বাস্তব জীবনে আমাদের অনেক কিছু লিখতে হয় অফিসিয়াল কারণে, কোন ডকুমেন্ট রাখার নিমিত্তে এবং নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। আমরা যারা পড়াশুনা করছি বা পড়াচ্ছি বা চাকুরি করছি তারা সবাই পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছি, সার্টিফিকেট অর্জন করেছি, আর এসব পরীক্ষার প্রধান অংশই ছিল লিখিত। আমাদের লেখাই আমাদেরকে পরিচিত করিয়েছে পরীক্ষকদের কাছে, চাকুরিদাতাদের কাছে- তাই নয় কি? একজন শিক্ষক ক্লাসের সব ছাত্র-ছাত্রীদের হয়ত চিনেন না, কিন্তু পরীক্ষার খাতা পরীক্ষণের সময় কোনো একটি ভালো খাতা পেলে উক্ত ছাত্র বা ছাত্রীকে চিনে রাখেন বা চিনে ফেলেন। এভাবে লেখা বা ভালো কিছু লেখার দক্ষতা আপনার একটি অমূল্য সম্পদ। আপনি যখন কোনো একটি লেখা পড়েন তখন দেখা যায় অধিকাংশ বিষয়ই অপনার জানা বা পরিচিত, আপনি হয়ত তখন মন্তব্যও করে ফেলেন, ‘এতে নতুন কিছু নেই, এ বিষয়গুলো তো আমিও জানি’ ইত্যাদি। কিন্তু ঐ সাধারণ বিষয়গুলোই সাজিয়ে লিখতে পারাটা অনেক বড় কাজ। আপনি হয়ত চিন্তা করছেন, ভাবছেন কিন্তু লিখছেন না। যিনি লিখেছেন তিনি কিছু একটা সৃষ্টি করেছেন এবং পাঠকের সামনে, মানুষের সামনে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। লেখার দক্ষতা বাড়ানোর উপযুক্ত সময় হচ্ছে ছাত্রজীবন, কারণ এ সময়ে বাধ্য হয়ে অনেক কিছু লিখতে হয়। শিক্ষকদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষার্থীদের লেখার দক্ষতা বৃদ্ধিতে উৎসাহ যোগনো, সহায়তা করা, ক্লু দেওয়া, লেখা উন্নত করার পথ বাতলে দেওয়া। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজ থেকে লেখার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাগত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, সাথে সাথে তাদের ধারণার এবং চিন্তার ব্যাপকতার বিস্তার ঘটাতে পারে শিক্ষকদের সে সকল বিষয়গুলোতে সব সময়ই সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
লেখা একটি প্রাথমিক ভিত্তি যার দ্বারা আপনার কাজ, শিখন এবং বুদ্ধিবৃত্তি বিচার করা হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চাকুরিস্থলে এবং আপনি যেখানে বাস করছেন। লেখা বলে দিচ্ছে আপনি কী ধরনের ব্যক্তি অর্থাৎ আপনার চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, আপনার দর্শন প্রকাশ পাচ্ছে আপনার লেখার মধ্যে। লেখার দক্ষতা স্থায়ী এবং আপনার সাথে সাথেই থাকে। লেখা আপনার অবস্থান পাঠককে বলে দিচ্ছে। একজন পাঠক একটি জটিল বিষয় হয়ত ভালোভাবে বুঝতে পারছে না, আপনার লেখা তা প্রকাশ করে দিচ্ছে, সহজ করে দিচেছ। তৈরি করছে আপনার এবং পাঠকদের মাঝে সেতুবন্ধন।
লেখা আপনার ধারণাগুলোকে পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত করছে। আপনি লিখিত আকারে যখন কোনো ফিডব্যাক কাউকে দিচ্ছেন সেটি তখন পরিশীলিত । লেখা আপনাকে বলে দিচ্ছে আপনার পাঠক কী চাচ্ছে অর্থাৎ আপনার চিন্তার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে আপনার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রেডিবিলিটি এবং ম্যাটিউরিটি প্রকাশ পায়। লেখা আপনাকে উজ্জীবিত করে, আপনি মনে মনে যা ভাবছেন তারও বাইরে যেতে। দেখবেন আপনি একটি বিষয় লিখে ফেলেছেন, পড়ে দেখবেন আপনি যে চিন্তা করেছিলেন তার চেয়েও ভালো হয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গায় এবং সময়ে কতটা সত্য এবং বাস্তবতা প্রকাশ করতে পেরেছেন তারও প্রকাশ এই লেখায়। সর্বোপরি বলা যায়, লেখার দক্ষতা আপনার চাকুরি-বাকুরি এবং রুজি-রাজগারের জন্য দরকার, আপনার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের জন্য দরকার।
কীভাবে বাড়াতে হবে লেখার দক্ষতা। অনেক শিক্ষার্থীই মনে করে আমাদের ভাষা-জ্ঞান কম, অতএব আমরা লিখতে পারছি না। ভাষাজ্ঞান কম এটি একটি সত্য কথা কিন্তু সেই ভাষজ্ঞান যতোটা না বাধা হয় তার চেয়ে কোনো কিছু লিখতে ধারণা বা চিন্তার ক্ষমতা না থাকা। যেমন একজন শিক্ষার্থীকে ‘পরিবেশ বিপর্যয়’ নিয়ে কিছু লিখতে বলা হলো, দেখা যাবে সে বই-পত্র খোঁজাখুজি শুরু করে দিয়েছে। বই খোঁজাখুজি করা খারাপ নয় যদি অতিরিক্ত কিছু ধারণা সেখান থেকে নেয়ার থাকে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা যা করে তা হচেছ ঐ বইয়ে যা লেখা আছে তার পুরোটাই মুখস্থ করে লিখে ফেলে। এতে নিজের যে ধারণাগুলো ছিল সেগুলোকে প্রকাশ করার সুযোগ দেয়া হলো না, নিজের ভাষা ব্যবহার করার যে সুযোগ তৈরি হলো সেটিও হতে দেওয়া না। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে শিক্ষকগণও শিক্ষার্থীদের নিজের লেখার কোনো গুরুত্ব দেন না বা মূল্যায়ন করেন না। নিজে লিখতে গেলে কিছুটা ভুলভ্রান্তি হতে পারে; শিক্ষককে সেগুলো বুঝে ক্রিয়েটিভিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি ছাত্রছাত্রীদের প্রচুর উৎসাহ দিতাম যাতে নিজেরা কিছু লিখতে পারে, কেন লিখবে নিজে, কী উপকার হবে ইত্যাদি বুঝিয়ে দিতাম। তারপরেও কিছু কিছু শিক্ষার্থীদের উত্তর, “স্যার, এত কষ্ট করে লাভ কী? বইয়ে তো ভালো করে লেখা আছে। হুবহু ঐটি লিখে দিলেই তো অনেক নম্বর পাওয়া যায়, ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কম।” অন্য এক শিক্ষার্থীর উত্তর, “স্যার, নিজে লিখতে গেলে তো অনেক ভুল হয়, নিজে লিখে দেখেছি স্যাররা নম্বর দেন না বরং ভুল হওয়ার জন্য প্রচুর বকাঝকা করেন।” এখানে একটি বড় সমস্যা রয়ে গেছে। শিক্ষকগণ নিজেরা সৃজনশীলতার চর্চা করেন না, শিক্ষার্থীদের চর্চা করতে দেন না। করলে নিরুৎসাহিত করেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। এই অভ্যাস আমাদের পরিহার করতে হবে।
জীবনে ক্যারিয়ার পাথ তৈরি করতে এবং লক্ষ্যে পৌঁছুতে লেখার দক্ষতা অর্জন করা দরকার। মনে রাখতে হবে লেখা ভাব আদানপ্রদানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমাদের কথা আমরা দূরবর্তী মানুষের জন্য, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য লেখার মাধ্যমে রেখে যাই বা পৌঁছাতে পারি। আমারা জীবনে সবাই বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই। পরীক্ষার বিরাট অংশটাই থাকে লেখা। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আমাদের লেখার দক্ষতা প্রদর্শন করতে হয়। আর তার মাধ্যমে জীবনের পরবর্তী অংশের সাফল্য ও ব্যর্থতাও নির্ণিত হয়। লেখার দক্ষতা না থাকলে ভুল তথ্য সংযোজিত হয় কর্তৃপক্ষের নিকট উল্টো প্রমাণিত হয় আমাদের যোগ্যতা। লেখার মাধ্যমে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে আপনি কে? কী বলতে চান? আপনি উপস্থিত নেই কিন্তু আপনার লেখা অপনাকে সবার কাছে পরিচিত করাবে। অতএব আসুন আমরা লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি ।
লেখার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আপনাকে প্রচুর পড়তে হবে। পড়তে হবে নতুন নতুন ধারণা নেওয়ার জন্য কোন বিষয়ে, এতে ঐ বিষয়টি সম্পর্কে আপনার চিন্তার প্রসারতাও বাড়বে। সাথে সাথে আপনার ভাষাগত দুর্বলতাও কেটে যাবে। আপনি একটি লাইন বা দুইটি তথ্য উপস্থাপন করতে চান আপনার লেখায় কিন্তু কীভাবে লিখবেন বুঝতে পারছেন না, বিভি্ন্ন সূত্রের পড়া আপনাকে সাহায্য করবে। (সূত্রগুলো হচ্ছে- সংবাদপত্র, বাংলা ও ইংরেজি, গল্পের বই, ক্লাস, শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপচারিতা, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আলাপচারিতা, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ, ইন্টারনেট ইত্যাদি)। আমাদের চারপাশের বিভিন্ন সূত্র থেকেও আমরা আমাদের লেখার উপকরণ সংগ্রহ করতে পারি।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।