পথহারানো পথ

শিক্ষক; ছবিসূত্র: সময়বার্তা
শিক্ষক; ছবিসূত্র: সময়বার্তা

শ্রদ্ধা করার মতো শিক্ষক পাওয়া যায়, ভালোবেসে পদতলে লুটিয়ে থাকতে চাওয়ার মতো শিক্ষক বিরল। শিক্ষকের কথায় আত্মপ্রাণদান করার আগুন বুকে জ্বালানোর নজিরও বিরল নয়। তাই শিক্ষকতা মহান পেশা। সূর্য সেন শিক্ষক ছিলেন। নিজস্ব মত ছড়িয়েছেন, পথ দেখিয়েছেন শিক্ষার্থী ও কিশোরতরুণদের মাঝখানে। জালালাবাদ বিদ্রোহে বিদ্যালয়ের কিশোরেরাও ছিল।

কিন্তু আজকের বাংলাদেশে নয়, এখানে নয়।

এখানে শিক্ষকতা আর দশটা পেশার মতো ঘানিটানার পেশা। যাঁরা কিছু করতে পারেননি বড়সড়, কিন্তু পেটের তাগিদে চলার পথ চাই, বা কেউ কেউ সময় কাটাতে বা চাকরি করি জানান দিতে, বা আপাতত উপার্জন করতে এসেছেন এখানে। প্রাইভেট না-পড়ালে শুধু শিক্ষকতার বেতন দিয়ে চলা অসম্ভব। পরিবার থাকলে আরো বেশিই। কাজেই প্রাইভেট টিউশন থাকবেই, এবং পড়তে না-এলে অপমান, নাম্বার কম, হয়রানিও চলমান। তৃতীয় সারির মেধাবী ও চতুর্থ সারির মানুষদের অনেককেই পাওয়া যাবে শিক্ষকতা পেশায় যাঁদের পেশাদারিত্ব নেই, শিশুদের প্রতি সহানুভূতি নেই, অভিভাবকদের প্রতি সৌজন্যবোধ নেই, রুচিশীলতা নেই, মানবিকতাবোধ নেই, নিজের কৃতকর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুশোচনাবোধ নেই।

আমরা এই খাণ্ডবদাহনের ভেতরে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে বড় হয়েছি। কেউ সযতনে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে চলতে পেরেছে, কেউ পুড়ে ঝলসে গেছে, কেউ পালিয়ে বেঁচেছে। রক্ষা পায়নি পুরোপুরিভাবে কেউই।

একটি সামগ্রিকভাবে অসুস্থ সমাজে কেউই পার পায় না, পাবে না। স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোবেসে হাসিমুখে নিজেকে পায়ের তলায় বসিয়ে রাখতে পারি এমন শিক্ষক আমরা কজন পেয়েছি?

আমি দুয়েকজনের বেশি না। অশ্রদ্ধা করিনি। বেশি হলে অপছন্দ বা ঘৃণা। কম হলে বিস্মৃতিবিলয়। মারতে চাইনি। মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করিনি। কিন্তু মনে কোনোই আকর্ষণ সৃষ্টি করতে পারেননি বেশিরভাগই, তাঁদের নিজস্ব পড়ানোর বিষয়ের ওপরেও নয়। অথচ এমন নয় যে জ্ঞানচর্চায় খুব অনাগ্রহী ছিলাম।

হিসেব করলে পুরো দেশের অবস্থাটাই এমন।

বন্য মাৎস্যন্যায় ছড়িয়ে আছে ভয়াবহ অন্ধকারে। যে যাকে পারে মেরে খাচ্ছে। মানুষ খাচ্ছে মানুষের রক্ত, ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে নারীমাংস, চিবিয়ে খাচ্ছে শিশুদের নরম হাড়মেদমজ্জামাংস। যার হাতে ক্ষমতা, সে যমদূতের মতো ডাঙশ মেরে অন্যদের মাথায় আঘাত করে নিজের অহংবোধ পরিতৃপ্ত করছে। তার ওপরে যারা, তারা মারছে তারও মাথায়। সবখানেই প্রতারণা, অন্যায়, বর্বরতা, প্রতিহিংসা, অমানবিকতার জটিল জটাজাল। কেউ মুক্তি পায় না।

ট্রান্সকম গ্রুপের কর্ণধারের মেয়ে ধর্ষিত হয়ে নিজের ঘরেই খুন হয়ে যায়, মন্ত্রীর ছেলে মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়, গুলি খেয়ে মারা যায় একদার ত্রাস, ক্যান্সারে ভুগে ধুঁকে ধুঁকে মরে ভেজাল ব্যবসায়ী, পরীক্ষায় খারাপ করে আত্মহত্যা করে শিক্ষকের সন্তান।

শিক্ষাখাত কেন এর চাইতে আলাদা হবে?

আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারীদের কীভাবে আমরা গড়ে তুলেছি, পথ দেখাচ্ছি তার প্রমাণ দেখলে স্পষ্ট হবে কেন আমাদের পরিত্রাণ ইহজনমে অসম্ভব।

শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি পেতে দুর্নীতি করে, টিকিয়ে রাখতে দুর্নীতি করে, চাকরি করতে গেলে নারী হয়ে ইজ্জতের সওদা করে, স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে, পুরুষ হয়ে দাস্যবৃত্তি করে, অন্যায়ভাবে প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত থেকে, নিজের প্রাইভেট ব্যাচের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন দিয়ে বা ভালো নম্বর দিয়ে, ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক, মানসিক, বাচিক, ও যৌননিপীড়ন করে, প্রতিটা ছুটি, ইনক্রিমেন্ট, প্রমোশনের জন্যে ঘুষ দিয়ে, পায়ের জুতোর তলা খসিয়ে ছুটোছুটি করে, ক্ষমতাশালী অভিভাভবকদের অন্যায় আবদার শুনে ও মেনে, বড় বাপের পোলা ও মাইয়াদের অসভ্যতার সাথে, বেয়াদবির সাথে তাল মিলিয়ে এখানকার একজন প্রোডাক্ট সাইকো হলে সেটা খুবই স্বাভাবিক হবে।

সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে যেমন মেধা একমাত্র নিয়ামক নয়, বেসরকারিগুলোয় অধোগতির মান ও পরিমাণ আরোই ভয়াবহ। ম্যানেজিং কমিটি, গবর্নিং বডি নামক ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো দুর্নীতি, অমানবিকতা, স্বজনপ্রীতি, পদলেহন, ও রাজনৈতিক সুবিধেচর্চার কৃষ্ণকেন্দ্র, কুৎসিততম অতল গহ্বর।

যে-সিস্টেমে বা যে-জাতির মানসিকতায় ধর্ষকাম, নিপীড়নপ্রেম, ক্ষমতাদালালি চিরন্তন, তার নারী, শিশু, দুর্বলেরা মারই খেয়ে যাবে বারবার। আমি ক’দিন আগেও জানতাম না বছর চারেক আগে চৈতী নামের ভিকারুন্নেসার আরেক মেয়েকে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে রাখা হয়নি তার অনেক কাকুতিমিনতির পরেও। সে আত্মহত্যা করে বাঁচে। কর্তৃপক্ষ যথারীতি ন্যায়বিচার ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর হয়ে গর্বিত হন।

আর অভিভাবকেরা তো আছেনই সন্তানদের চাঁদমারিচর্চার গুলি বা তির বানাতে। শিশুরা আমাদের দেশে বরাবরই চরম প্রলেতারিয়। এত অমানবিক আচরণের শিকার হয় তারা যা কিছুক্ষেত্রে আদিম গুহাবাসীদের শিশুরাও হত কিনা সন্দেহ।

না, শিক্ষাক্ষেত্র বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সারাদেশের নৈরাজ্য এখানেও পরিস্ফুট মাত্র। এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে, এই গান গেয়ে বেলাশেষে এই খাঁচাতেই মরে-পড়ে থাকাই আমাদের নিয়তি।

আমি শিক্ষক পরিবারের সন্তান। মা আমৃত্যু শিক্ষক ছিলেন। বাবা দীর্ঘদিন। একাত্তরে বাবাকে ধরিয়ে দিতে বাবার ছাত্রের বাসায় তারই বন্ধু পাকিস্তানি সেনা নিয়ে আসে। ছাত্রটি বাবাকে লুকিয়ে রেখে ও মিথ্যে কথা বলে প্রাণ বাঁচায়। আমার মাতামহ শিক্ষক ছিলেন চার দশক ধরে। তাঁর অনুজ চট্টগ্রামের কিংবদন্তি শিক্ষক। আমি নিজেও কোচিং সেন্টারে পড়িয়েছি ও সেটা চালিয়েছি ও কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেছি, যদিও নিজেকে আমি শিক্ষক দাবি করিনি, করি না।

আমার কাছে শিক্ষাগুরুর স্থান ও মর্যাদা অনেকানেক ওপরে। আমি সেরকম খুব বেশি কাউকে এই জীবনে পাইনি। শুধু পরের মুখে বা লেখাতে পেয়েছি। সেসব অন্য প্রসঙ্গ।

কিন্তু আমাদের এই জীবন্ত নরককুণ্ড শিক্ষাজগত যা শিশুদের মন ও শরীর ক্রমাগত আক্রমণ করে তাদের পঙ্গু ও আহত করে, বয়ঃসন্ধিকালের কিশোরকিশোরীদের বুকে দগদগে ঘা করে দেয় যা ভুলে যেতেই তারা ভালোবাসে, অভিভাবকদের অসম্মান ও অবমাননার ভয়ে নিয়ত কাঁটা হয়ে থাকতে বাধ্য করে, অযোগ্যদের সম্মান করতে জোর করে, যোগ্যদের বঞ্চিত করে, পরীক্ষার্থীদের গিনিপিগ করে, তার ধ্বংস কামনা করি অবিরত।

দেশে আমার একমাত্র পুত্রসন্তান পাপাইয়ের স্কুলিং ছিল দুই + সাড়ে তিন বছরের। এর ভেতর একটা দিনের জন্যেও সে স্কুল ভালোবাসেনি, বন্ধু বানায়নি কাউকেই, পছন্দ করেনি এটা বিন্দুমাত্র। বিদ্যালয় তাকে আতঙ্ক উপহার দিয়েছে ছোট্ট বুকে, চাপপ্রয়োগ করেছে ছোট্ট মাথায়, বইয়ের বোঝা চাপিয়েছে ছোট্ট কাঁধে। এবং নানাবিধ অবমাননা ও শাস্তি উপহার দিয়েছে তার সাথে আমাকেও। শিক্ষকেরা তো বটেই, এমনকি বিদ্যালয়টির দারোয়ানদের অভব্য, অশোভন আচরণ থেকে বাঁচা সম্ভবপর হয়নি পুরোপুরি আমারও, অথচ ওটা আমারও আলমা মাতের ছিল।

দেশ থেকে বেরুনোর আমার একাধিক তাড়নার মূল দুটো ছিল ওকে আমি এই কুৎসিত, বীভৎস, অরাজক শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাঁচাতে চাই যেখানে শিক্ষকেরা দানব, অভদ্র ও মনমগজ দুমড়েমুচড়ে দেওয়ার এইজেন্ট স্মিথ (প্রসঙ্গ: হলিউডি ছবি দ্য ম্যাট্রিক্স)। চেয়েছি দেশের ভেজাল খাবারের প্রাচুর্য যা সৃষ্টি করে ক্যান্সার থেকে নানারকম আয়ু ও জীবনক্ষয়ী রোগ, তার হাত থেকে শিশুটির মুক্তি।

এখন আমি একটি উন্নততর দেশে, বাংলাদেশ থেকে যার দূরত্ব সবদিকেই অনেকানেক। জানি না এই পরবাসের মেয়াদ আমার ঠিক কতদিন, কিন্তু এখন পাপাইয়ের স্কুলের ভেতর ঢুকলে মনে হয়, পরির দেশের বন্ধদুয়ারে হানা দিয়ে স্বপ্নরাজ্যে এসেছি।

সবার পক্ষে এই দেশত্যাগ সম্ভব নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে এই রক্তপায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত, অবক্ষয়ী, অসভ্য, অমানবিক শিক্ষাব্যবস্থা যতদিন আছে, ততদিন এর যূপকাষ্ঠে চৈতী, অরিত্রীর মতো শিশুরা বলিপ্রদত্ত হতেই থাকবে একের পর এক।

পরিত্রাণ আমাদের হাতে নেই। পরিত্রাণ আমাদেরই হাতে আছে। বড়ই দুরূহ সে কাজ। বড়ই কঠিনতম। কিন্তু আর পথ নেই। অন্য কোনো পথ নেই।

লেখক পরিচিতি

হিল্লোল দত্ত পেশায় একজন ব্যাংকার। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের শিক্ষা ও অন্যান্য সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে লেখালেখি করছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version