আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর কিছুদিন পরেই ১০০ বছরে পদার্পণ করবে। আমরা স্বপ্ন দেখি, এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিন বিশ্বের ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে অবস্থান করবে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক, সম্মানিত ডিন মহোদয়গণসহ আমাদের মাননীয় উপাচার্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উন্নতির পেছনে অন্যতম বড় বাধা হলো সঠিক সময়ে ফলাফল প্রকাশ করা। আমাদের বিজ্ঞান অনুষদ এদিক থেকে অনেক পিছিয়ে। যেখানে পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলাফল প্রকাশের পদ্ধতিটি ডিজিটাল সিস্টেমে নিয়ে আসা হয়েছে, সেখানে আমাদের ফলাফল এখনো এ্যানালগ পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়।
বর্তমানে যে পদ্ধতিটি আছে তাকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায় সেটি নিয়েই আমার আজকের এই লেখা।
একক পরীক্ষক নিয়োগ
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বর্ষে প্রতিটি বিষয় পড়ানোর জন্য একজন করে শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া হয়। সেই শিক্ষক চেষ্টা করেন গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করতে। তিনি যখন ইনকোর্স পরীক্ষার ২৫ নম্বরের প্রশ্ন করেন, খাতা দেখেন এবং ৩০ নম্বরের ফলাফল প্রকাশ করেন, তখন ছাত্র-ছাত্রীরা সেটি মেনে নেন। বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ নিজ বিভাগ থেকে কোনো আপত্তি তোলা হয় না।
যে শিক্ষক কোর্স পড়ান, আমরা তার ওপর ফাইনাল পরীক্ষার ৭০ নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। অথচ কানাডা, আমেরিকাতে শিক্ষকদের কাজ হলো শুধু ক্লাস নেয়া এবং প্রশ্ন করা। তাদের জন্য যে শিক্ষক সহকারী নিযুক্ত করা হয় তারাই খাতা দেখার কাজটি করেন।
যখনই চূড়ান্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ও খাতা দেখার বিষয় চলে আসে, তখনই আমরা দুই জন প্রশ্নকর্তা ও দুই জন পরীক্ষক নিয়োগ দিই। যেহেতু আমাদের প্রতিটি বর্ষে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০-এর মতো, কখনো কখনো পুনঃভর্তি যোগ করে ১৭০-ও হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে দুই জন পরীক্ষকের খাতা দেখার জন্য অনেক বেশি সময় সময় দরকার হয়। একই সাথে তৃতীয় পরীক্ষকের খাতা দেখার জন্য আরো কিছু সময় দরকার হয়।
আরেকটি বিষয়, যে শিক্ষক কোর্স পড়ান, আমরা তার ওপর ফাইনাল পরীক্ষার ৭০ নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। অথচ কানাডা, আমেরিকাতে শিক্ষকদের কাজ হলো শুধু ক্লাস নেয়া এবং প্রশ্ন করা। তাদের জন্য যে শিক্ষক সহকারী নিযুক্ত করা হয় তারাই খাতা দেখার কাজটি করেন। আমরা যদি এই সমস্যাটি সমাধান করতে চাই তাহলে প্রথমেই আমাদেরকে একক পরীক্ষক নিয়োগ করতে হবে। পৃথিবীর অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।
মেজর ও মাইনর কোর্সের খাতা মূল্যায়ন
বিজ্ঞান অনুষদে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের মেজর ও মাইনর কোর্স পড়তে হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু মেজর কোর্স পড়তে হয়। যখন শিক্ষকদের মাঝে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স বণ্টন করা হয়, দেখা যায় একই শিক্ষককে মেজর আর মাইনরের কোর্স পড়াতে দেয়া হয়েছে। যখন সেই সকল ছাত্র-ছাত্রীদের বার্ষিক চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়, তখন সেই শিক্ষককে প্রায় একই সময়ে এই দুটি গ্রুপের খাতা দেখতে হয়। সেক্ষেত্রে, সেই শিক্ষকের পক্ষে এতগুলো খাতা সঠিকভাবে এতো কম সময়ে দেখা সম্ভব হয়ে উঠে না। এটি ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ।
এই সমস্যা সমাধানে, বিভাগে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের কোর্স বণ্টন করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন একই শিক্ষককে মেজর ও মাইনরের কোর্স পড়াতে না দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কমিটিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, একই শিক্ষককে যেন একই বর্ষের দ্বিতীয় পরীক্ষক হিসাবে নিয়োগ না দেয়া হয়। তাহলে সেই শিক্ষক অনেকটাই নির্ভার হয়ে কম সময়ে খাতা দেখা শেষ করতে পারবেন।
মানোন্নয়ন পরীক্ষা বন্ধ করে আমাদের উচিত প্রতিটি বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা। এবং সেই ফলাফল দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা।
মানোন্নয়ন পরীক্ষা
ফলাফল দেরিতে প্রকাশের আরেকটি কারণ হচ্ছে ছাত্রী-ছাত্রীদের সারা বছর ধরে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়া। প্রথম বর্ষকে বাদ দিলে একটি পরীক্ষা কমিটিকে রেজাল্ট শিট তৈরি করার সময় প্রথমেই খুঁজে বের করতে হয়, কতো জন ছাত্র-ছাত্রী আগের বর্ষগুলোতে মানোন্নয়ন পরীক্ষা দিয়েছে। বিষয়টা এমন নয় যে, সেই ছাত্র-ছাত্রীরা নিজ থেকে এসে পরীক্ষা কমিটিকে তার মানোন্নয়ন পরীক্ষার নম্বরপত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। বরং সেই কমিটিকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে বিভিন্ন বর্ষের ফলাফল প্রকাশের খাতা খুঁজে সেই নম্বরগুলো বের করে নিতে হয়।
এতে শিক্ষকদের নিজেদের সব কাজ বন্ধ করে শুধু রেজিস্ট্রার বিল্ডিং থেকে এই নম্বর সংগ্রহ করতেই ব্যস্ত থাকতে হয়। অথচ, যদি এই নম্বরগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হতো, তাহলে একজন শিক্ষক এক মুহূর্তেই সেই শিক্ষার্থীর নম্বর পেয়ে যেতেন এবং ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা কমে আসতো।
মানোন্নয়ন পরীক্ষা বন্ধ করে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ প্রদান
ফলাফল প্রকাশের প্রক্রিয়াটি আরো সহজ করার জন্য আমার মনে হয় মানোন্নয়ন পরীক্ষা দেয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। বরং পরীক্ষা শেষ হওয়ার দুই মাসের মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করার দিকে নজর দেয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে, মানোন্নয়ন পরীক্ষা বন্ধ করে আমাদের উচিত প্রতিটি বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করা। এবং সেই ফলাফল দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রকাশ করা। এতে প্রতিটি বর্ষের ফলাফল সাথে সাথে আপডেট হয়ে যাবে এবং যেকোনো বর্ষের ফলাফল প্রকাশ করাও অনেক সহজ হয়ে যাবে।
পুনঃভর্তির নিয়ম পাল্টানো
বিজ্ঞান অনুষদে দেরিতে ফলাফল প্রকাশের পেছনে আরেকটি কারণ হলো পুনঃভর্তি। যারা পুনঃভর্তি হয়, তাদের একটি স্বাধীনতা থাকে। সেটি হলো, তারা চাইলে পূর্ববর্তী বর্ষের ইনকোর্স নম্বর রেখে দিতে পারে, অথবা নতুন করে ইনকোর্স দিয়ে সেই নম্বরও রাখতে পারে।
এর মানে হলো, পরীক্ষা কমিটিকে পুনঃভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে যারা পূর্ববর্তী বর্ষের ইনকোর্স নম্বর রেখে দিতে চায়, তাদের সংখ্যাটি খুঁজে বের করতে হবে । বিভাগীয় ও এ্যাকাডেমিক কাজ বন্ধ রেখে রেজিস্ট্রার ভবন থেকে আবার সেই নম্বর সংগ্রহের জন্য বার বার সেখানে যেতে হবে। এক্ষেত্রে পুনঃভর্তি যারা হবে তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়ম করা উচিত। সেটি হলো, হয় তাদের জন্য সবকিছু নতুন করে শুরু হবে, নয়তো তাদের পূর্ববর্তী বর্ষের ইনকোর্স নম্বর যাই হোক না কেন সেটিই রেখে দিতে হবে। এটি হলে, যেসব ছাত্র-ছাত্রী পুনঃভর্তি হচ্ছে, তারা ইনকোর্স পরীক্ষাকে আরও বেশি গুরুত্ব দেবে।
ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে বের হবার জন্য দরকার আমাদের সবার আন্তরিকতা। কাউকে দোষারোপ করে এর সমাধান সম্ভব নয়।
বর্ষভিত্তিক ফল প্রকাশ
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত উপরের ব্যবস্থাগুলো নেয়া না হচ্ছে, বর্ষভিত্তিক ফলাফল প্রকাশের ওপর জোর দেয়া উচিত, যেন অন্য কোনো বর্ষের ফলাফলের ওপর আরেকটি বর্ষের ফলাফল নির্ভর না করে। প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষের ফলাফল সঠিক সময়ে যদি প্রকাশ করা যায়, তাহলে সহজেই চতুর্থ বর্ষের ফলাফল প্রকাশের সময় পূর্ববর্তী বর্ষসমূহের ফলাফলের সাথে মানোন্নয়নের ফলাফল যুক্ত করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা সম্ভব। এতে ফলাফল প্রকাশের সময় কিছুটা হলেও কমে আসবে।
সবশেষে, এই ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ককে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে বের হবার জন্য দরকার আমাদের সবার আন্তরিকতা। কাউকে দোষারোপ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। আমাদের এই ফলাফল প্রকাশের যে ব্যবস্থাটি আছে, সেটি কখনোই একদিনে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
আমরা সবাই জানি পরিবর্তন দরকার। তাই দক্ষ আইসিটি সেল অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর পরামর্শে ও প্রশাসনের সঠিক দিকনির্দেশনায় ডিজিটাল ফলাফল প্রকাশের দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি
ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।