বাংলাদেশে গত এক দশক ধরে প্রাথমিক শিক্ষার ধারাবাহিক উন্নতি দৃশ্যমান হচ্ছে। ছয় থেকে দশ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর বিদ্যালয়ে ভর্তি, ঝরে পড়া হ্রাস এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আরও যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণের এই লক্ষ্যে সরকার ও বেসরকারি পর্যায়ে উভয় ধরনের সংস্থা বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

সরকারিভাবে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠা, জীবনব্যাপী দক্ষতা অর্জন, বয়স্ক শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও শিক্ষা মান উন্নত করার জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণসহ আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোও দুর্গম এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন, কন্যা শিশুদের ভর্তির প্রাধান্য দেওয়া থেকে শুরু করে সরকারের সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বেশ কিছু কর্মসূচি পরিচালনা করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিতে সহায়তা করছে।

প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৌলিক সৃজনশীলতা সৃষ্টি, বিস্তৃত ও সঠিকভাবে লেখার দক্ষতা অর্জন করা। সাবলীলভাবে লিখন দক্ষতা বা লেখার দক্ষতার বিষয়টি অ্যাকাডেমিক সাফল্যের সাথে পেশাগত জীবনেও অত্যাবশ্যকীয় দক্ষতা বলে বিবেচিত হয়। পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৮ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের মুখস্থনিভর্রতা থেকে মুক্ত করার আশায় চালু হয়েছে ‘সৃজনশীল’ পরীক্ষা পদ্ধতি; যেখানে শিক্ষার্থী তাত্ত্বিক জ্ঞানের সাথে বিশ্লেষণ ক্ষমতা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও সৃজনশীলতার বিকাশের সুযোগ রয়েছে।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি দাতা এবং দুইটি বাস্তবায়নকারী সংস্থা মিলে উত্তরবঙ্গের দুইটি উপজেলার তিনশো দশটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এক কর্মসূচি গ্রহণ করে যার প্রধান লক্ষ্য ছিলো শিক্ষার্থীদের পড়া ও লেখার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। লেখার দক্ষতা ভালোভাবে অর্জন করতে পারলে অ্যাকাডেমিক সাফল্যের সাথে সাথে আরও অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব হয়।

বিভিন্ন শিক্ষাবিদের মতে, ভাষা শেখার জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায় সবচেয়ে উপযুক্ত। এ উদ্দেশ্যে ২০১৫ সাল থেকে তিনটি সংস্থা মিলে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিষয়ভিত্তিক ও প্রধান শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা-কর্মকর্তাদের সাথে ওয়ার্কশপ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য তিনশো দশটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠাগার তৈরি এবং বিভিন্ন ধরনের বই সরবরাহ করা হয়। কর্মসূচি গ্রহণ করার সাথে সাথে এই বিদ্যালয়গুলোতে দৈবচয়নের মাধ্যমে তিরিশটি বিদ্যালয় বাছাই করে জরিপ করা হয়। এ-জরিপে শিক্ষার্থীদের লিখন দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক দুটো অনুশীলনী করতে দেওয়া হয়।

এ দুটো হলো: নিজের বাড়ি সম্পর্কে পাঁচটি বাক্য শুদ্ধভাবে লেখা এবং একটি ছবি দেখে পাঁচটি বাক্য ব্যবহার করে ছবিটি বর্ণনা করা। তৃতীয়  শ্রেণির বই থেকে ছবি এবং দুটো অনুশীলনীই ব্যবহার করা হয়েছে। ফুলছড়ি থেকে প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছাত্র একটি বাক্যও শুদ্ধভাবে লিখতে পারেনি। সুন্দরগঞ্জ থেকে এক-দশমাংশের একটু বেশি ছাত্রের মধ্যে এ দক্ষতার অভাব দেখা যায়। মেয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ হার মাত্র ২-৩ শতাংশ বেশি। যেসব শিক্ষার্থী সঠিকভাবে একটি পূর্ণ বাক্য লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাবসহ সৃজনশীলভাবে কোনোকিছু কীভাবে লিখতে হবে, সে-সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।

মৌলিক লিখন দক্ষতা অভাব বাকি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। যারা অন্তত একটি বাক্য সঠিকভাবে লিখতে পেরেছে, তাদের মধ্যেও শব্দ গঠন ও শব্দার্থ সম্পর্কে ধারণা, শব্দের সঠিক ব্যবহার এবং বানান, সঠিক ব্যাকরণ ও যতিচিহ্নের ব্যবহার সম্পর্কে ভালো ধারণা আছে বলে মনে হয়নি। বছরের শেষের দিকে একজন শিক্ষার্থী যদি তার পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক কোনো অনুশীলনী করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সারা বছর কী শিখল— সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়।

লেখা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অবশ্য সঠিকভাবে লেখার দক্ষতা অর্জন করার চেষ্টা শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করা উচিত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে— ভাষা শেখার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তর সবচেয়ে উপযুক্ত বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি সাক্ষরতার দক্ষতাও অর্জনও একটি জরুরি বিষয়। সুতরাং ভালো লেখার দক্ষতা অর্জনের জন্য শিক্ষকের কিছু বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখাতে হবে:

১. শিক্ষার্থীর প্রেরণা বৃদ্ধি;

২. কীভাবে লিখতে হবে তার নিয়মগুলো জানানো (যেমন: শব্দ গঠন, সঠিক শব্দের ব্যবহার, বানান, ব্যাকরণ এবং যতি চিহ্নের ব্যবহার ইত্যাদি);

৩. লেখার অনুশীলন প্রদান;

৪. শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে গঠনমূলক মতামত প্রদান করা;

৫. যেসব শিক্ষার্থী ভালো লেখে, তাদের লেখা ক্লাসে অন্যদের পড়ে শোনানো এবং কেন এটি ভালো তা ব্যাখ্যা করা;

৬. নিম্নমানের লেখা পড়ে তার দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দেওয়া;

৭. পাঠ্যপুস্তকর বাইরের বই ব্যাকরণ, যতিচিহ্ন ও শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা দেওয়া;

৮. নিয়মিত ক্লাসে লেখার অনুশীলন করানো এবং

৯. ভালো লেখার দক্ষতা আছে এমন শিক্ষার্থীর প্রশংসা করা।

শিক্ষক যদি নিয়মিত প্রেরণা দেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের লেখার উন্নতির জন্য চেষ্টা করবে এবং নিয়মিত প্রচেষ্টায় চলবে। ভালো লেখার জন্য শিক্ষার্থীদের যথাযথ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে, যেমন ব্যাকরণের নিয়ম। যখন শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের দক্ষতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট, নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া জানতে পারবে তখন কীভাবে তা আরও উন্নত করা যায় তা নিয়ে ভাববে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো করার চেষ্টা করবে। এ কৌশলগুলোকে সংগঠিত করে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফল করায় উদ্বুব্ধ করতে পারে।

অপরদিকে কিছু কিছু বিদ্যালয়ে আমরা দেখি শিক্ষকদেরই যথাযথ দক্ষতার অভাব রয়েছে। তাদের জন্য নিচে কিছু কৌশলের কথা বলা হলো, তবে এ কৌশলগুলো যে কেউ লেখার দক্ষতা বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করতে পারেন:

১. নিয়মিত পড়ুন: কারও কাছে এটি আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে, কিন্তু লেখার দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে লিখতে হয় না, কিন্তু পড়তে হয়। নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের লেখা (অ্যাকাডেমিক, হাস্যরস, কবিতা, বিজ্ঞান কথাসাহিত্য, সাধারণ গদ্য ইত্যাদি) পড়লে শব্দের সঠিক ব্যবহার, প্রতিশব্দ, বাক্যগঠন সম্পর্কে ভালো ধারণা হবে। এবং এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভালো লেখা-পড়ার ফলে আপনি ব্যাকরণ ও বানানকে সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারবেন, পাশাপাশি আপনার একটি বড় শব্দভাণ্ডারও তৈরি হবে।

২. প্রতিদিন লিখুন: নিয়মিত অনুশীলন যেকোনো কাজকে নিখুঁত করে তোলে। এটি জীবনের যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যখন আপনি কিছু কিছু ভালো পেতে চান, তখন এটির কোনো বিকল্প নেই। প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে লিখুন। আপনার অগ্রগতি খুব ধীরে হতে পারে; কিন্তু আপনার প্রতিটি দিন, সপ্তাহ এবং অনুশীলনের সঙ্গে সঙ্গে আপনার লেখার মান ভালো হবেই। নিজের অগ্রগতি জানতে হলে মাস বা বছর আগে আপনার লেখা নমুনা পড়ে দেখুন। তখন পার্থক্যটি আপনি নিজেই অনুভব করতে পারবেন।

৩. আপনার লেখাটি জোরে জোরে পড়ুন: এ কৌশলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন আপনার লেখাটি জোরে জোরে পড়বেন, তখন আপনি বুঝতে পারবেন কোথায় কোনো ভুল হয়েছে কিনা, লেখাটি অসম্পূর্ণ বা পুনরাবৃত্তিমূলক হয়েছে কিনা। পরে আপনার ভুলগুলো শুদ্ধ করে আপনার লেখাটিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন।

৪. শিক্ষক/লেখকের সঙ্গে একটি লেখা: একজন পেশাদার লেখক বা শিক্ষক লেখার দক্ষতা উন্নয়নের চাবিকাঠি। তার পেশাদারী অভিজ্ঞতা আছে এবং তিনি গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন। লেখক/শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে আপনার লেখার দুর্বলতাগুলো দূর করা সম্ভব।

উপরের কৌশলগুলো নিয়মিত অনুসরণ করলে আপনি কিছুদিন পর আপনার লেখার দক্ষতার পার্থক্য অনুভব করবেন।

লিখন দক্ষতা শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা জীবনের প্রায় সবক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। শিক্ষার্থীদের বয়স বৃদ্ধির সাথে তারা আরও পরিশীলিত লেখার দক্ষতা অর্জন করবে এবং তাদের লেখার মাধ্যমে আরও পরিশীলিত কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়। উপরন্তু, অনেক ধরনের প্রশাসনিক কাজ, বা গবেষণা ও সংবাদপত্রে লেখার ক্ষমতা ওপর নির্ভর করে কাজটি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। লেখা যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ। ইদানিং ই-মেইলের মাধ্যমে আমরা আমাদের বন্ধু, আত্মীয় এবং সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সুতরাং, এ দক্ষতা যদি শিক্ষাজীবনের শুরুতে যথাযথভাবে অর্জিত হয়, তাহলে পরবর্তী ক্ষেত্রে পেশাগত জীবনে তার ব্যাপক সুবিধা পাওয়া যায়।

Sending
User Review
2.5 (4 votes)

লেখক সম্পর্কে

রিফাত আফরোজ

রিফাত আফরোজ

রিফাত আফরোজ শিক্ষা-বিষয়ে গবেষক। বর্তমানে সেভ দা চিলড্রেনে কর্মরত। তিনি শিক্ষা বিষয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

মন্তব্য লিখুন

একটি মন্তব্য