বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে অন্যান্য পাবলিক সংস্থা যেমন বিমান বাংলাদেশ, টেলিটক, পাটকল-চিনিকল ইত্যাদির মতো। কোনো দায়বদ্ধতা নেই। দেশের প্রতি কোন ভালোবাসা দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে না। এখানে শিক্ষক নিয়োগ নয়, যেন ভোটার নিয়োগ চলছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষক নিয়োগ
যতোদিন শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিয়োগ ও প্রমোশন নীতিগুলো আন্তর্জাতিক মানের করা হবে, ততোদিন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের ধ্বস কেউ ঠেকাতে পারবে না।
সম্প্রতি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছে বিডিজবসটুডে.কম-এ। উচিত ছিল অন্তত জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ করা। ধরে নেওয়া হয়, এখানে বাইরে থেকে কাউকে নিয়োগ দেয়া হবে না, শুধু বিভাগীয় প্রার্থীদের পদোন্নতি দেওয়ার জন্যই এই বিজ্ঞপ্তি।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের শিক্ষকদের প্রতিটি প্রমোশন আসলে নতুনভাবে নিয়োগ। সেখানে খোলাখুলি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় এবং যে কেউ দরখাস্ত করতে পারে। খোলাখুলি প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই প্রমোশনগুলো হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই তা করে না।
শিক্ষকদের চাপে রাখতে হয় বলেই যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা স্থায়ী হওয়ার আগে একজনকে যে পরিমাণ চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা অকল্পনীয়। আবার স্থায়ী হওয়ার পরও চাপমুক্ত থাকতে পারে না। এছাড়া সেখানে কখনো সকল শিক্ষককে সমান চোখে দেখা হয় না। ভালো আর খারাপকে যেখানে এক পাল্লায় মাপা হয় সেখানে কখনো ভালো মানুষ তৈরি হবে না।
শিক্ষকদের চাপে রাখতে হয় বলেই যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা স্থায়ী হওয়ার আগে একজনকে যে পরিমাণ চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা অকল্পনীয়। আবার স্থায়ী হওয়ার পরও চাপমুক্ত থাকতে পারে না। এছাড়া সেখানে কখনো সকল শিক্ষককে সমান চোখে দেখা হয় না। ভালো আর খারাপকে যেখানে এক পাল্লায় মাপা হয় সেখানে কখনো ভালো মানুষ তৈরি হবে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের একটি তালিকা করে তাদের যোগ্যতা মাপুন। আমি প্রায় নিশ্চিত তাঁদের প্রায় সকলেই মারাত্মকভাবে অযোগ্য। শাজাহান খানকে প্রধান করে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি আর আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ দেওয়া একই ধরনের।
অতিথি শিক্ষক বিনিময়
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটিতে গেস্ট প্রফেসর নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাসের গিয়ে দুয়েকটি কোর্স পড়াতে পারেন।
এর মাধ্যমে যিনি যাবেন তিনি নতুন একটি পরিবেশ পাবেন। তাঁর মধ্যে এক ধরনের প্রাণশক্তির পুনঃউদ্দীপনার সুযোগ হয়। নতুন পরিবেশে নিজেকে মেলে ধরার একটি স্পৃহা কাজ করে যা নিজের মানোন্নয়নে সহায়ক হতে পারে। এর মাধ্যমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে যৌথকাজের সুযোগ তৈরি হতে পারে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও জানতে পারে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেমন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালো শিক্ষক আছেন, আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষকের অভাব আছে। যেখানে ভালো বেশি আছে, সেখান থেকে যেখানে ভালো শিক্ষকের অভাব আছে সেখানকার অভাব কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা করে একটু হলেও ছাত্রছাত্রীদের উপকার করা সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা কী? আমার কাছে একটিই উত্তর— শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা। একে ঢেলে না সাজালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খুব দ্রুত খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাবে।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সমস্যা কী? আমার কাছে একটিই উত্তর— শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা। একে ঢেলে না সাজালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান খুব দ্রুত খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাবে। এই নিয়োগ কমিটির গঠনেই সমস্যা। পৃথিবীতে এরকম নিয়োগ কমিটি আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। নিয়োগ কমিটিতে থাকেন প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন, তারপর থাকে সংশ্লিষ্ট ফ্যাকাল্টির ডিন, থাকেন বিভাগের চেয়ারম্যান, থাকেন বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি।
এখানে স্পষ্টতই একধরনের ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ বিদ্যমান। যিনি কমিটির সদস্য, বিশেষ করে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নির্বাচন করেন তিনি কমিটির সর্বের সর্ব হিসাবে থাকেন। বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কে হবেন? এটি গত ৩০ বছর বা তার অধিক আগে থেকেই দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়ে আসছেন। ডিন তো নির্বাচিত!
আমাদের এখানে নির্বাচন মানে ক্ষমতাধররাই সর্বদাই নির্বাচিত হন, ব্যতিক্রম ছাড়া! ফলে এটি একটি সিন্ডিকেট। একজন শিক্ষক নিয়োগ যে বিশ্ববিদ্যালয়, দেশ ও জাতির জন্য কতো গুরুত্বপূর্ণ তা তারা তলিয়ে দেখেন না।
আমরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কাউকে নিয়োগ সাধারণত দেই না। আবার নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হওয়ার পরও দেখি সে কোন ক্ষমতাধরের সাথে মাস্টার্সের থিসিস করেছে। সেই শিক্ষকের সাথে যদি একাধিক শিক্ষার্থী থিসিস করে, তখন দেখা হয় কোন শিক্ষার্থীটি সবচেয়ে বেশি চামচামি করতে শিখেছে।
কেন এমন নিয়োগ দেওয়া হয়? কারণ আমরা চাই যে শিক্ষকটি নিয়োগ পায় তার যেন একজন গুরু থাকে। নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকটি বিভাগে যোগদান করেই বুঝে ফেলে সহকর্মী সবাই তাঁর শিক্ষক এবং কেউ কেউ শিক্ষকের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তিনি তাঁর নিয়োগকর্তা, ভবিষ্যৎ প্রমোশনদাতা। এখানে নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের পক্ষে বিভিন্ন ফোরামে তাঁর নিজস্ব মতামত দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আমরা যারা জ্যেষ্ঠ আমাদের মানসিকতাটিই এমন যে, কেউ বিরোধিতা করলেই তাকে ‘বেয়াদব’ ট্যাগ মেরে দেই। এই বেয়াদব যেন না আসতে পারে সেজন্যই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রার্থী যতো ভালোই হোক, তাকে নেওয়া হয় না। এমনকি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালোদের নিতেও দিন দিন অনীহার মাত্রা বেড়েই চলেছে। দেখা গেছে, ভালো মানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক হলে ভালো মানের বেয়াদব হয়। এরা নিয়োগ পাওয়ার পর দল করতে চায় না, এরা মাফিয়া ডনের কথা শুনতে চায় না ইত্যাদি।
শুধু এ-কারণেই বিশ্বের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজ গ্রাজুয়েটদের শিক্ষক হিসাবে পেতে অনাগ্রহ। উদ্যেশ্য যেন নিজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা নিজ বিভাগ তোষামোদির কারখানায় পরিণত না হয়।
ফেসবুকে বিভিন্ন বিষয়ে লিখলে সেখানে অমত, দ্বিমত কিংবা সহমত ইত্যাদি পোষণ করেন তাদেরকেও শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। দেখা গেছে, একই শ্রেণির মানুষগুলোর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চেতনার মধ্যে বেশ মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, শিক্ষা আমাদের চিন্তাধারাগুলোকে যতোটা না প্রভাব ফেলে, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চেতনা তার চেয়ে অনেক বেশি ফেলে। আমাদের দেশের শিক্ষার যে মান, সেটি এসব চেতনার শক্তিকে অতিক্রম করতে পারে না। তাদের চিন্তাগুলো যেন ওইসব চেতনার চারদেয়ালে বন্দি। দুঃখের বিষয় হলো, তারা যে বন্দি এটাও তারা বুঝতে পারে না। বন্দি থেকেও মুক্ত থাকার এক অলীক আনন্দে তারা মাতোয়ারা। এরা সর্বদা সহমত প্রকাশে এবং সহমতধারী খুঁজে ক্লাবের সদস্য বৃদ্ধিতে ব্যস্ত।
লেখক পরিচিতি
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
আপনি গবেষণা এবং প্রকাশনা সম্পর্কে এতটা উদ্বিগ্ন কেন? আপনার বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গবেষণা প্রকাশনা দেখুন। প্রায় কিছুই নেই। আপনি কি আপনার সমস্ত প্রকাশনা দিয়ে উপাচার্য হতে পারেন? না। একটি ব্যবহারিক মানুষ হন।
তোহ কি হোইসো? কি হোইয়া গেসো?