‘সবাই ভালো ছাত্র হয় না, তবে সবাই ভালো মানুষ হতে পারে’- শিক্ষার লক্ষ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। আর মানুষ (ভালো মানুষ) গড়ার মূল দায়িত্ব শিক্ষকগণের উপর ন্যস্ত। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতোটা ভালো তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কিনা। শুরুতেই একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া দরকার, শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়; এটা ব্রত। শিক্ষকতার প্রতি যদি আপনার ভালোবাসা না থাকে, তাহলে সেটি আপনার নিকট পেশা ছাড়া আর কিছুই নয়।
শিক্ষকতায় আসার আগে আপনি নিশ্চয় জেনে এসেছেন যে, আপনাকে কী করতে হবে আর আপনি বিনিময়ে কী পাবেন? তাহলে প্রাপ্যতার স্বল্পতার দোহাই দিয়ে আপনি আপনার কাজে অবহেলা করতে পারেন না। মানুষ চাইলেই তার প্রয়োজনকে সীমিত করতে পারে। “আমার প্রয়োজন খুব সামান্য, আর চাহিদা তার চেয়ে কম”- এ কথাটা যদি আপনি বলতে পারেন তবে শিক্ষকতা আপনার জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট। যদি আপনি শিক্ষকতাকে ভালবাসতে না পারেন, শিক্ষাদানে আনন্দ না পান, তাহলে বলব এটা আপনার জন্য নয়। আপনি শ্রেণীকক্ষে আদর্শ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। আপনি যেহেতু মানুষ গড়ার কারিগর, তাই আপনাকে সর্বদা সচেতন হতে হবে। আপনার কোনো ভুলের কারণে যেন কোনো শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। শিক্ষার্থী অপেক্ষা আপনাকে বেশি পড়তে হবে, জানতে হবে এবং জানাতে হবে। মনে রাখবেন, “একজন শিক্ষক সবসময়ই একজন ছাত্র তবে ভালো ছাত্র।” শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শিখবে, আপনি শুধু দেখিয়ে দিবেন কীভাবে শিখতে হয়।
বিদ্যালয়ের সাথে সাথে তিনি সমাজেরও শিক্ষক। বিদ্যালয়ের উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজের উন্নয়নও শিক্ষক কর্তৃক প্রভাবিত। যিনি শিক্ষক তিনি সর্বস্থানেই একজন শিক্ষক- এ কথাটা স্মরণ রাখা দরকার। শ্রেণীকক্ষে সকলের প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ থাকাটা জরুরি। আপনি যদি ভদ্র ব্যবহার প্রত্যাশা করেন, তবে আপনাকেও ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। শিক্ষার্থী সে যতো ছোটই হোক না কেনো, তারও সম্মান আছে, সেটা তাকে দিতে হবে।
পারতপক্ষে শ্রেণীকক্ষে শাস্তি দেয়াটা উচিত নয়। কেউ একটি বিষয় পারে না, আবার কেউ পেরেও করে না- এ দুটি বিষয় কিন্তু আলাদা। কেউ যখন পেরেও করতে চায় না, তখন তার কাছ থেকে কাজ আদায় করতে শিক্ষক যে কোনো পথ বেছে নিতে পারেন; তবে শাস্তি দেয়াটা অমানবিক। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা দেয়া যাবে, তবে তারও একটি গণ্ডি বা সীমানা থাকা জরুরি। শিক্ষক তিনি একজন আদর্শ ব্যক্তিত্ব, তিনি বিদ্যালয় ও সমাজের নেতা। তিনি যদি এই বোধকে ধারণ করতে পারেন তাহলে শিক্ষার্থীদেরকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি যে পথেই অগ্রসর হোন না কেন, সেখানে প্রশ্ন তোলাটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। তবে শিক্ষককে অবশ্যই একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হবে। আর আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কতগুলো বিষয় নিজের মাঝে গড়ে তুলতে হবে-
ক) সুন্দর বাচনভঙ্গি;
খ) আকর্ষনীয় উপস্থাপনা কৌশল;
গ) সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতা;
ঘ) দূরদর্শী;
ঙ) কৌশলী;
চ) বন্ধুবাৎসল্য;
ছ) কাজের প্রতি ভালোবাসা;
জ) অপরের মতামতের প্রতি গুরুত্ত দেয়া;
ঝ) ভালো শ্রোতা হওয়া;
ঞ) পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ;
ট) আদর্শবোধে উজ্জীবিত হওয়া;
ঠ) সহনশীলতা;
ড) পারষ্পারিক সহযোগিতার মনোভাব; ও
ঢ) জ্ঞানপিপাসু।
এ ছাড়াও অনেক গুণাবলী আছে যেগুলো নিজের মধ্যে সন্নিবেশ এবং চর্চা করতে হবে।
আপনি যদি শিক্ষকতাকে ভালোবাসেন তাহলে এটা আপনার জন্য উপযুক্ত এবং যথেষ্ট। কীভাবে আপনি আরও ভালোভাবে শিখন-শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবেন প্রতিনিয়ত আপনাকে তা ভাবতে হবে। শিক্ষকতা একটা সেবামূলক কাজ। তাই অর্থের সাথে এর তুলনা না করাই শ্রেয়। বলা হয়ে থাকে যে, “শিক্ষককে দেখেই মনে হবে, তাঁর মনে অপার শান্তি বিরাজ করছে।” কিন্তু নানা প্রতিকুলতার মাঝে হয়ত কখনও কখনও তাঁদের মূখ ম্লান হয়ে যায়। তাঁদের মুখের হাসি ধরে রাখতে কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেয়াটা যেমন জরুরি; তেমনি সমাজের মানুষেরও একটা দায়িত্ব আছে। বিদ্যালয় আমাদের সমাজকে গড়ে তোলে, সংরক্ষণ করে। তাই আমাদের উচিত বিদ্যালয়কে সাহায্য করা। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুই ধরনের মানুষের প্রয়োজন কখনই শেষ হবে না- এক) শিক্ষক, দুই) চিকিৎসক। শেষ করছি স্যার মোজাফফর আহমেদের একটি লেখা থেকে দুটি লাইন তুলে ধরে- “শিক্ষকতা একটা ধর্ম, একে জীবনে ধারণ করতে হয়; জ্ঞানীমাত্রই শিক্ষক নন।”
লেখক পরিচিতি
জি. এম. রাকিবুল ইসলাম বাংলাদেশের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত।