বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বা এনজিওর অবদান অনেক। এদেশে এনজিওর কাজ করার ইতিহাস দেশটির স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাসের চেয়েও দীর্ঘ।
ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যুগ যুগ ধরে কাজ করে আসছে। তবে উন্নয়নের ধারণা পরিবর্তনের সাথে সাথে এ-সকল সংস্থা তাদের কাজের ধরন-ধারণ ও কৌশল পরিবর্তন করেছে। সময়ে সময়ে পরিবর্তন করেছে কাজের ক্ষেত্রও।
আলোচ্য বিষয়সমূহ
ষাটের দশকের পূর্ব পর্যন্ত উন্নয়নের অর্থ ছিল ‘মানবসম্পদ’ উন্নয়ন; অর্থাৎ মানুষকে একটি সম্পদ হিসেবে কাজে লাগানোই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলী, সদিচ্ছা, ভালোলাগা-মন্দলাগা এসবের কথা না ভেবে মানুষকে কেবল একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলাই ছিলো রাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য।
ষাটের দশক পেরুতে না পেরুতেই উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে ‘মানবসম্পদ’ উন্নয়নের ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকে এবং প্রচলন হয় ‘মানব উন্নয়ন’ ধারণার; কিন্তু বাংলাদেশে ‘মানব উন্নয়ন’ ধারণার ছোঁয়া লাগতে আরও অনেক সময় লেগে যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর এনজিওসমূহ কাজ শুরু করে মূলত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য। পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য হাতে নেয় বিভিন্ন ধরনের আয়বর্ধক কর্মসূচি। এ সময়ে অন্য অনেক কাজের মাঝে এনজিওর অবদান হিসেবে দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ-পরবর্তী ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ঋণ কর্মসূচির প্রাধান্যই ছিল বেশি।
একই সময়ে এনজিওসমূহ কিছু কিছু উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার পদক্ষেপ নিলেও এই কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল জীবন-দক্ষতা উন্নয়নের জন্য মৌলিক শিক্ষাকে ভিত হিসেবে কাজে লাগানো। অর্থাৎ, সে সময়ে ধারণা করা হতো, মানুষকে সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারলে বাংলাদেশ দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত হবে অর্থাৎ স্বনির্ভর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
শুরুর দিককার এনজিওগুলো তাই সে ধারণাকেই সামনে রেখে বিভিন্ন প্রকল্পভিত্তিক কাজ করে গেছে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিশ্ব এগিয়ে যেতে থাকে, পিছিয়ে থাকেনি বাংলাদেশও। শুধু কিছু জীবন-দক্ষতার উন্নয়ন করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহ নিশ্চিত করা গেলেও সামাজিক মূল্যবোধ, আদর্শ ও মানবতার বিকাশ সাধন করা অসম্ভব। এতে সমাজের সমতাভিত্তিক স্থায়ী বা টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয় বা হতে থাকে।
তাই আশির দশকের শেষার্ধে এসে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ‘শিক্ষা’ বিষয়টিকে বেছে নেয়া হয়; কেনোনা মানুষের সার্বিক ও টেকসই উন্নয়নের জন্য চাই গুণগত শিক্ষা। বাংলাদেশের অনেক স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও শিশুর শৈশবকালীন বিকাশ কর্মসূচিসহ মূলধারার শিক্ষাকে সহায়তা করার জন্য নানামুখী কর্মসূচি নিতে থাকে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিশনগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে অর্থাৎ তারা তাদের প্রতিবেদনসমূহ সরকারের কাছে জমা দেয় কিন্তু বেশিরভাগই ছিলো অসম্পুর্ণ; পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি আমরা পাই সাম্প্রতিককালে অর্থাৎ ২০১০-এ।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সরকার এ-সকল কমিটির সুপারিশকৃত অনেক নীতি বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছে এবং তা করতে গিয়ে সরকারকে নানাবিধ চ্যালেঞ্জেও পড়তে হয়েছে। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে যতোটা না ছিল অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা, তারচেয়ে বেশি ছিল প্রণীত আইন বাস্তবায়নে যথাযথ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাব।
ধারণা করা হতো, শিক্ষার সুযোগ লাভের অধিকার ছিল বিশেষ শ্রেণির মানুষদের; দরিদ্র বা সামাজিকভাবে নিচু শ্রেণির নয়। এমন একটি অস্থিতিশীল ও অব্যবস্থাপনাগত পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। এসব এনজিও সমাজের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি শিশু অধিকার, মানব অধিকার, নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপর রাষ্ট্র যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নেয়, তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রীয়করণ। তবে তাও ছিল চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দূরত্ব, দারিদ্র্য ও অসচেতনতার কারণে বিপুল সংখ্যক শিশু আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছিলো না। তখনও শিক্ষাকে অধিকারের চেয়ে সুযোগ হিসেবেই বিবেচনা করা হতো বেশি।
ধারণা করা হতো, শিক্ষার সুযোগ লাভের অধিকার ছিল বিশেষ শ্রেণির মানুষদের; দরিদ্র বা সামাজিকভাবে নিচু শ্রেণির নয়। এমন একটি অস্থিতিশীল ও অব্যবস্থাপনাগত পরিস্থিতিতে মানুষের জীবনে আশির্বাদ হয়ে আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। এসব এনজিও সমাজের অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি শিশু অধিকার, মানব অধিকার, নারী অধিকার ও ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে।
ফলে শিক্ষার মৌলিক অধিকারটি সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত হবার পর অনেক বিলম্বে হলেও এটি যে একটি অন্যতম মৌলিক অধিকার তা অনেকের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এখনও বাংলাদেশে শিক্ষার অধিকার-বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়; আর এর জন্য অধিকারবঞ্চিত জনসাধারণ একতরফাভাবে দায়ী নয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার যতো উপরের স্তরে ওঠা যায় ঝরেপড়ার হার ততোই বৃদ্ধি পেতে থাকে; শিক্ষার নিম্নমানের কথা না হয় না-ই বললাম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর প্রায় চার দশক ধরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষাক্ষেত্রে যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে, তা হচ্ছে শিশুভর্তি বা বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তকরণ যা বর্তমানে শতকরা ৯৭ ভাগেরও বেশি।
ভর্তির এই বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে গিয়ে সরকার নানা ধরনের আইন তৈরি ও কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা আইন’, ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’, ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি’, ‘উপবৃত্তি কর্মসূচি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধে এসে সরকারের আইডিয়াল (IDEAL) প্রজেক্ট ও এস্টিম (ESTEEM) প্রজেক্ট মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে কিছু কাজ শুরু করলেও তা যথাযথ তত্ত্বাবধানের অভাবে সার্থকতার মুখ দেখেনি। তবে আইডিয়াল ও এস্টিম প্রজেক্টের বেশ ভালো কিছু কাজ ছিলো যা নতুন করে চর্চার তাগিদ শুরু হয়েছে।
এই দুটো প্রজেক্ট থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় ছিলো যেগুলি পরবর্তী নানা প্রজেক্টে কাজে লাগানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে সরকার ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-১’ বা পিইডিপি-১ নামক বিশাল কর্মসূচি হাতে নিয়ে বিদ্যালয়ের ভৌত-অবকাঠামো, বিপুল সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে। উক্ত প্রকল্পটির এখন চতুর্থ পর্যায় বা পিইডিপি-৪ শুরু হয়েছে এবং সরকার এটিকে আর প্রকল্প না বলে মূলধারার কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করছে।
প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে ‘উপজেলা রিসোর্স সেন্টার’ সৃষ্টি, যা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশকে একধাপ এগিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তনগুলো এসেছে তার সবকটির জন্য বিভিন্ন খণ্ড খণ্ড প্রকল্প বিশেষভাবে অবদান রেখেছে। সরকারের এসব প্রকল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহ, যারা কারিগরি ও আর্থিক দিক দিয়ে সহায়তা করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যৌথভাবে প্রায় ১৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
বিগত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রাথমিক শিক্ষার সংখ্যাগত ও গুণগত পরিবর্তনে সরকারের প্রচেষ্টার কমতি নেই কিন্তু তারপরও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে এখনও সংশয় রয়েছে।
কয়েক দশক ধরে মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও সম্পূরক ও পরিপূরক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। বিশেষ করে মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন (ঝরে পড়া বা কখনোই ভর্তি না হওয়া) শিশুদের পুনরায় শিক্ষাব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ব্র্যাক, প্রশিকাসহ শত শত এনজিও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করেছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গ্রাম পর্যায়ে মানবসম্পদ সৃষ্টি, বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগের যে বিষয়গুলি ভালো কাজ করছিলো না অথবা সরকারি যে সকল সীমাবদ্ধতা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা ছিল, সে সকল ক্ষেত্রে এনজিও-র ভূমিকা ছিল কোথাও সম্পূরক বা পরিপূরক কর্মসূচি গ্রহণ, কোথাওবা মূলধারার কার্যক্রমকে শক্তিশালীকরণ, কিংবা কোথাও বা বিকল্প মডেল তৈরি করে দেখানো।
এনজিওর অবদান বিকল্প মডেল হিসেবে সম্প্রতি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে মূলধারায় অন্তর্ভুক্তকরণ সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এছাড়াও প্রাথমিক শিক্ষার কর্মকৌশল ও পাঠ্যবইসমূহে নানা বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে মানসম্মত, অধিকারভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক করার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়টি সরকারের বিশেষ নজরে রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ের সকল স্তরের জনগণকে সস্পৃক্ত করে বিদ্যালয়ভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, শিশুদের নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি, স্থানীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ বিদ্যালয়ে চর্চাভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রয়াস বিদ্যমান।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি, গ্রাম পর্যায়ে মানবসম্পদ সৃষ্টি, বিকল্প শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এছাড়া সরকারি উদ্যোগের যে বিষয়গুলি ভালো কাজ করছিলো না অথবা সরকারি যে সকল সীমাবদ্ধতা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা ছিল, সে সকল ক্ষেত্রে এনজিও-র ভূমিকা ছিল কোথাও সম্পূরক বা পরিপূরক কর্মসূচি গ্রহণ, কোথাওবা মূলধারার কার্যক্রমকে শক্তিশালীকরণ, কিংবা কোথাও বা বিকল্প মডেল তৈরি করে দেখানো।
এই উন্নয়নমূলক কাজের যাত্রাপথে এনজিওসমূহকে শত চ্যালেঞ্জ, বাধা, বঞ্চনার স্বীকার হতে হলেও বাংলাদেশের কোটি শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হয়েছে যা একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে সহায়ক হবার কথা। এনজিওর স্বচ্ছতা, জবাবদিহি মনোভাব ও কর্মগুণ সরকারের আস্থা অর্জনে ভুমিকা রেখেছে। এর ফলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় “সরকারি-বেসরকারি সমন্বয় নির্দেশিকা/কর্মকৌশল” নামক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধিতে এনজিওর অবদান সরকারের সাথে আরও বহুদূর যেতে হবে। এর মধ্যে একটি আনন্দময়, সমতাভিত্তিক ও পরিবেশবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে একীভুত শিক্ষার মডেল উপস্থাপন করা অন্যতম।
এছাড়া সরকার যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষাস্তরকে পর্যায়ক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করতে যাচ্ছে, সেখানে এনজিও-কর্তৃক সহায়ক শিক্ষা-উপকরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, চাহিদাভিত্তিক শ্রেণিকক্ষ-সেনিটেশন ও প্যারাশিক্ষকের (কমিউনিটি কর্তৃক নিয়োগকৃত শিক্ষক) সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিশু বিকাশ ও যত্ন কেন্দ্রসহ গর্ভাবস্থা থেকে মা ও যত্নকারীদেরকে শিশুর স্বাস্থ্য ও বিকাশের ওপর সচেতন ও দক্ষ করে তোলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে।
শিশুশিক্ষার একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পিতা-মাতার আয়রোজগারে সম্পৃক্ততা। অর্থাৎ একটি শিশুর মা-বাবা উভয়ই যখন কোনো না কোনো অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত হচ্ছেন, তখন ওই শিশুটির পরিচর্যার জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না। এর ফলে শিশুটি থাকছে অরক্ষিত এবং তার বিকাশও ভালোভাবে সাধিত হচ্ছে না। এটি যেমন শিশুর সামাজিক, শারীরিক, মানসিক কিংবা ভাষার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে; সাথে সাথে শিশুটিকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশের পথকে কণ্টকময় করছে।
অপরদিকে শিশুর কথা ভেবে কখনও কখনও মাকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা চিন্তা করে হোক, আর শিশুদের সঠিক বিকাশের কথা ভেবে হোক, এনজিওসমূহ দেশব্যাপি ব্যাপকহারে শিশু দিবা-যত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করতে পারে।
বিদ্যালয়ের সাথে এলাকাবাসীর সম্পর্ক উন্নয়ন, যোগাযোগ রক্ষা ও বিদ্যালয়ের প্রতি যথাযথ দায়িত্বপালনে সকলকে সচেতন করার কাজটি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে যদিও কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর অন্যতম কারণ মানুষের ব্যস্ততা বৃদ্ধি। জনগণের এই ব্যস্ত সময়ের মধ্যে তাদেরকে বিদ্যালয়ে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করার কৌশল এনজিওগুলো যদি দেখাতে পারে, তবেই প্রাথমিক শিক্ষার গুণগতমান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও একই ধারার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের জন্য কার্যকর আন্দোলন অব্যাহত রাখা ও সৃজনশীল মূল্যায়ন ব্যবস্থার কার্যকর মডেল প্রদর্শন করা এনজিওর অবদান বা অন্যতম লক্ষ্য হওয়া উচিত।
বাংলাদেশ সরকারের অপেক্ষাকৃত নমনীয় শিক্ষানীতি, কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রশাসকদের আন্তরিকতা, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা প্রশাসক ও প্রশিক্ষকগণের ইতিবাচক কর্মস্পৃহা, সহায়ক ফিল্ড সুপারভিশন— এসবের ফলে শিক্ষার গুণগত মানের একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে এ পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এবং শিক্ষার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধির লক্ষে দরকার অন্তঃবিভাগীয় ও আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় সাধন। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে সমন্বিতভাবে বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি সকলের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও যথাযথ কর্ম-মান নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকতে হবে।
রাষ্ট্রপক্ষের একটি বড় সংগঠক হিসেবে সরকারকেই পট পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে হবে; শিক্ষার মানোন্নয়নে বেসরকারি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগগুলিতে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করাসহ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যেসব এনজিও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ও সক্ষম, তাদের মধ্যে সুষম দায়িত্ব বণ্টন করাটাও সরকারের অন্যতম কাজ।
রাষ্ট্রপক্ষের একটি বড় সংগঠক হিসেবে সরকারকেই পট পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে হবে; শিক্ষার মানোন্নয়নে বেসরকারি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগগুলিতে ইতিবাচক সাড়া প্রদান করাসহ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যেসব এনজিও শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ও সক্ষম, তাদের মধ্যে সুষম দায়িত্ব বণ্টন করাটাও সরকারের অন্যতম কাজ। নইলে কাজের ও সাহায্যের দ্বৈততা (overlapping) ঘটতে পারে।
এমনকি যে সকল এলাকা অপেক্ষাকৃত প্রান্তিক, দুর্গম ও দরিদ্র, সে সকল এলাকায় সাহায্য না গিয়ে অপেক্ষাকৃত উন্নত এলাকায় সাহায্য ও সহযোগিতা চলে যেতে পারে। একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন সকলকে একতাবদ্ধভাবে দেখতে হবে; আর এজন্য রাজনীতির সাথে রাষ্ট্রনীতির সমন্বয় সাধন অত্যন্ত জরুরি।
দলের সাথে দলের রাজনৈতিক মতদ্বৈততা, অনৈক্য, অনাস্থা থাকতেই পার। তবে এই কলহ যেন একজন শিশুর স্বপ্নকে দলিত আর ভবিষ্যতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন না করতে পারে, সেদিকে বিশেষ যত্নবান হতে হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষাব্যবস্থার নানা দিক বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ্বের চলন-বলন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস যেন অধীনস্তদের কাছে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হয়, যা আমাদের গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পথকে গতিশীল ও সুগম করতে পারে। এসডিজি-র লক্ষ্যমাত্রা-৪ অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক ”ইনক্লুসিভ এডুকেশন সেল” গঠিন একটি যুগান্তকারি পদক্ষেপ, তবে এই সেলটিকে সক্রিয় ও গবেষণাভিত্তিক করার জন্য এর কর্ম পরিসর ও লোকবল বাড়াতে হবে।
একীভূত শিক্ষার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গী সরকারের টেকনিক্যাল দপ্তরগুলিতে এখনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু বা প্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, এখান থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। গুণগত শিক্ষার জন্য শিশু, অভিভাবক, সমাজ, প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপকদেরকে তৈরি হতে হবে। আমাদের স্লোগান হতে হবে, ”সব শিশুই শিখতে পারে দুয়ার খুলে রই, আমি যেন কারো শেখার আর বাধা না হই”।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার পুরো বিশ্বে দখল করেছে শীর্ষস্থান! বাংলাদেশে বড় বড় প্রকল্পে বড় ধরনের…
নতুন শিক্ষাক্রমের প্রবর্তকেরা এবং তার সমর্থকরা এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে সবার আগে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল…
বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার নতুন শিক্ষাক্রমের আবশ্যিক বিষয় জীবন ও জীবিকার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির…
শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাস করতে চায় না এই প্রশ্নটি নতুন নয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের…
বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, "কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার জন্য শিক্ষক: শিক্ষক স্বল্পতা পূরণ বৈশ্বিক…
মেয়েদের মাসিক ঋতুস্রাব তাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যেটি বাংলাদেশের মেয়েদের ক্ষেত্রে দশ বছর থেকে…
View Comments
সুন্দর সাবলিল উপস্হাপনা।