আজ (০৫ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস । এদিনে অনেক কথাই মনে পড়ে, অনেক কিছুই লেখার আছে। তবে আজকে আমার বিষয়টি শুধু ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকদের নিয়ে লেখা। সেপ্টেম্বর (২০১১) মাসের শেষ সপ্তাহে অফিসিয়াল কাজে উত্তরবঙ্গের বগুড়া ও রংপুর গিয়েছিলাম।
ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি ’মেধাবিকাশ’ নামে একটি প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে ২০০৫ সাল থেকে। এ প্রোগ্রামের আওতায় ব্র্যাক দরিদ্র অথচ মেধাবী শিক্ষার্ধীদের একটি বৃত্তি প্রদান করে থাকে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশুনার জন্য এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ব্র্যাক এই কর্মসূচির আওতায় দুই হাজার ছত্রিশজনকে বৃত্তি প্রদান করেছে। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ প্রদান করা, তারা পড়াশুনা কে কেমন করছে, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী ইত্যাদি জানার জন্য তিন ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে বগুড়া ও রংপুর ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে সভা করেছি। যেহেতু পূর্বে ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক ছিলাম তাই কোথাও গেলে আশেপাশে কোনো ক্যাডেট কলেজে কোন কোন শিক্ষক আছেন তা জানার চেষ্টা করি। রংপুর ক্যাডেট কলেজে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম বর্তমান উপাধ্যক্ষ জনাব দেলোয়ার হোসেন। জনাব হোসেনের সঙ্গে একসঙ্গে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজে একই সাথে চাকুরি করেছি।,একই বিল্ডিংএ ছিলাম, পারিবারিকভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক। বরিশাল ক্যাডেট কলেজের সহকারী অধ্যাপক জনার শওকত হোসেনের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে ফোন দিলাম। খুব উত্তেজিত যেহেতু অনেকদিন পর কথা তাই জনাব দেলোয়ার হোসেন খুব আন্তরিকতার সাথে বাসায় দাওয়াত দিলেন।
ব্র্যাক অফিসে মিটিং শেষ করে সন্ধ্য সাতটার দিকে রংপুর ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। বাসায় পারিবারিক আলোচনার পর কলেজের বর্তমান অবস্থার কথা জানতে চাই। একই কথা- শিক্ষকদের মান পূর্বের মতো নেই। একটু পরেই প্রেপ ক্লাস দেখার জন্য তার সাথে একাডেমিক ব্লকে যাই সেখানে একজন ইংরেজি শিক্ষকের সাথে দেখা। তিনি নাম শুনে বললেন হা, আপানার নাম শুনেছি। অপানি এখন রাজউক কলেজে আছেন না? আমি আসলে ২০০৩ সালে রাজউক থেকে চাকুরি ছেড়ে দিয়েছি। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি, তার পরপরই ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে চলে আসি এবং সেই ২০০৩ থেকে এখানেই আছি ।
যেদিন রংপুর ক্যাডেট কলেজে প্রবেশে করি তার দুই দিন পূর্বে ’দ্যা ডেইলি সান’ পত্রিকায় ’মুটিভেটিং টিচার্স’ শিরোনামে আমার একটি আর্টিকেল বের হয়েছে, তারও সপ্তাহখানেক পূর্বে বেড়িয়েছে ’টিচার্স অ্যজ লাইফলং লার্নাস”। ভেবেছিলাম কলেজে হয়ত পত্রিকা ডেইলি সান রাখে না, তাই হয়ত পড়ার সুয়োগ পান নি উক্ত শিক্ষক। কতক্ষণ ঘোরাঘুরির পর উপাধ্যক্ষ মহোদয় স্টাফ লাউঞ্জে নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখলাম ডেইলি সান পেপার আছে। আমার প্রশ্ন ইংরেজি কিংবা বাংলা পত্রিকায় অনেক বিষয়ে অনেক লেখাই থাকে কিন্তু শিক্ষা সম্পর্কিত কোনো আর্টিকেল ইংরেজি শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে যাবে এবং যে পেপার তাদের কলেজেই আছে এই ব্যাপারটি মেনে নিতে কেমন যেন লাগাছিলো। একটু পরে আরও একজন ইংরেজি শিক্ষকের সাথে দেখা, অবস্থা একই। মনে হচ্ছে ইংরেজি পত্রিকা তারা টাচ করেন না। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে পড়ে গেল- আমার অনেক বন্ধু সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করছেন। এম ফিল করার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটাছুটি করছেন। এই সময়ে খোঁজাখুজি শুরু করছেন কিছু ইংরেজি অর্টিকেল। আমার লেখালেখির কথা তারা ছাত্রজীবন থেকেই জানেন বলে জিজ্ঞেস করায় অনেকগুলোর উল্লেখ করলাম। তো এক পর্যায়ে বললেন আসলে ইংরেজি পত্রিকা তো তেমন একটা পড়া হয় না, তাই হয়ত ওগুলো চোখে পড়েনি। ইংরেজি শিক্ষকগণ যদি ইংরেজি পত্রিকা না পড়েন তাহলে কারা পড়বেন? আমরা যখন ক্যাডেট কলেজে পড়িয়েছে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন ইংরেজি পত্রিকা আসবে। পত্রিকা পেলে খুটে খুটে সব পড়তাম, শিক্ষা সম্পর্কিত আর্টিকেল হলে তো কথাই নেই। এ বিষয়টি বোধ হয় এখন আর নেই ।
আমার নাম শুনেই আমাকে চিনতে হবে ব্যাপার সেটি নয়, আমার আগ্রহটা হচ্ছে শিক্ষকগণের আধুনিক পড়াশুনার সাথে কতটা সংশ্লিষ্টতা আছে তা জানা। শিক্ষকতার সাথে জড়িত নেই এমন অনেকেই ফোনে, মেইলে কিংবা ব্যাক্তিগত সাক্ষাতের সময়ে অনেক সময়েই উল্লেখ করে বলে আপনার অমুক বাংলা আর্টিকলটি পড়েছি, অমুক ইংরেজি আর্টিকেলটি পড়েছি। অথচ খুব কম সংখ্যক শিক্ষকদের মুখ এ ধরনের কথা শোনা যায়। শিক্ষার যে বিভিন্ন ওয়েবসাইট আছে সে নিয়েও দেখলাম তেমন কোন খোঁজ-খবর বা আগ্রহ নেই শিক্ষকদের মাঝে। ক্যাডেট কলেজের শিক্ষকগণ যেহেতু দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন তাদের জানাশোনা, পড়াশুনার চর্চা এবং আধুনিক জগত সম্পর্কে অবগতি অনেক বেশী থাকতে হবে সাধারন স্কুল-কলেজে পড়ানো শিক্ষকদের চেয়ে। সাধারণ স্কুল-কলেজে পড়াশুনা মানে শুধুই পড়াশুনা, কোনো ধরনের এক্সট্রা-কারিকুলার কার্যাবলী নেই, থাকলেও নামমাত্র, সামরিক প্রশিক্ষণ নেই, প্যারেড পিটি নেই। কিন্তু এখানকার শিক্ষার্থীদেরকে সব ধরনের কার্যাবলীতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে হয়। সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে হয় নিয়মিত। অতএব একজন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষককে সত্যিকার অর্থেই অল-রাউন্ডার হতে হয় । ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ আশা করি বিষয়টির প্রতি আরও দৃষ্টি দিবেন।
ক্যাডেটদের হাউসে নাকি বর্তমানে শুধু ইংরেজি পত্রিকা দেওয়া হয়, এটি একটি ভালো উদ্যোগ তবে বাংলা পত্রিকাও দেওয়া উচিত বলে মনে হয় এবং ইংরেজি পত্রিকা ক্যাডেটরা কতটা পড়ছেন তা নিশ্চিত করার জন্যও কোন শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। তা না হলে হাউসে ইংরেজি পত্রিকা দেওয়া হয়, ক্যাডেটরা যদি শুধু নাড়াচাড়া করে চলে আসে তেমন কিছু না পড়ে তাহলে লাভ কী? ছুটিতে আসা ঢাকায় জুনিয়র ক্যাডেটদের জিজ্ঞেস করেছিলাম হাউসে ইংরেজি পত্রিকা পড়ে কিনা। তারা উত্তর দিলো আমরা পড়তে পারি না সিনিয়র ক্যাডেটদের জন্য। তারা পড়ার সময় আমরা পড়েতে পারি না, তাদের পড়া শেষ হলে পেপার তারা রুমে নিয়ে যায় ফলে আমরা আর পাই না। সংখ্যাও নাকি অপ্রতুল। দুটি বা তিনটি ইংরেজি পত্রিকা রাখা হয় হাউসে। এখানে সাবেক ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক হিসেবে এবং এখনও ক্যাডেট কলেজের প্রতি আগ্রহ আছে বিধায় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করছি বাংলাদেশে প্রচলিত সব কটি ইংরেজি দৈনিক ক্যাডেট কলেজের হাউসে এবং স্টাফ লাউঞ্জে রাখার অনুরোধ করছি। বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের তথ্য ছাড়াও প্রচুর শিখন ম্যাটেরিয়ালস পত্রিকায় থাকে। এক-দুটো পত্রিকা রাখলে সে বিষয়টি কাভার হয় না। আর একটি বিষয় যারাই ইংরেজি পত্রিকা পড়েন তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি কোনটি পড়েন, সবার একই উত্তর ’ডেইলি স্টার।’ আমার প্রশ্ন ডেইলি স্টারেই কি আমরা যা চাই তা সব কিছু থাকে?
আমার মনে আছে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ জনাব মাসুদ হাসান খুব আগ্রহ নিয়ে ক্যাডেটদের সাথে ইংরেজি পত্রিকার বিভিন্ন আর্টিকেল নিয়ে, আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে বিষদ আলোচনা করতেন। সপ্তাহে একদিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা ক্যাডেটদের সাথে বসতেন এ বিষয়টি নিয়ে। রিটায়ারমেন্টে যাওয়ার একদিন আগেও এই কাজটি তিনি করেছিলেন, অসমাপ্ত অংশ আমাদের ইংরেজি শিক্ষকদের দিয়ে এসেছিলেন। ক্যাডেট কলেজে বর্তমানে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় কিনা জানি না। ইংরেজি ক্লাবে ইংরেজি পত্রিকা নিয়ে প্রচুর কাজ হতো, সেটিও বোধ হয় এখন আর নেই। শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণে প্রেরণ করা না হলে তাদের এক্সপোজার কম হবে, ক্যাডেটরা কম উপকৃত হবে। ক্যাডেট কলেজের চাকুরিকে আরও আকষর্ণীয করার নিমিত্তে শিক্ষকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যাবস্থা উদার ও জোরদার করা দরকার । সর্বোপরি সব কটি ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক ও ক্যাডেটদের নিয়ে কোনো অর্গানাইজেশন করা যায় কিনা বিষয় ভেবে দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ রইলো।
লেখক পরিচিতি
মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশে ইংলিশ টিচার্স অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)-এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি পূর্বে ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞ হিসেবে। তিনি ভাব বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। তিনি নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ে নানা প্রবন্ধ লিখছেন।