চিররঞ্জন সরকার লিখেছেন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বিরোধিতা নিয়ে
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তখন যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসারত। তাঁর ওই অবস্থা নিয়ে সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন। ‘আমরা চাঁদা তুলে মারব কীট/… বসন্তে কোকিল কেশে কেশে রক্ত তুলবে সে কীসের বসন্ত!’ এই কবিতাটাই মনে পড়ে গেল সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা ধরনের উদ্যোগ-আয়োজন দেখে।
কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ থেকে বাঁচতে দীর্ঘদিন ধরে থেমে গেছে দেশের স্বাভাবিক কার্যক্রম। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এ ছুটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে বলে সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকসহ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকেরা উদ্বিগ্ন। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সেশনজটের কবলে পড়ে যায় কিনা, সেই আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারি হিসেবে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ, সব স্তর মিলিয়ে দেশে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন কোটির বেশি। মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই বন্ধ রয়েছে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ দূর এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে ঘরে থেকেই শিক্ষাকার্যক্রম, বিশেষত অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম, চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি, প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য গণমাধ্যম ও টেলিযোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানোরও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
বিশ্বমহামারির এই জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিছু শিক্ষক অনলাইন অ্যাসাইনমেন্ট এবং হোমওয়ার্ক নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা টিভিতে ক্লাস নিচ্ছেন।
অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে অনেকেই আবার সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছেন। একথা ঠিক যে, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রযুক্তি ব্যবস্থা এখনও অনলাইনে ক্লাস করার মতো উপযুক্ত হয়নি। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা এখনও সারাদেশে সমানভাবে উন্নত নয়।
একথা ঠিক যে, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশের প্রযুক্তি ব্যবস্থা এখনও অনলাইনে ক্লাস করার মতো উপযুক্ত হয়নি। বিশেষ করে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট ব্যবস্থা এখনও সারাদেশে সমানভাবে উন্নত নয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ বেশ দুর্বল। এছাড়া আমাদের ইন্টারনেট সেবার মানও তেমন ভালো নয়। একদিকে রয়েছে গতির সমস্যা, অন্যদিকে দামও চড়া। বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতেই হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে ইন্টারনেট কিনে ক্লাস করার বিষয়টা অনেকের আর্থিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে।
এ ছাড়া অনলাইনে ক্লাস করার জন্য শিক্ষার্থীর একটা ল্যাপটপ বা ভালো স্মার্টফোন প্রয়োজন। কিন্তু অনেক শিক্ষার্থীর ল্যাপটপ নেই। অনেক শিক্ষার্থীর ভালো স্মার্টফোনও নেই। তাই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার বিষয়টি ফলপ্রসূ হলেও সেটা বাস্তবায়ন সহজ হবে না।
অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে অনেক সমস্যা আছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাই বলে মাসের পর মাস হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকাও তো বাস্তবসম্মত নয়। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের আয়োজনকে তাই বাতিল করে দেওয়া যায় না।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অনেকেই মুখর হয়েছেন। এমনকি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও করছেন। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের যারা বিরোধী তাদের যুক্তিটা আপাত শ্রুতিমধুর, কারণ তা গরিবদরদি। ঠিকই তো, যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা কীভাবে করবে এই অনলাইন ক্লাস? বিশেষত যখন এ দেশের অনেক ছাত্রছাত্রীই দারিদ্র্য-সীমার নীচে বাস করে। ব্যবস্থাটা বৈষম্যমূলক, সন্দেহ নেই।
কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, ব্যবস্থাটা আপৎকালীন। প্রায় দুই মাস হতে চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট টিউশন, সবই বন্ধ। শিক্ষা এমন একটা প্রক্রিয়া, যা ধারাবাহিক অভ্যেসের ওপর নির্ভরশীল। তাই আপাতত যে কজনকে পাওয়া যাচ্ছে তাদের নিয়েই যদি চর্চাটা জারি রাখা যায়, ক্ষতি কী?
উল্লেখ্য, অনলাইন ক্লাস নেওয়ার বিষয়ে কোনও সরকারি নির্দেশিকা জারি করা হয়নি। হলে, তা অবশ্যই অসঙ্গত হত। কারণ তাতে চিরাচরিত ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে এই আপৎকালীন বন্দোবস্ত বৈধতা পেয়ে যেত। এবং ভবিষ্যতে স্কুল খোলার পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নতুন করে পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ করার দায় থাকত না। কিন্তু এখন যাঁরা অনলাইন পড়াচ্ছেন, সেটা তাদের স্বেচ্ছাশ্রমের অতিরিক্ত কিছু নয়। যা কিছু তাঁরা অনলাইন পড়াচ্ছেন, স্কুল খোলার পর আবার সেগুলি নতুন করে পড়াতে তাঁরা বাধ্য থাকবেন।
কিন্তু, এই সিস্টেমে সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে একযোগে পাওয়া যাচ্ছে না— এই কারণ দেখিয়ে যদি ব্যবস্থাটাকেই বাতিল করে দেওয়া হয়, সেটা ভুল। কারণ, যে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অকস্মাৎ আজ এই ‘সাম্যবাদ’ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে, আবহমান কাল ধরেই তারা বঞ্চিত ছিল, আছে এবং থাকবে।
অথচ ইতিপূর্বে তাদের জন্য এমন ‘কুম্ভীরাশ্রু’ ঝরেনি। আজ যে ছাত্র বা ছাত্রীটির স্মার্টফোন নেই বলে তাকে বঞ্চিত মনে করা হচ্ছে, মাত্র দুই মাস আগেও তার পেটে ভাত ছিল কি না, বই-খাতা-কলম ছিল কি না, অর্থ উপার্জনের জন্য তাকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে কোনও কাজ করতে হত কি না— তা এক বারও খোঁজ নিয়ে দেখার প্রয়োজন পড়েনি। স্বাভাবিক সময়ে সচরাচর কত শতাংশ ছাত্রছাত্রী ক্লাস করে?
দেখেশুনে মনে হয়, এ আসলে সেই ‘বঞ্চনার ন্যারেটিভ’ তৈরি করে একাধারে দায়িত্ব এড়ানো এবং নিজেদের প্রগতিশীল প্রতিপন্ন করার চিরন্তন কৌশল। এক শ্রেণির তত্ত্ববিদ এই কাজটিতে অত্যন্ত দক্ষ। যে কোনও ভালো উদ্যোগেই তাঁরা একদল ‘বঞ্চিত’-কে খুঁজে বের করেন, এবং তাদের শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আড়াল থেকে অস্ত্রবর্ষণ করে উদ্যোগটিকে ভেস্তে দেন।
এ দেশের কোনও স্কুলের কোনও শ্রেণিতেই একটি সাধারণ শিক্ষাদিবসে ষাট-সত্তর শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে উপস্থিত থাকে না। তাদের একটা বড় অংশ আবার নিয়মিত ভাবেই গরহাজির থাকে। তা, সেই ছেলেমেয়েদের অনুপস্থিতি-জনিত কারণে কোনও দিন কোনও ক্লাস স্থগিত হয়েছে কি? দেখেশুনে মনে হয়, এ আসলে সেই ‘বঞ্চনার ন্যারেটিভ’ তৈরি করে একাধারে দায়িত্ব এড়ানো এবং নিজেদের প্রগতিশীল প্রতিপন্ন করার চিরন্তন কৌশল। এক শ্রেণির তত্ত্ববিদ এই কাজটিতে অত্যন্ত দক্ষ। যে কোনও ভালো উদ্যোগেই তাঁরা একদল ‘বঞ্চিত’-কে খুঁজে বের করেন, এবং তাদের শিখণ্ডী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আড়াল থেকে অস্ত্রবর্ষণ করে উদ্যোগটিকে ভেস্তে দেন।
একটি কথা স্বীকার করতেই হবে যে, শ্রেণিকক্ষের পুরোপুরি বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আছে। বাংলাদেশে এখনও অনেক শিক্ষক আছেন, যারা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম বিষয়ে প্রশিক্ষিত নন। তাছাড়া, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়েরই প্রযুক্তিজ্ঞান নিয়ে সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু এটাও তো ঠিক যে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ আর কতদিন ধরে আমাদের সবাইকে মোকাবেলা করতে হবে তা একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়।
তবে গবেষকদের অনুমান, এ সংক্রামক ব্যাধিটি বিশ্বাবাসীকে আরও অনেক দিন ভোগাতে পারে। তাই এমন দীর্ঘমেয়াদি ক্রান্তিকালে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে ইন্টারনেট ডেটা প্রদান করা যেতে পারে। অথবা ফ্রি বেসিক পদ্ধতির মতো পাঠদান ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা কোনো ইন্টারনেট ডেটা চার্জ ছাড়াই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। অথবা ইউনিয়ন পরিষদ বা স্থানীয় ই-তথ্য সেবাকেন্দ্রে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন দ্রুতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মূল কথা যন্ত্রপ্রযুক্তির সুফলকে কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কেবল ‘গরিবি’ যুক্তি দেখিয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিরোধিতা করলে শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা। পিছিয়ে পড়বে দেশ।
লেখক পরিচিতি
সম্পাদক বাংলাদেশের শিক্ষা
এই লেখাটি সম্পাদক কর্তৃক প্রকাশিত। মূল লেখার পরিচিত লেখার নিচে দেওয়া হয়েছে।