বাড়ি অর্থায়ন

বাজেটে শিক্ষা: অর্থমন্ত্রীর কাছে যা চাই

জাতীয় বাজেটে শিক্ষা : বরাদ্দ বনাম বাস্তবতা; ছবিসূত্র: প্রথম আলো
জাতীয় বাজেটে শিক্ষা : বরাদ্দ বনাম বাস্তবতা; ছবিসূত্র: প্রথম আলো

বাজেট-পূর্ব মওসুম চলছে। ধারণ করি, অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবিদাওয়ার মোক্ষম সুযোগটি যাতে হাতছাড়া না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হয়েছেন। এ লেখাটিও বাজেটে শিক্ষা নিয়ে সেরকমই একটি দাবিদাওয়া-সমৃদ্ধ লেখা হতে যাচ্ছে। আগে সাধারণত বাজেট-বক্তৃতার দিন পনের আগে পত্রিকায় কলাম লিখে অনেকে নানা দাবি জানাতেন। একমাত্র বিড়ি-সিগারেট বা তামাকজাত দ্রব্যাদি ছাড়া কোনো বিষয়ে দাম বাড়ানোর জন্য কাউকে আবদার করতে দেখা যায়নি।

অন্যদিকে ব্যবসায়ীদেরকে পণ্যে করহ্রাসের জন্য সভা-সমিতি থেকে শুরু করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাতেও দেখা গেছে। এতোসব দাবিদাওয়ার মধ্যে অর্থমন্ত্রী কোনটি রাখবেন আর কোনটি বাদ দিবেন- সেটি তাঁর ও তাঁর মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু বাজেট-বক্তৃতার দিন পনের আগে পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়া লেখার কোনো আবেদন থাকে না আসলে। খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছাড়া বাজেটের অধিকাংশ বিষয় তার আগেই নির্ধারিত হয়ে যায়। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বাজেট বক্তৃতার প্রায় মাসখানেক আগে থেকেই অনেককে দাবিদাওয়া পেশ করতে দেখা যাচ্ছে।

এই নিবন্ধের লেখক প্রতিবছর বাজেট বক্তৃতার আগে অর্থমন্ত্রীর কাছে রুটিনমাফিক কিছু আবেদন পেশ করেন। বিষয় শিক্ষায় বেশি বাজেট বরাদ্দ। যেহেতু আগের বছরের বাজেটে লেখকের চাহিদার প্রতিফলন ঘটে না, সুতরাং পরবর্তী বছর বাধ্য হয়ে সেই পুরনো চাওয়া আবার নতুন করে লিখে পত্রিকা-মারফত অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়। আশা, যদি লেখাটি অর্থমন্ত্রীর নজরে আসে এবং তিনি একটু গুরুত্ব দেন।

গত বছর পত্রিকা-মারফত মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে যে দাবিগুলো পেশ করেছিলাম, তার বিষয় ছিল একটি- শিক্ষাখাতে বরাদ্দ এবং দাবি ছিল দুটো- ১. শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বা জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা এবং ২. বাজেটে শিক্ষার বরাদ্দকে এমনভাবে সাজানো যাতে তা নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই দুটো দাবির পাশাপাশি আরেকটি সম্পূরক দাবি তুলেছিলাম সেই লেখাটিতে।

সেটি হলো- শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি কিংবা স্বাস্থ্য কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো খাত জুড়ে না দেওয়া। কারণ এভাবে দুটো বা তিনটি খাত একসঙ্গে মিলে একটা বড় বাজেট দেখানো যায় সত্যি, কিন্তু তাতে শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অংশ কমে আসে অনেকখানি। বাজেটে শিক্ষার জন্য আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখাই ভালো- তাতে বুঝা যায় দেশের শিক্ষা সেক্টরে জাতীয় বাজেটের কতোটুকু কীভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে এবং তা কীভাবে খরচ হচ্ছে।

গতবারের সেই দাবিদাওয়া পূরণ হয়নি। আমরা জনগণ, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবিদাওয়া পেশ করি বটে, কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে সবার দাবিদাওয়াকে দেখতে হয় বৃহত্তর আঙ্গিকে, সামগ্রিকভাবে পুরো দেশকে কেন্দ্র করে। ফলে আমাদের অংশ অংশ এসব দাবিদাওয়া যদি আদপে এই সামগ্র্রিকতাকে ধারণ না করতে পারে, তবে তা স্বাভাবিকভাবেই বিবেচিত হওয়ার কথা নয়। সবাই যদি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুবিধা চাইতে থাকি, তাহলে অর্থমন্ত্রীর পক্ষে কারও দাবিই রাখা সম্ভব হবে না। সুতরাং সেই দাবিই করা উচিত, যা অর্থমন্ত্রী এবং তাঁর সরকার করতে ইতোমধ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে আমাদেরকে একটি নতুন শিক্ষানীতি উপহার দিয়েছে। শিক্ষানীতিটি সংসদে পাশ করার সময় এবং তার পরবর্তী সময়ে সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের বক্তব্য থেকে ধারণা করেছিলাম- শিক্ষানীতির সুপারিশসমূহ দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এদেশে যেহেতু এক সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ পরবর্তী সরকার সহজে বাস্তবায়ন করতে চায় না, সুতরাং, ধারণা করছিলাম, সরকার শুরু থেকেই এ শিক্ষানীতি দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নে কিছু বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কিন্তু সেরকমটি হয়নি। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সত্যি, কিন্তু তা পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা অনুসারে যথেষ্ট নয়। এর পেছনে সরকারের দিক থেকে হয়তো যৌক্তিক কারণ রয়েছে; কিন্তু সরকারের বাইরে থেকে আমাদের কাছে যেটা মনে হয়- পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকাটাই এর অন্যতম কারণ হতে পারে।

শিক্ষানীতি সংসদে পাশ করার পর প্রথম বাজেটে অনেকেই জোরেশোরে অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন- বাজেটে শিক্ষাখাতে যেন এমনভাবে বরাদ্দ দেয়া হয় যাতে তা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক হয়। সেবারের বাজেটে তেমন কোনো বরাদ্দ আসেনি; বরং গতানুগতিক শিক্ষাবাজেটেই পেয়েছিলাম আমরা। এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনাও হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল- নিজেদের তৈরি করা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে খোদ সরকারই কি আগ্রহী নয়? বর্তমান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।

এই অর্থ শুধু একটি নির্দিষ্ট বছর নয়, বরং একটানা কয়েক বছর ধরে বাজেটে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ করতে হবে। শিক্ষানীতিটি কীভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তার জন্য একাধিক প্রস্তাব আছে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। যে প্রস্তাবটিই শিক্ষামন্ত্রী গ্রহণ করুন না কেন, অর্থের সংস্থাপন করা ছাড়া কোনোটিই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আর এর প্রতিফলন দেখতে চেয়েছিলাম আমরা সেই শুরু থেকে। কিন্তু প্রতি বছরই হতাশ হয়েছি আমরা। গতানুগতিক বাজেটে শিক্ষার জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ রাখা হতো, গত দুই বছরের বাজেটে সেই পরিমাণ বা কিছু কমবেশি বরাদ্দই রাখা হয়েছে।

বাজেটে শিক্ষা উপেক্ষিত, শিক্ষানীতি একপ্রকার উপেক্ষিত। বরং অনেকের মতে, স্বাভাবিক অবস্থায় একটি বাজেটে শিক্ষা বরাদ্দে জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দের দাবি করা হয়ে থাকে, বর্তমান বরাদ্দ তার চেয়েও কম। বিভিন্ন হিসাবনিকাশ করে বলা হয়, একটি দেশে তাদের জাতীয় বাজেটের ২৫ শতাংশ কিংবা জিডিপির ৮ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ রাখা উচিত। এই হিসাবটি ইউনেস্কোর করা। সারা বিশ্বে এই মাইলফলকটি মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এই বরাদ্দের হার জিডিপির মাত্র ২.৩ শতাংশ যা কিনা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায়ও কম।

বর্তমান শিক্ষানীতির জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে আশা করি, সেটি ছাড়া শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সরকার সে ব্যাপারে যে ওয়াকিবহাল নয়, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারপরও কেন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে বাজেটে শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে না, সেটি পরিস্কার নয়। হয়তো বলা হবে, সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ নেই। কিন্তু সরকার চাইলে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ করা খুব কঠিন কিছু বলে মনে হয় না। সরকার এখন সাহস করে দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতুর মতো বিরাট কাজ হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নানাভাবে এই অর্থ প্রতি বছর কিছু কিছু করে বরাদ্দ দেয়া হবে।

এই কাজটিও শিক্ষানীতির জন্যও করা যেত। তাছাড়া বাজেটের অনেক খাত আছে যেখানে রাশ টেনে ধরা হলে সেই অর্থগুলো শিক্ষাখাতে ব্যয় করা যায়। কিংবা শিক্ষানীতির জন্য যদি খুব বেশি বরাদ্দ না-ও দেয়া যায়, তাহলে ইউনেস্কোর পরামর্শ অনুসারে বাজেটের ২৫ ভাগ কিংবা জিডিপির ৮ ভাগ বরাদ্দ রাখা হলেও তা দিয়ে শিক্ষানীতির অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সুতরাং যেদিক দিয়েই ভাবা হোক না কেন, চাইলে শিক্ষার উন্নয়নের জন্য এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা যায়। এক্ষেত্রে মূলত যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছা।

আসন্ন বাজেট হবে বর্তমান সরকারের সর্বশেষ বাজেট। যে ধরনের বাজেট আমরা সরকারের কাছ থেকে আরও দুই-তিন বছর আগে থেকেই আশা করে আসছিলাম, এবার সেটা পূরণ হয়ে যাবে বলে মনে করি না। কিন্তু আশা রাখতে চাই যে, সরকার শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য এমন পরিমাণ বরাদ্দ রাখবে যা থেকে বুঝা যাবে যে, সরকার শুধু একটা নীতি বানিয়েই খালাস নয়, সেটি বাস্তবায়নের জন্যও তারা আন্তরিক। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ রাখতে হবে মানুষের মধ্যে এবং সেটি দৃশ্যমান হবে যদি তার প্রতিফলন দেখা যায় বাজেটে। প্রয়োজনে অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী একসঙ্গে বসুন এবং তারপর এ ব্যাপারে একটি কৌশল নির্ধারণ করুন। যে কাজটি করতে আপনারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেই কাজের একটা দৃশ্যমান প্রতিফলন দেখতে চাই আমরা।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version