করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সুইডেনের পরে ইউরোপে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে নেদারল্যান্ডস। সংক্রমণের উচ্চহার, মৃত্যু, ভ্যাক্সিনের অপ্রতুল সরবরাহ— সব মিলিয়ে নেদারল্যান্ডস যারপরনাই নাজেহাল। নেদারল্যান্ডসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ধরা হয় শিক্ষাকে। প্রাইম মিনিস্টার মার্ক রুতে তাঁর করোনা ভাষণে বারবার শিক্ষাকে এক নম্বরে রেখে কথা বলেছেন। করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা নিয়ে তিনি সচেতন প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেছেন।
অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের জন্যে যথেষ্ট নয়, তাই নানারকম কৌশলের মাধ্যমে করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা চালু রাখার চেষ্টা করেছেন। শিশুদের যন্ত্রের চেয়ে মানুষের সংস্পর্শ বেশি প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্যে প্রথমে নিয়ম ছিলো, একদিন একটি ক্লাসের শিক্ষার্থীরা আসলে পরদিন আসবে অন্য ক্লাসের। পরের দিকে অবশ্য সবাইকেই আসতে দেয়া হলো। মাধ্যমিকে ক্লাস ভাগ করলেন। একদিন ক্লাসের পঞ্চাশ ভাগ স্কুলে এসে ক্লাস করবে; বাকি পঞ্চাশ ভাগ অনলাইনে সেই ক্লাস অনুসরণ করবে। আগেরদিন যারা অনলাইনে ক্লাস করেছে, পরেরদিন তারা স্কুলে আসবে। বাকিরা সেই ক্লাস অনলাইনে ফলো করবে। প্রথমবার লকডাউনে সব স্কুল অনলাইন থাকলেও দ্বিতীয়বার লকডাউন ও কার্ফিউ যখন চলছিলো, তখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল খোলা ছিলো। অপরদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস চলছিলো।
করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা কার্যক্রমে কিছু পরিবর্তন এসেছে স্বাভাবিকভাবেই। মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে দেড় মিটারের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং ক্লাস চলাকালেও মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক। সামাজিক দূরত্ব মেনে স্কুলের পাঠাগার এবং শরীরচর্চা কেন্দ্র খোলা; তবে স্কুলের ক্যান্টিন বন্ধ। সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, নাটক, নাচ-গানের অনুষ্ঠান, ডিস্কো, ফান নাইট ইত্যাদিও সব বন্ধ। শিশুরা দেশের ভেতরে যেসব শিক্ষাসফর বা দেশের বাইরে যেসব এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যায় কিংবা ভিন্ন দেশ থেকে নেদারল্যান্ডসে শিশুরা আসে, সেসবও পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কোনো শিশুর করোনার কোনোরকম লক্ষণ থাকলে তার স্কুলে আসা নিষেধ এবং তাকে অনলাইনে ক্লাস করতে বলা হয়েছে। যদি কোনো শিক্ষার্থী বা শিক্ষক করোনা পজিটিভ হতো, সাথে সাথে তা স্কুলে জানানোর নিয়ম ছিলো। তার আশেপাশে যারা ছিলো, তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক করোনা পরীক্ষা করতে হতো। কোনো বাসায় কেউ করোনা পজিটিভ থাকলে বাসার সবাইকে কোয়ারেনটিনে থাকতে হতো। সেক্ষেত্রে সেই শিক্ষার্থীও স্কুলে আসতে পারতো না, অনলাইনে ক্লাশ করতে হতো।
করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে মূল্যায়নেও। প্রথম বছরে সারা বছরের স্কুলের ফলাফল আর অ্যাসাইন্টমেন্টের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হলেও দ্বিতীয় বছরে অর্থাৎ এ-বছরে পরীক্ষার জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি বছরের শুরু থেকেই নেয়া হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে পরীক্ষার হল তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে যেনো যথেষ্ট দূরত্ব থাকে, সেদিকে নজর দেয়া হয়েছে। পরীক্ষার সময়টাকেও দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যারা পরীক্ষার সময় করোনায় আক্রান্ত থাকবে, তাদের জন্যে আবার দ্বিতীয়বার পরীক্ষার রুটিন রাখা হয়েছে। দুই পরীক্ষায় দুই প্রশ্নপত্র দেয়া হবে। ইতিমধ্যে মে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অনলাইনের পাশাপাশি ক্লাসরুমে ক্লাস শুরু হয়েছে। ভ্যাক্সিন কার্যক্রম এগিয়ে গেলে পুরোপুরি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে বলে সরকার জানিয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। সরকারী ভাষ্যমতে, করোনাক্রান্ত রোগীদের পরে চিকিৎসকদের কাছে দ্বিতীয় স্থানে ছিলো মানসিকভাবে পীড়িত মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের ভিড়। অনেককেই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বন্ধুহীন, একাকীত্ব, অনলাইন ক্লাশ, আত্মীয়-স্বজনের সাহচর্যহীনতার মানসিক চাপ অনেক শিশুই নিতে পারেনি। প্যানিক অ্যাটাক, বিষণ্নতায় আক্রান্ত বারো থেকে আঠারো বছরের অনেক শিশুকেই ডাক্তার ও ওষুধের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। মানুষের জীবনে মানুষের সাহচর্য কতো গুরুত্বপূর্ণ এটি আবারও প্রমাণ হলো। বিষণ্নতা আর একাকীত্বের সাহায্য দেয়ার জন্যে আলাদা হেল্পলাইন খোলা হয়েছে। প্রাইম মিনিস্টারের ভাষায়, করোনায় নেদারল্যান্ডসের শিক্ষা বা সার্বিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে অত্যন্ত দুঃখজনক অংশ এটি। আজ স্কুল খোলা, কাল লকডাউন, পরশু অনলাইন ক্লাশ ইত্যাদি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির ভুক্তভোগী শিশুরা। অনলাইন ক্লাশে অনেক শিশুর মনোসংযোগের বিরাট ব্যাঘাত ঘটে। বলা বাহুল্য, মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই আশানুরূপ ফলাফল পায়নি। এখানে যেহেতু অটোপাশ বা গ্রেস পদ্ধতি নেই, দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেককেই হয়ত আবার এই ক্লাসটি বা বছরটি পুনরায় পড়তে হবে।
নেদারল্যান্ডসে এখন সপ্তাহে এক মিলিয়ন মানুষকে ভ্যাক্সিন দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। আশা করা হচ্ছে, জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে প্রত্যেকে অন্তত টিকার প্রথম ডোজটি পেয়ে যাবে। তাতে সংক্রমণ কমে আসবে। পরিকল্পনামতো কাজ হলে, প্রথম যেই সেক্টরটিকে পুরোপুরিভাবে চালু করা হবে সেটি হলো শিক্ষা। প্রচুর ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়েছে, সেটিকে পুনরুদ্ধার করার সর্বোত চেষ্টা করা হবে।
লেখক পরিচিতি
তানবীরা হোসেন শিক্ষা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।