বাংলা ভাষার প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল প্রাপ্তির ঘটনা শতাব্দীকাল প্রাচীন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পত্রপত্রিকায় তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে বিপুল যে প্রচারণা হয়েছিলো, সে সবের খুব সামান্য অংশ বহুজনের চেষ্টার পর জানা সম্ভব হয়েছিলো। আধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেটের আবিষ্কার ও প্রসারের ফলে ক্রমে ক্রমে এই প্রচারণাগুলো এখনও উন্মোচিত হয়ে চলেছে বিশ্ব পাঠকের নিকট। আধুনিক ও যুগান্তকারী ইন্টারনেটের সহযাত্রী প্রাবন্ধিক ও গবেষক সুব্রত কুমার দাস শতবর্ষ প্রাচীন সেসব তথ্যকে বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন বর্তমান গ্রন্থে। তুলে এনছেন এমন সব বই ও পত্রপত্রিকার পাতা যেগুলোর কথা রবীন্দ্রনাথের সকল জীবনীতেই অনুচ্চারিত, অবহেলিত। সাহিত্যানুরাগীদের জন্য এটি তাই একটি পুরানো দলিল। লেখক সুব্রতকুমার দাস বইটি সম্পর্কে নিজে যা বলেন, “আধুনিক ও যুগান্তকারী প্রযুক্তিটির সাথে এক যুগের বেশিকাল ধরে আমার যে সহযাত্রা তাতে উভয়েরই উর্ধ্বগতি ঘটেছে। এক পর্যায়ে পেয়ে যাই ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত বসন্তকুমার রায় নামের শিকাগো প্রবাসী একজন বাঙালী লেখকের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক গ্রন্থ। উদ্যম সৃষ্টি হয় ভীষণ। সে উদ্যমেই তন্ন তন্ন অনুসন্ধান। পেতে থাকি এমন বই, পত্রিকার পাতা যেগুলোর কথা রবীন্দ্রনাথের সকল জীবনীতেই অনুচ্চারিত, অবহেলিত।”
বিশ্বভ্রামণিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কয়টি দেশে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণে গেছেন তাদের একটি হলো আমেরিকা। ১৯১২-১৯৩০ কাল পর্বে সূদুর দেশটিতে তার মোট পাঁচবার যাত্রা। ১৯১২ থেকে ২৭ অক্টোবর প্রথমবার যখন তিনি আমেরিকায় পৌঁছান ততদিনে ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলি ছাপা হয়ে আসেনি। সে যাত্রায় সারা আমেরিকা জুড়ে তাঁর ভ্রমণের ছাপ পড়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না, যদিও স্থানীয়ভাবে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে নিয়ে আলোচনা– অনুষ্ঠান হয়েছিলো বেশ কটি। দি ডেইলি ইলিনি নামক সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকাটিতে তাঁর উপস্থিতি ও বক্তৃতার সংবাদও ছাপা হয়। ড. সেইমুর নামের অধ্যাপকের রবীন্দ্রবন্দনার কথাও সকলের জানা। মিশিগান, শিকাগো এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বক্তৃতাদানের জন্য আমন্ত্রণ পাওয়াটাও ছিল কবির জন্য বিশেষ সম্মানের। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সাড়ে পাঁচ মাস দীর্ঘ সে যাত্রা শেষ করে কবি লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ১৯১৩ সালের ১২ এপ্রিল। এর ঠিক ছয় মাস পরে প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তি আমেরিকায় তাকে ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। ১৯১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো আটলান্টিক পাড়ের সে দেশটিতে তিনি পৌছলে তাঁকে নিয়ে বিপুল সংবর্ধনার বহু সংবাদ দেশটির পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়।
আমেরিকার শিকাগো শহর থেকে প্রকাশিত মাসিক কবিতা পত্রিকা পোয়েট্রির সাথে বাঙালি সাহিত্যিকদের যোগাযোগের ইতিহাস একশ বছরের পুরনো (১৯১২ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় সেই যোগাযোগের সূত্রপাত। কবি এজরা পাউন্ডের পাঠানো রবীন্দ্রনাথ রচিত ও অনুদিত ছয়টি কবিতা ছাপা হয়েছিলো পত্রিকাটিতে। একই সংখ্যায় পাউন্ডের নিজেরও একটি ছোট লেখা ছাপা হয়েছিলো পত্রিকাটিতে রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে পত্রিকাটির একটি বিশেষ সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ভারত বিষয় নিয়ে। সূচিবদ্ধ লেখকদের অধিকাংশই ছিলেন বাংলা ভাষার সাহিত্যিক। ১৯৬১ সালে নভেম্বরে মাসে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে সে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল কবিকে নিয়ে আমেরিকার বিখ্যাত করি রবার্ট ফ্রস্টের দীর্ঘ মন্তব্য।
অবশেষে আবার সম্ভাবনা তৈরি হয় ১৯৩৭ সালে। ২৮ আগস্ট মেইল পত্রিকাটি “ইন্ডিয়ান পোয়েট ট্যাগর ভিজিটস অস্ট্রেলিয়া” শিরোনামে একটি সংবাদ ছাপে। কলকাতা সূত্রের বরাত দিয়ে সেটিতে বলা হয় যে, কবি খুব শিগগিরই বিশ্বভ্রমণে বের হবেন। যে ভ্রমণে জাভা, শ্যামদেশ, চিন, জাপান, ফিজি, নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা ও ইউরোপের সাথে অস্ট্রেলিয়াও যুক্ত হবে। সংবাদটিতে আরও বলা হয়, ভ্রমণকালে কবি ফিজিতে কর্মরত ভারতীয়দের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন এবং এলাহাবাদে জাতীয় কংগ্রেসের নিকট রিপোর্ট পেশ করবেন। ছোট করে একই রকম সংবাদটি ৭ সেপ্টেম্বর ‘এক্সামিনার’ পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিলো কবির ছবি দিয়ে। কিন্তু রবীন্দ্রপাঠক মাত্রেই স্মরণ থাকার কথা যে, এর কয়েকদিন পরেই ১০ সেপ্টেম্বর কবি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আশঙ্কাজনক উদ্বেগে কাটতে থাকে পরবর্তী দিনগুলো। ১২ অক্টোরব তাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। ফিরতে ফিরতে এক মাস পেরিয়ে যায়। আর এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ পরিকল্পনা শেষ পযন্ত অপূর্ণ থেকে যায় ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বাংলা জীবনী রচিত হয়ে পঠিত হয়েছিলে তার পঞ্চাশতম জন্ম উৎসবে। এর দুবছরের মাথায় তিনি প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে নোবেল পুরস্কার পান। ঠিক একবছর তিন মাস পর কবির জীবন এবং সাহিত্যকর্ম নিয়ে যে ইংরেজি জীবনীটি রচিত হয় সেটির নাম “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: দ্যা ম্যান অ্যান্ড হিজ পোয়েট্রি”। ১৯১৫ সালে নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সে রচনাটির ভুমিকা লিখেছিলেন হ্যামিলটন ওব্লিউ মেবি। প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার সে প্রন্থের লেখক বাঙালি অধ্যাপক বসন্তকুমার রায়। তাঁর গ্রন্থে বহু ইংরেজি প্রবন্ধ-নিবন্ধ সে সময় আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। সেগুলোর কিছু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, অনেকগুলি ভারতীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, এমনকি অন্যান্য বিষয় নিয়েও রয়েছে। এছাড়া বইটির ভুমিকা লেখক হ্যামিলটন সম্পর্কে অন্তত এটুকু বলা যায় যে, তিনি ছিলেন সেকালের আমেরিকার সমালোচক-সম্পাদকদের অন্যতম। প্রায় বিশটি প্রন্থের জনক মেবি সম্পাদনা করেছেন বিশ্বসাহিত্যের বিশাল রচনাবলী।
১৯১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বরে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠির কিয়দংশ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা আবশ্যক। সেখানে কবি লিখেছেন, “সেই লেখকটিকে আমি নানা কারণে অশ্রদ্ধা করি। সে অমার লেখা চুরি করে, আমার সম্পর্কে নানা মিথ্যা গুজব কাগজে রটাচ্ছে, আমেরিকায় আমার বন্ধুর সকলেই তাকে আন্তরিক ঘৃণা করে, সে আমাকে তার বিশেষ বন্ধু বলে সকলের কাছে পরিচয় দিচ্ছে এই কারণেই আমি ওর লেখা বই পড়তেই চাইনি। কোনো না যে লোক আমাকে অন্তরে অশ্রদ্ধা করে সে ব্যবসার খাতিরে আমার স্তব করলেও সে মিথ্যা স্তব আমি কিছুতেই গ্রহণ করতে পারিনা। সেই জন্যে বসন্ত কুমার আমার প্রচুর প্রশংসা করেছে জেনেও ও বই আমি ছুঁতে পারিনি।”
১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ পৃথিবীর বড় বড় সব পত্রিকার সাথে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমসও প্রকাশ করেছিলো। পত্রিকাটি পরবর্তী কয়েক বছর বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ করে কবির আমেরিকা ভ্রমন এবং নতুন বই প্রকাশ করা নিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার এবং নিবন্ধ ছেপেছে। ১৪ নভেম্বর পত্রিকাটি রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে যে সংবাদ ছেপেছিলো, তার শিরোনাম ছিল ‘হিন্দু কবিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে’। ১৯১৩ সালের ২৩ নভেম্বর পৃষ্ঠাব্যাপী প্রতিবেদনে পত্রিকাটি দ্বিতীয়বারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সংবাদ দেয়। শিরোনাম ছিলো হিন্দু কবিকে নোবেল পুরুস্কার দেওয়া হলো।
১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত লেখা কিছু চিঠির একটি ইংরেজি সংকলন প্রকাশিত হয় ’গ্লিম্পসেস অফ বেঙ্গল’ নাম দিয়ে। ১৯২৫ সালে দীনেশচন্দ্র সেন প্রকাশ করেন গ্রামবাংলার লোককাব্যের এক সংকলন ‘গ্লিম্পসেস অফ বেঙ্গল লাইফ’। নোবেল পুরস্কার প্রদানকারী সংস্থার যে ওয়েবসাইট, তাতে ১৯১৩ সালে সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবলিওগ্রাফিতে অনুরুপ শিরোনামের আরও যে একটি গ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটি হলো ‘গ্লিম্পসেস অফ বেঙ্গলি লাইফ’। মাদ্রাজ থেকে ১৯১৩ সালে সে গ্রন্থের প্রকাশ করে প্রকাশণী সংস্থা জি এ নাটিশন। চট্টগ্রাম থেকেও একই সাথে প্রকাশিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। প্রকাশক মিন্টু প্রেম । গ্রন্থটির অনুবাদক রজনী রঞ্জন সেন ছিলেন চট্টগ্রামের সাহিত্যিক ও আইনজীবী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুরাগপ্রাপ্তির ভাগ্য চট্টগ্রাম কলেজের আইনের প্রভাষক রজনীরঞ্জনের ভাগ্যে না ঘটলেও এটি ঐতিহাসিক সত্য যে, তাঁর গ্লিম্পসেস অফ বেঙ্গল-ই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রগল্পের প্রথম ইংরেজি সংকলন। রবীন্দ্রপাঠকরা সবাই উপকৃত হবেন বইটি পড়ে। রবীন্দ্রসাহিত্য এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত লেখার প্রতি ভালোবাসা থেকেই বইটি আমার পড়া এবং রিভিউ করা।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।