বাড়ি ভাষা শিক্ষা

ইং‌রে‌জি বাচনভঙ্গি: কোনটি ঠিক?

বাচনভঙ্গি

কেউ কেউ ব‌লেন, ভা‌লো ইং‌রে‌জি বল‌তে চাই‌লে খাঁটি ব্রি‌টিশ বাচনভঙ্গি (accent) শিখ‌তে হ‌বে। আবার কেউ  ব‌লেন, এখন আমে‌রিকান বাচনভঙ্গি অনেক বে‌শি জন‌প্রিয়। এই ধরুন, ‘talking’ বলার সময় চোখমুখ বেকি‌য়ে ‘টা‌কিন’ ধর‌নের একটু উচ্চারণ কর‌তে পার‌লে আমে‌রিকা আমে‌রিকা ভাব চ‌লে আ‌সবে।

এই ছোট্ট জীব‌নে দেশি-বি‌দেশি কম মানু‌ষের সা‌থে কাজ করলাম না। চৌদ্দ বছ‌রের ক্যা‌রিয়া‌রে পু‌রো সময়টা‌তেই কাজ আমার শিক্ষা নি‌য়ে। এবং এর অধিকাংশ সম‌য়েই  কাজ ক‌রে‌ছি ইং‌রে‌জি ভাষার শিখন ও শেখা‌নোর কৌশল নি‌য়ে। 

আমি কখনও চেষ্টাই ক‌রি‌নি নে‌টিভ স্পিকারদের ম‌তো ক‌রে ইং‌রে‌জি বলার। আমার অবশ্য মু‌রোদও ছিলো না। এম‌নি‌তেই পা‌রি না, তার ওপর আবার ব্রি‌টিশ‌দের ম‌তো! প‌রে পড়‌তে গি‌য়ে জানলাম, আমা‌দের LAD (Language Acquisition Devices) না‌কি ওভা‌বে তৈ‌রিই  হয়‌নি।

ইং‌রে‌জি ভাষার বেশ ক‌য়েক‌টি সাউন্ড বাংলা ভাষায় নেই। সে কার‌ণে ওরকম শ‌ব্দের সাম‌নে পড়‌লে মুখচোখ বেঁ‌কি‌য়েও কাজ হয় না পু‌রোপু‌রি। যেমন, good শব্দ‌টি‌কে আমরা ‘গুড’ হি‌সে‌বে উচ্চারণ ক‌রি। আস‌লে এটি তো পু‌রোপু‌রি ‘উ’ নয়; অনেকটা ‘অ’ এবং ‘উ’-এর মাঝামা‌ঝি। অবশ্য আমার ম‌তে, গুড বল‌লে কো‌নো সমস্যা নেই।

একেবারে ছোট‌বেলা থে‌কে চেষ্টা কর‌লে না‌কি ইং‌রেজ‌দের ম‌তো ক‌রে উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু সেই রকম প‌রি‌বে‌শে বড় হওয়া চাই, যা‌তে সব সময় ওই বাচনভঙ্গি কা‌নে আসে। আমি গ্রা‌মের মানুষ, ইং‌রে‌জি তো পারতামই না। প‌রে শহ‌রে এসে ঠ্যাকায় প‌ড়ে এখন একটু একটু পা‌রি।


আমার এক বন্ধু ব্রি‌টিশ কায়দায় ইং‌রে‌জি বলার অপ‌চেষ্টার খপ্প‌ড়ে প‌ড়ে শব্দের শে‌ষের /r/ সমা‌নে বাদ দি‌য়ে বলা শুরু করলো। এমন‌কি বাংলার ‘আঠা‌রো’ বল‌তে গি‌য়ে অনেকটা ‘আঠা‌য়ো’ বলে ফেল‌ছিলো।


ইংরে‌জি আমার কা‌জের ভাষা। তার সা‌থে আমার প্রেম নেই। ‌চেষ্টা ক‌রে‌ছি শুদ্ধ ক‌রে ইং‌রে‌জি লিখ‌তে ও বল‌তে শেখার। এখনও আমার শত শত ভু‌লের সা‌থে বসবাস। আমি কী ক‌রে নেটিভ বাচনভঙ্গি শিখবো?

বন্ধু‌দের কাউকে কাউকে যখন ওরকম চেষ্টা কর‌তে দেখতাম, বড় অসহায় লাগতো নি‌জে‌কে। ভাবতাম, আমার খালবি‌লের ইং‌রে‌জি কোন কা‌জে লাগ‌বে?

আমার এক বন্ধু ব্রি‌টিশ কায়দায় ইং‌রে‌জি বলার অপ‌চেষ্টার খপ্প‌ড়ে প‌ড়ে শব্দের শে‌ষের /r/ সমা‌নে বাদ দি‌য়ে বলা শুরু করলো। এমন‌কি বাংলার ‘আঠা‌রো’ বল‌তে গি‌য়ে অনেকটা ‘আঠা‌য়ো’ বলে ফেল‌ছিলো।

আমার পর‌দেশী কিছু অন্ধ অনুকরণ না করার এক‌টি অভ্যাস ছিলো শুরু থে‌কেই। আর ক্ষুদ্র জ্ঞান মি‌লি‌য়ে খুব ম‌নে হ‌তো, আমরা ইং‌রে‌জি বলবো আমা‌দের ম‌তো ক‌রে, বাংলাদেশি বাচনভঙ্গিতে। ভারতীয়রা পার‌লে আমরা কেন পারবো না?

ইং‌লিশ ইন অ্যাকশ‌নে এসে ক‌য়েকজন ব্রি‌টিশ সহকর্মী পে‌য়ে গেলাম। দে‌খি, তা‌দের প্রত্যে‌কের বাচনভঙ্গি সম্পূর্ণরূ‌পে স্বতন্ত্র। খটকা লাগল খুব। এত‌োদিন ধ‌রে শু‌নে আসলাম নে‌টিভ বাচনভঙ্গির কথা, এখন দে‌খি একেকজ‌ন একেক বাচনভঙ্গিতে কথা বলে।

একজন‌কে জি‌জ্ঞেস করলাম, “তোমরা সবাই ব্রি‌টিশ, কিন্তু তোমা‌দের সবার বাচনভঙ্গি এতোটা আলাদা কেন? তাহ‌লে কোনটিকে খাঁটি ব্রি‌টিশ বাচনভঙ্গি বলবো?” তিনি একটু হাস‌লেন। বল‌লেন, “সমগ্র বাংলা‌দে‌শে তোমরা কি একইরকম বাংলা বাচনভঙ্গিতে কথা বলো?”

তাই তো? ভা‌লো প্রশ্ন। প‌রে তিনি বোঝা‌লেন, “আমা‌দের ম‌ধ্যেও অনেক ধর‌নের বাচনভঙ্গি আছে। লন্ডন বা তার আশেপা‌শে একরকম। অন্য জায়গায় গে‌লে অন্যরকম। তোমরা নে‌টিভ বাচনভঙ্গিতে বল‌তে যে কী বোঝা‌তে চাও, তা আমরাও বু‌ঝি না। তাছাড়া তোমা‌দের এই আমা‌দের ম‌তো ক‌রে কেনো কথা বল‌তে হ‌বে?”


ইং‌রে‌জি তো আর এখন কেবল ইং‌রেজ‌দের ভাষা নেই। এটা এখন বৈশ্বিক ভাষা। প্রত্যে‌ক দে‌শেই নিজস্ব একটি বাচনভঙ্গি দাঁ‌ড়ি‌য়ে গে‌ছে। তোমা‌দের এখা‌নেই দে‌খি অন্যরকম চিত্র। ভারতীয়রা তা‌দের বাচনভঙ্গি প্রতি‌ষ্ঠিত ক‌রে ফে‌লে‌ছে! শ্রীলংকানরাও তাই


আমার তো আরও তাল‌গোল পা‌কি‌য়ে যা‌চ্ছে। এদিকে আমরা আঠা‌রোকে আঠা‌য়ো বা‌নি‌য়ে ফেল‌ছি অনুকর‌ণের ঠেলায়, আর ওরা এখন কীসব বল‌ছে! আরও শুনলাম, সুন্দরম‌তো‌ বুঝ‌তে ও বোঝা‌তে পারাই বড় কথা, বাচনভঙ্গি নি‌য়ে মাথাব্যথা না থাকাই ভা‌লো।

বাংলা‌দেশী‌ সহকর্মীদের কেউ কেউ একটু ওদের ম‌তো ক‌রে বলার চেষ্টা কর‌তেন। আর আ‌মার তো পুরোই খালবি‌লের ইং‌রে‌জি। সু‌যোগ বু‌ঝে এক‌দিন আবার আলাপ জু‌ড়ে দিলাম আমার ইং‌রেজ সহকর্মীর সা‌থে।

‌জান‌তে চাইলাম, “আমা‌কে একটি বিষয় বোঝাও তো! ওই যে ওরা তোমাদের ম‌তো ক‌রে বলার চেষ্টা কর‌ছে, এটি তোমার কা‌ছে কেমন লা‌গে? নিশ্চয়ই তোমার বুঝ‌তে সু‌বি‌ধে হয়? নিশ্চয়ই ম‌নে কর, ওরা অনেক ভা‌লো ইং‌রে‌জি জা‌নে?”

তিনি বললেন, “স‌ত্যি বল‌তে কি, এভা‌বে বল‌লে আমার কা‌ছে প্যা‌রো‌ডি ম‌নে হয়। ওরা চেষ্টা কর‌ছে, কিন্তু কো‌নোভা‌বেই তো আমা‌দের ম‌তো হ‌বে না। আর হওয়ার কো‌নো দরকার নেই তো! ইং‌রে‌জি তো আর এখন কেবল ইং‌রেজ‌দের ভাষা নেই। এটা এখন বৈশ্বিক ভাষা। প্রত্যে‌ক দে‌শেই নিজস্ব একটি বাচনভঙ্গি দাঁ‌ড়ি‌য়ে গে‌ছে। তোমা‌দের এখা‌নেই দে‌খি অন্যরকম চিত্র। ভারতীয়রা তা‌দের বাচনভঙ্গি প্রতি‌ষ্ঠিত ক‌রে ফে‌লে‌ছে! শ্রীলংকানরাও তাই।”

আমি তো অবাক হওয়ার চে‌য়েও অবাক! তাহ‌লে তো আমার খাঁটি বাংলা‌দেশি ইং‌রে‌জি নি‌য়ে কো‌নো সমস্যা নেই! সে আরও বলল, আমার কথা বুঝ‌তে তার না‌কি কো‌নোই সমস্যা হয় না, বরং আমি না‌কি খুব সহজ ক‌রে ইং‌রে‌জি ব‌লি। শু‌নে ম‌নে ম‌নে বললাম, “আমি তো‌ ভাই জা‌তে কৃষক, কা‌জে শিক্ষাজীবী। ক‌ঠিন ক‌রে বলার সামর্থ্য নেই, তাই সহজ ক‌রে ব‌লি।”

বি‌ভিন্ন দে‌শের অনেক বড় বড় মানুষষের কথা শুনলাম। অবলীলায় তারা তা‌দের দেশীয় বাচনভঙ্গি ব্যবহার ক‌রে ইং‌রে‌জি ব‌লে যা‌চ্ছেন। আফ্রিকানদের সবার বাচনভঙ্গি একইরকম ম‌নে হয়। চিন, জাপা‌ন আর কো‌রিয়ার মানুষরাও কী সুন্দর নি‌জে‌দের বাচনভঙ্গিতে কথা ব‌লে যা‌চ্ছে। জা‌তি সং‌ঘের সাবেক মহাস‌চিব বান কি মুন কথা ব‌লেন তার আাঞ্চ‌লিক কো‌রিয়ান বাচনভঙ্গিতে। জা‌তে জাপা‌নি আর আমে‌রিকাতে জন্ম, এমন মানুষও অনায়া‌সে জাপান প্রভা‌বিত ইং‌রে‌জি বলছেন।

গুগলের সিইও এতো বেত‌নের এতো বড় চাক‌রি ক‌রেন, তি‌নি কোন বাচনভঙ্গিতে কথা ব‌লেন? সম্ভবত ভারতীয় বাচনভঙ্গিতে। য‌দিও দীর্ঘ‌দিন প‌শ্চিমা বি‌শ্বে থাকার দরুন খা‌নিকটা প‌শ্চিমী হাওয়া লে‌গে‌ছে।

ওদি‌কে অত্যন্ত সফল উদ্যোক্তা আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা এবং জগৎ বিখ্যাত মো‌টি‌ভেশনাল স্পিকার জ্যাক মা খোদ চায়না বাচনভঙ্গিতেই কথা ব‌লেন। ইং‌রে‌জি ভাষায় লে‌খেন কিন্তু ইং‌রেজ নন, তা‌দের ভাষাজ্ঞান নি‌য়ে নিশ্চয়ই স‌ন্দেহ থাকার কথা নয়। বিখ্যাত আফ্রিকান নো‌বেল বিজয়ী লেখক চিনুয়া আচেবেও কিন্তু খোদ আফ্রিকান বাচনভঙ্গিতেই কথা ব‌লেন।

এরকম আরও শত শত জগদ্বিখ্যাত মানু‌ষের উদাহরণ দেওয়া যা‌বে। তাঁরা ইং‌রে‌জিকে কা‌জের ভাষা হি‌সে‌বে ব্যবহার কর‌ছেন, বই লিখ‌ছেন, সারা দু‌নিয়ায় বক্তৃতা কর‌ছেন ওই নিজ দে‌শের বাচনভঙ্গি নিয়েই কিন্তু।


আসুন, আমরা আমা‌দের সন্তান‌কে শুদ্ধ ও সাবলীলভা‌বে ইং‌রে‌জি শিখ‌তে উৎসা‌হিত ক‌রি। বি‌ভিন্ন প‌রি‌স্থি‌তি‌তে ভাষা‌টি কার্যকরভা‌বে ব্যবহার কর‌তে পা‌রার দক্ষতা অর্জন কর‌তে সহায়তা ক‌রি। ওদের বাংলা‌দেশি বাচনভঙ্গিই সারা দু‌নিয়া বুঝ‌বে এবং বাহবা দে‌বে, য‌দি ভাষায় স্পষ্টতা আর কথার ওজন থা‌কে।


তাঁরা পার‌লে আপ‌নি-আ‌মি কতো বড় হ‌য়ে গেলাম যে নে‌টিভ বাচনভঙ্গিতে কথা বল‌তে হ‌বে? আর না বল‌তে পার‌লে মাথা কাটা যা‌বে? ঠিক কী কার‌ণে ইং‌রে‌জি মাধ্যম বিদ্যালয়গু‌লো‌তে হাইব্রিড নে‌টিভ বাচনভঙ্গি ব্যবহার ক‌রে দো-আঁশলা এক‌টি প্রজন্ম তৈ‌রি করা হ‌চ্ছে? ভাষাটি ভা‌লো ক‌রে শেখার তুলনায় কেন এতো জোর দি‌চ্ছি নকল ক‌রে কথা বলার ওপর?

এর পেছ‌নে মূলত দু‌টো কারণ কাজ ক‌রে ব‌লে আমার ম‌নে হয়। এক. নিজস্ব জা‌তিসত্ত্বা ও সংস্কৃ‌তির প্রতি শ্রদ্ধা‌বোধ না থাকা আর সে কার‌ণে ময়ূরপুচ্ছ ধার করার অপ‌চেষ্টা। দুই. উত্তর-ঔপ‌নি‌বেশিকতার ঘো‌রের ম‌ধ্যে বসবাস করা এবং জাত থে‌কে বের হ‌য়ে জা‌তে ওঠার অমূলক অভিপ্রায়।

Communicative Language Teaching (CLT)-এর ক্ষে‌ত্রে mutual intelligibility ব‌লে এক‌টি কথা আছে। আপ‌নি চোখমুখ বেঁ‌কি‌য়ে আর তার‌চে‌য়েও বে‌শি হাত-পা ছোঁড়াছুঁ‌ড়ি ক‌রে কথা বল‌তেই  পা‌রেন। কিন্তু আসল কথা হ‌লো, আপ‌নি কতোটা সহ‌জে ও সাবলীলভা‌বে বোঝা‌তে পার‌ছেন।

আসুন, আমরা আমা‌দের সন্তান‌কে শুদ্ধ ও সাবলীলভা‌বে ইং‌রে‌জি শিখ‌তে উৎসা‌হিত ক‌রি। বি‌ভিন্ন প‌রি‌স্থি‌তি‌তে ভাষা‌টি কার্যকরভা‌বে ব্যবহার কর‌তে পা‌রার দক্ষতা অর্জন কর‌তে সহায়তা ক‌রি। ওদের বাংলা‌দেশি বাচনভঙ্গিই সারা দু‌নিয়া বুঝ‌বে এবং বাহবা দে‌বে, য‌দি ভাষায় স্পষ্টতা আর কথার ওজন থা‌কে।

লেখক পরিচিতি

সুদেব কুমার বিশ্বাস বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের শিক্ষার নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version