যন্ত জটিল এক প্রক্রিয়া।

শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। এর কয়টি নিখাদ জ্ঞানার্জনের জন্য নিয়োজিত তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। যদিও সেই বিতর্কের পূর্বশর্ত শিক্ষিত হওয়া এবং জ্ঞানী হওয়ার প্রভেদটিকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা। জাতি, সামষ্টিক বা একক ব্যক্তির জন্য উপর্যুক্ত জ্ঞানার্জন পদ্ধতির বিবেচনা ছাড়াই ধার করা পদ্ধতিতে শিক্ষা পরিচালনা করাটাই এখন আমাদের দেশীয় রীতি। তাই তার ফলপ্রসূতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থেকে যায়। যে পরিপ্রেক্ষিত থেকে এসব ধার করা শিক্ষাদান পদ্ধতি তার সাথে অসামঞ্জস্য পরিবেশে এর প্রচলন বিরূপ ফল দিবে এটাই স্বাভাবিক। আর তাই জ্ঞানার্জনের যে উদ্দেশ্য তা কখনই সঠিক অর্থে পূরণ হওয়ার নয়।


শিক্ষাদান পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। এর কয়টি নিখাদ জ্ঞানার্জনের জন্য নিয়োজিত তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। যদিও সেই বিতর্কের পূর্বশর্ত শিক্ষিত হওয়া এবং জ্ঞানী হওয়ার প্রভেদটিকে স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা।


শিক্ষাগ্রহণ ও জ্ঞানার্জনের মধ্যে বর্তমান যুগের সম্পর্ক এবং সে সম্পর্কের চলমান দিক নিয়েও ভাবার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা এবং জ্ঞানার্জনের পারস্পরিক নিবিড় অথচ স্বকীয় দ্বৈতসত্তার মাঝে মৌলিক এই বিভাজনের বিষয়বস্তু আরো গভীর। একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, জ্ঞান বিষয়টি সৃষ্টির মতোই আদিম, মৌলিক এবং অদ্যাবধি চিরন্তন একটি অস্তিত্ব। পক্ষান্তরে, শিক্ষা একটি কৃত্রিম পন্থায় জ্ঞানকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বাঁধার ব্যবস্থাপনা মাত্র।

যে সময়ে শিক্ষার কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হয়নি, তখনও জ্ঞানার্জনের প্রতি আকর্ষণের কারণেই মানুষ তার চারপাশকে রপ্ত করেছে, জীবনধারণ করে ক্রমশ নিজের উত্তরণ ঘটিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজেদের সুবিধার্থেই জ্ঞানার্জনের সুসংগঠিত পথ, তথা শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি প্রচলন শুরু হয়। তাতে ক্ষতির কিছুই ছিল না ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ জ্ঞান সত্ত্বাটিকে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থাপনার বা প্রতিষ্ঠানিক রূপের উর্ধ্বে অবস্থান দেওয়া হয়নি।

একসময় শিক্ষাপ্রদানের (যা তাত্ত্বিকভাবে মূলত কোনো ‘জ্ঞানীর জ্ঞান বিতরনের’ কৌশলমাত্র) সাথে উপার্জনের ব্যবস্থা সংযুক্ত হয়ে গেলো। সমাজে সভ্যতায় জ্ঞান নয়, শিক্ষা পরিমাপের পদ্ধতি এবং তার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন মাত্রার মূল্যায়ন সূচকের স্বীকৃতি দেওয়া শুরু হলো। তারপর শুরু হলো সেই স্বীকৃতির তারতম্যে জীবনধারণের গুণগত পার্থক্য— তখন থেকেই জ্ঞানের সাথে শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য সর্বনাশের আবির্ভাব।

লক্ষ করুন, আমি এখানে দেখাবার চেষ্টা করেছি কীভাবে জীবনধারনের তাগিদে সভ্যতার আড়ালে জ্ঞানার্জন থেকে মানুষ শিক্ষাব্যবস্থার বলয়ের সীমানায় পর্যবসিত হয়ছে। সেটা নিয়েও ভাববার অবকাশ রয়েছে। কোনোকিছুর সাথে ব্যবসা, রাজনীতি, আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জড়িত হয়ে গেলে সেই ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোর বোধ করি আর পেছনে ফেরা হয় না।

আপাতদৃষ্টিতে তাতেও ক্ষতি পরিলক্ষিত হয় না সত্য। তার একটি কারণ, ক্ষতি যা হওয়ার তা এতোটাই স্বাভাবিক ও আর্থসামাজিক প্রক্রিয়ায় প্রবাহিত যে, এর বিবর্তন কিংবা আবর্তন পুরোটাই বাতাসের অস্তিত্বের মতো টের পাওয়া যায় না। উপর্যুপরি, প্রথাগত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় শিক্ষাদান ও জ্ঞানার্জনের ব্যাবসায়িক বন্ধনের এই ক্ষতিকে বরং লাভজনক বলেই মনোসামাজিক কাঠামোয় ক্রমাগত বদ্ধমুল করে “শেখানো” হয়েছে।

জ্ঞান (wisdom and knowledge) অর্জনের চেয়েও বরং শিক্ষিত (educated, learned etc.) হওয়ার প্রতিযোগিতায় অধিকাংশ মানুষ এখন সময় ব্যয় করে। যে শিক্ষা জ্ঞানার্জনের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করে, সে শিক্ষা মূল উদ্দ্যেশ্য থেকে অনেক দূরে এবং ক্ষতিকারক— এ সত্য বুঝতেও হয়তো জ্ঞান দরকার, শিক্ষা নয়। তাই হয়তো সে অন্তর্দৃষ্টির এতোটা সঙ্কীর্ণতা।


জ্ঞান (wisdom and knowledge) অর্জনের চেয়েও বরং শিক্ষিত (educated, learned etc.) হওয়ার প্রতিযোগিতায় অধিকাংশ মানুষ এখন সময় ব্যয় করে। যে শিক্ষা জ্ঞানার্জনের প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করে, সে শিক্ষা মূল উদ্দ্যেশ্য থেকে অনেক দূরে এবং ক্ষতিকারক— এ সত্য বুঝতেও হয়তো জ্ঞান দরকার, শিক্ষা নয়। তাই হয়তো সে অন্তর্দৃষ্টির এতোটা সঙ্কীর্ণতা।


আমরা যারা এখন সন্তানের পিতামাতা, তারাও আমাদের অজান্তেই বা স্বজ্ঞানে সন্তানদের বহু কাঠকয়লা পুড়িয়ে ‘শিক্ষিত’ করে এক মহার্ঘ মহাঅর্জনে মোহনীয় স্বস্তিতে আছি। এটি আমাদের দোষও নয়, দোষ সমগ্র বৈশ্বিক চিত্রে ব্যবসার তুলিতে আঁকা জ্ঞানার্জনের প্রকল্পে। তবে সাথে এটিও বলে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীতে আজীবনই একদল জ্ঞানের উদঘাটন এবং সঞ্চয় করে আসছেন এবং আরেকদল সেই সঞ্চয় থেকে অর্জন করে আসছে। এ কারণেই সভ্যতার সম্মুখ যাত্রাপথে কেউ পুরো কাফেলাকে পথ নির্দেশ দেন, আর বাকিরা সেই পথে না বুঝেশুনেই হাঁটেন।

উপায়ই বা কী? সদিচ্ছা যেখানে শুভদৃষ্টির জননী, সেখানে অনেক জাতি যে পিছিয়ে পড়বে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। আফসোস এটিই যে, এতো মেধার প্রাচুর্য সত্ত্বেও কতিপয় নমস্য জ্ঞানপাপীদের শিশুভুলানো ব্যবস্থাপত্রে এই বিশ্ব জ্ঞানকাফেলার নেতৃত্ব দেওয়া থেকে আমরা চিরতরে বঞ্চিত হয়ে গেলাম। ভুলে গেলাম সেই মৌলিক ধারণা যে, শিক্ষিত হলেই কেউ জ্ঞানী হয় না, যদিও জ্ঞানীমাত্রই শিক্ষিত।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version