কনজেনিটাল সিফিলিস

১৯৪৯ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশ ভাগ হবার পর আমেরিকা ভ্রমণে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান তাঁকে স্বাগত জানিয়ে নতুন দেশের স্বপ্ন, সমস্যা, আশা ইত্যাদি জানতে চান। এর পর ট্রুম্যান নেহেরুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, নতুন দেশ, তোমরা আমাদের কাছে কী চাও? আমরা তোমাদের জন্য কী করতে পারি? 

জবাবে নেহেরু বলেছিলেন, আমরা চাই যে, তোমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সহযোগিতা কর। আমরা চাই, তোমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিনিয়োগ কর। নেহেরু আরও বলেছিলেন, আমরা চাই তোমরা আমাদের জন্য এমআইটির (ম্যাসাচুসেস্টস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি) মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে দাও।

এর ফলে দ্রুতই আমেরিকার সহযোগিতায় ভারতে গড়ে ওঠে বিশাল পরিসরের ভারতের আইআইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। নেহেরু আরও চেয়েছিলেন ভারতের কৃষি গবেষণা ও চাষাবাদ প্রযুক্তি ও শিক্ষার উন্নয়নে সহযোগিতা যাতে আমেরিকার মতো আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তিতে এগোনো যায়, ফলন বৃদ্ধি পায়। সেটিতেও আমেরিকা গোঁড়াপত্তন করে দিয়েছিলো। যার ফলে কৃষি গবেষণায় ভারত অনেক এগিয়ে যায় যার ফল বাংলাদেশও পেয়েছে, কারণ তিন দিকে ভারত থাকার ফলে তাদের উন্নত কৃষিপ্রযুক্তি দ্রুতই বাংলাদেশে নানাভাবে প্রবেশ করেছে ও দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করেছে।

একইভাবে পাকিস্তানের নেতৃত্ব আমেরিকা সফরে গেলে পাকিস্তানিরা বলেছিলো, আমরা হিন্দু ও কমিউনিস্ট ঠেকাতে অস্ত্র ও সামরিক সাহায্য চাই। আমাদের এতোগুলো যুদ্ধবিমান, এতোগুলো ট্যাংক ও এতোগুলো যুদ্ধজাহাজ দরকার। আমাদের আছে বিশাল সেনাবাহিনী, তারা তোমাদের হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় কমিউনিজম ঠেকাবে, তাদের বেতনের টাকা নাই। তাদের জন্য টাকা দাও।

আমেরিকা পাকিস্তানকেও তারা যা চেয়েছিল তাই দেয়। কোরিয়া-যুদ্ধফেরত প্রচুর ব্যবহৃত যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও যুদ্ধজাহাজ পাকিস্তান পায়। সাথে পায় সাড়ে পাঁচ ডিভিশন সৈন্যের বেতন ও খরচ। এইসব দিয়েই পাকিস্তান চলেছে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। তবে আমেরিকা একটি শর্ত দিয়েছিলো, এইসব অস্ত্র তারা ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না। ১৯৬৫ এর যুদ্ধে তারা সেই শর্ত ভঙ্গ করলে সেই সাহায্য কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়।  

কিছুদিন আগের খবর হলো, নেহেরুর স্বপ্ন সেই আইআইটি বোম্বের গ্রাজ্যুয়েট পরাগ আগ্রাওয়াল হয়েছেন টুইটারের সিইও। তার আগে সত্য নাদেলা কর্ণাটকে মনিপাল ইনিস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে গ্রাজ্যুয়েট হয়ে হয়েছেন মাইক্রোসফটের সিইও, সুন্দর পিচাই আইআইটি খড়গপুর থেকে গ্রাজ্যুয়েট হয়ে হয়েছেন গুগল আলফাবেটের সিইও, সান্তনু নারায়ণ হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজ্যুয়েট হয়ে হয়েছেন অ্যডোবের প্রেসিডেন্ট ও সিইও, অরভিন্দ কৃষ্ণ কানপুর আইআইটি থেকে গ্রাজ্যুয়েট হয়ে হয়েছেন আইবিএমের সিইও। এই পদগুলো অধিকার মানেই তাঁরা যে মেধার আধার সেটি নয়, তবে এটি নিশ্চই প্রমাণ করে যে ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মেধাগুলোকে নানারকম ফাঁদে ফেলে আটকে দিচ্ছে না।

অপরদিকে পাকিস্তান তার কাঙ্ক্ষিত অস্ত্র পেয়ে যেচে পড়ে যুদ্ধ বাধিয়েছে, এমনকি নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধেও। জন্মের শুরু থেকেই যুদ্ধ করেছে তারা এবং তারা শুরু করেছে চারটি বড় যুদ্ধ যার সবগুলোতেই তারা হেরেছে। আমেরিকা পাকিস্তানকে উদার হস্তে অস্ত্র আর সামরিক সাহায্য করে গেছে যার ভাগ আমাদের সশস্ত্র বাহিনীগুলোও একসময় পরিমাণে কম হলেও পেয়েছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুরু থেকেই মনের আনন্দেই বহন করে চলেছিল পাকিস্তানি আদর্শই। যেখানে রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষা ছিল দ্বিতীয় স্থানে, প্রথম হলো সশস্ত্র বাহিনী। আমার কথা মানতে মন না চাইলে প্রতি বছরের বাজেট মিলিয়ে দেখুন। আমাদের পরিণতিও সেই পাকিস্তানের দিকেই। আমরাও কোনো প্রতিবেশীর সাথে ফর্মাল সামরিক যুদ্ধে জিতব না এটা নিশ্চিত, কারণ ভারতের সাথে তো কখনোই নয়, আর এর মধ্যেই মিয়ানমারের কাছে রোহিঙ্গা চালে ফাঁকা মাঠে গোল খেয়ে বসে আছি।

যুদ্ধে জিততে গেলে কৌশলগত মেধা থাকতে হয়। সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়, সামরিক ব্যরাকে নয়। ব্যারাকের সামরিক কৌশলের একটি চমৎকার উদাহরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধেই আছে, যেটি যে কাউকে অবাক করবে। সেটি হলো, ১৯৭১-এর পাকিস্তানের ভারত আক্রমণ। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানের অবস্থা নড়বড়ে। বিজয়ের আশা দিনে দিনে নিভে যাচ্ছে। প্রচুর সৈন্য এর মধ্যেই বাংলাদেশে নিহত। অর্থের অভাব, অস্ত্রের অভাব। সৈন্যদের রসদ সরবরাহে প্রতিকুলতা। সৈন্যদের যে মনোবল, সেটিতে ভাটা। আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে। এই সময় কেন তারা ভারতকে আক্রমণ করতে গেল?

তারা ভারতকে আক্রমণ না করলে ভারত তখনই যুদ্ধে জড়াত না বলেই মনে হয়। আক্রমণ না করে পাকিস্তান যদি অস্ত্রবিরতি বা যুদ্ধ চালিয়ে যেতো, তাহলে হয়তো ১৬ ডিসেম্বর তাদের এমন লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হতো না। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারা কেন ভারতের বিভিন্ন বিমানবন্দরে আক্রমণ করেছে সেটি জানলে মানুষের হতভম্ব হয়ে যাবার কথা।

পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বিভিন্ন বই ও নানা গবেষকদের গবেষণা থেকে জানা যায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাই কম্যান্ড নিজেদের নিয়ে তখনও এতটাই গর্ব ও দর্পে বিভোর ছিল যে, ১৯৬৭ সালে অকস্মাৎ বিমান আক্রমণ করে ইসরাইল যে মিশরকে মাত্র ছয় দিনে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলো, তারা সেটি হুবহু কপি করে ভারতকে আক্রমণ করে তারা জিতে যাবার স্বপ্ন দেখেছিলো।

১৯৬৭-এর তৃতীয় আরব ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল হঠাৎ বিমান আক্রমণ করে মিশরের বিমানবাহিনীর প্রায় সব যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দেয় এবং তাদের এয়ারপোর্টগুলো ব্যবহারের অযোগ্য করে দেয়। একই পরিকল্পনা করা পাকিস্তানের কপিক্যাট পরিকল্পনাকারীরা লক্ষ্য করেনি যে, ভারত মরুভূমির মধ্যপ্রাচ্যের মতো শুধু বিমান আক্রমণ নির্ভর একমাত্রিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল শক্তি নয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার এই আক্রমণের পর ভারতের স্থল ও নৌবাহিনী পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে এমন আক্রমণ শুরু করে যেটি প্রতিরোধের ক্ষমতা পাকিস্তানের ছিলো না। নকল করা পরিকল্পনায় ছয় দিনে জিততে গিয়ে তারা তের দিনের মাথায় হেরে যায়।

সামরিক শেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠত্ব লাগে। যতোগুলো দেশ সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই সেটি বুঝতে পারার কথা। কিন্তু কেন পাকিস্তানিরা এবং আমরা এমন চিন্তা মেনে নিয়েছি? এর কারণ, এই দুটো দেশই বিশ্বাস করে শক্তিতে, বুদ্ধিতে নয়। তাই শক্তিমানের বুদ্ধির ওপর তারা নির্ভর করতে ভরসা পায়, বুদ্ধিমানের শক্তিতে নয়।

সামরিক সংস্কৃতি হচ্ছে কন্ট্রোলড ইনস্যানিটি। সারা দুনিয়াতে পেশাটাই তেমন। তাদের বুদ্ধিতে চললে যে তারা সব যুদ্ধে হারবে, বর্তমানের আমেরিকাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরই সবার আগে তুলে ধরে প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করার কথা ছিলো; কিন্তু আমাদের সেটি হয়নি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখানে পরিণত হয়েছে শুরু থেকেই ডিগ্রি তৈরির কারখানায় যেগুলো অলঙ্কার হিসাবে মানুষ পরে থাকে।

পশ্চিম পাকিস্তানের মতোই সামরিক আবেগ ও জ্ঞানের ওপর শক্তির অবস্থান নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানও যাত্রা শুরু করে। যেখানে জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সকল উৎসাহ-উদ্দীপনার কেন্দ্র ছিলো ভারতকে ঘৃণা, হিন্দুত্বকে ঘৃণা ও কমিউনিজম বিদ্বেষ। পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষিত সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তাদের শিক্ষকগণ, একাডেমিকস, প্রফেশনালস তথা ইন্টেলেকচুয়ালরা একে কখনও চ্যালেঞ্জ করেননি একমাত্র মার্কসবাদী বা লেনিনবাদীরা ছাড়া। এমনকি তারা বেশিরভাগই এর দৃঢ় সমর্থক ছিলেন।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং তার পরবর্তী যে বাঙালী জাতীয়াতাবাদের আন্দোলন শুরু হয়, সেটি ছিলো একটি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন। সেটি কখনই কৌশলগত রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শনের আন্দোলন ছিলো না। সে-কারণে সেই আন্দোলন যেন গড়ে ওঠে রাস্তায়, মিছিলে, রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায়।

পূর্ব পকিস্তানের আন্দোলনে ইন্টেলেকচুয়ালদের অনুপস্থিতিই পাকিস্তানের নেতৃত্বকে এই ধারণা দেয় যে, বাঙালিরা যা চাচ্ছে সেটি কিছু আবেগপ্রবণ লোক খেপানো মাঠের রাজনীতিবিদদের তৈরি করা রাস্তার গোলযোগ মাত্র। অথবা, সেটি ভারতের প্রভাবে আখের গোছানো রাজনীতিবীদদের মুসলিমবিদ্বেষী চক্রান্তমাত্র। জামাত, বিএনপি এবং অস্ত্রধারী বাহিনীগুলোর বেশিরভাগই স্বাধীনতার বহু পরেও এমনই ভেবে এসেছে। সুতরাং, আমাদের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যর্থতার কেন্দ্রে রয়ে গেছে শিক্ষার রাজনৈতিক অবমাননা এবং ক্ষমতার হায়ারার্কিতে উচ্চশিক্ষার নিম্নতর অবস্থান। ক্রমেই শিক্ষকেরা পরিণত হয়েছেন সামরিক নেতৃত্ব বা রাজনীতিবীদদের কৃপা প্রত্যাশী চাটুকারে।

সিফিলিস একটি মারাত্মক রোগ। অনিরাপদ যৌনতা এটিতে আক্রান্ত হবার কারণ। তবে সিফিলিসে আক্রান্ত মায়ের দেহ থেকে জন্ম থেকেই সিফিলিস নিয়ে জন্মগ্রহণ করে অনেক শিশু। একে বলা হয় কনজেনিটাল সিফিলিস। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কনজেনিটাল সিফিলিস নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছে। তারা নিজেরাই জানে না তাদের রোগ সম্পর্কে। তাই চিকিৎসার দারস্থ হয়নি কখনও। সিফিলিসের যদি চিকিৎসা না করা হয় তখন সেটা নিউরোসিফিলিসে রুপান্তরিত হয়, যেটি মানুষের মগজ ও নার্ভাস সিস্টেমকে নষ্ট করে ফেলে। নিউরোসিফিলিস হলে মানুষ বোধশক্তি হারায়, মানসিক সুস্থতা হারায়। এটা একটি জীবন সংহারকারী রোগ।

লেখক সম্পর্কে

সিরাজুল হোসেন

সিরাজুল হোসেন

সিরাজুল হোসেন বিশেষ জ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন এবং সেগুলোর সামাজিক প্রয়োগে বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি, তিনি ইনোভেশন অ্যাডভাইজার, ডিনেট ও এমডি সাইবারনেটিক সিস্টেমস লিমিটেডে কর্মরত।

মন্তব্য লিখুন