বাড়ি প্রাকশৈশব উন্নয়ন ও প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষা শিশুশিক্ষা, প্রতিযোগিতা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

শিশুশিক্ষা, প্রতিযোগিতা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ

লেখাপড়ার চাপ

আমাদের জীবনধারণের জন্য কোনটি বেশি দরকারি—  সহযোগিতা নাকি প্রতিযোগিতা? আমার ধারণা সকলেই একবাক্যে বলবেন সহযোগিতা। অথচ আমরা আমাদের শিশুদের ক্রমাগত প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছি শিক্ষার নামে! আমাদের শিশুশিক্ষার আয়োজনজুড়ে নানারকম প্রতিযোগিতার ছড়াছড়ি।

আমার সুযোগ হয়েছিলো জাপানের মতো একটি উন্নত দেশে শিশুশিক্ষা নিয়ে কাজ করার। সে অভিজ্ঞতা আমাকে উন্নত দেশের শিশুশিক্ষার সাথে আমাদের শিশুশিক্ষার তুলনা করার সুযোগ করে দিয়েছে। জাপানে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করা একটি বছর আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। শিক্ষার অন্য স্তরগুলোর কথা আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারবো না তবে খানিকটা ধারণা পেয়েছি।

প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকে জাপানে জীবনের ভিত্তি হিসেবে দেখা হয় এবং ৩+ থেকে ৫+ বয়স পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদে শিশুর জন্য যে শিক্ষার আয়োজন সেখানকার কিন্ডারগার্টেনগুলোতে করা হয়, তা সত্যিই সারা জীবনের জন্য রসদ সরবরাহ করতে সক্ষম। কী নেই সেখানে! জীবনযাপনের সব অনুসঙ্গকে বিদ্যালয়ের আবশ্যিক ‍বিষয় হিসেবে নেয়া হয়েছে। লেখাপড়া সেখানে গৌণ, নেই বললেই চলে।

জীবনধারণের অনিবার্য অনুষঙ্গ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস, প্রকৃতি ও পরিবেশ, কাজের আনন্দ, সহযোগিতা ও মানবিক সম্পর্কের মত বিষয়গুলোকে পরিচর্যা না করে আমরা কেবল পড়া আর লেখাকেই শিক্ষা বলে চালিয়ে দিচ্ছি! ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে, সবাই গোল্ডেন এ-এর জন্য মরিয়া!

এক-একটি বিদ্যালয় প্রতিটি শিশুর জন্য দ্বিতীয় গৃহ। শিশুর ভালোলাগার সব আয়োজন বিদ্যালয়ে রয়েছে। শিশু বিদ্যালয়ে আসে নিজের তাগিদে। আর এখানে কাটানো সময়গুলো তাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের। কিন্ডারগার্টেন শিক্ষার মূল বিষয়গুলো হচ্ছে: স্বাস্থ্য (শারীরিক ও মানসিক), মানবিক সম্পর্ক, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ভাষা (মাতৃভাষা আত্মীকরণ) ও প্রকাশভঙ্গি (অনুভূতির প্রকাশ)। এই পাঁচটি ক্ষেত্রের সকল শিক্ষায় শিশু তার খেলার মাধ্যমে লাভ করে থাকে।

আমি পাঁচ বছর বয়সীদের ক্লাশে নিয়োজিত ছিলাম ‘গ্লোবাল টিচার’ হিসেবে। এই শ্রেণির মূল একজন শিক্ষকের সাথে আমরা দু’জন সহায়ক হিসেবে কাজ করতাম। কাজ করতাম না বলে খেলা করতাম বলাই সঙ্গত হবে। কেনোনা শিশুরা যতোক্ষণ বিদ্যালয়ে থাকে, ততোক্ষণই খেলা চলে। শিক্ষকের মূল কাজই হলো শিশুদের খেলার পরিবেশ ‍নির্বিঘ্ন করা এবং তাদের খেলার সাথী হওয়া। পাশাপাশি প্রতিটি শিশুর গতিবিধি লক্ষ্য রাখা ও প্রয়োজনীয় নোট নেওয়া বা ছবি তুলে রাখা যা শিশুর জন্য পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য সহায়ক। একেই বলা যায় মূল্যায়ন (assessment for learning)।

অন্যদিকে আমাদের লেখাপড়া আর পরীক্ষানির্ভর শিশুশিক্ষা শিশুর সহজাত প্রবণতাগুলোকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। জীবনধারণের অনিবার্য অনুষঙ্গ স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস, প্রকৃতি ও পরিবেশ, কাজের আনন্দ, সহযোগিতা ও মানবিক সম্পর্কের মত বিষয়গুলোকে পরিচর্যা না করে আমরা কেবল পড়া আর লেখাকেই শিক্ষা বলে চালিয়ে দিচ্ছি! ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে, সবাই গোল্ডেন এ-এর জন্য মরিয়া!

জাপানে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয় মানে ক্লাশরুম নয়, পুরো বিদ্যালয় অঙ্গনই শিশুদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। কী নেই সেখানে! বিশ্বপ্রকৃতির এক ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন এক-একটি বিদ্যালয় অঙ্গন। প্রাকৃতিক উদ্যান, পাহাড়, চাষের জমি, পশুপালনের ব্যবস্থা, খেলার মাঠ আর শ্রেণিকক্ষের সর্বত্র খেলার সরঞ্জামের ছড়াছড়ি। শিশুদের জন্য কোনো নির্ধারিত বই নেই! লেখার খাতাও নেই! শ্রেণিকক্ষে যা আছে তার সবই ঐচ্ছিক। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের শিক্ষা শিশু এখানেই পেয়ে থাকে। শৌচাগার ব্যবহার, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, নিজের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখা ও ‍নিজের কাজ নিজে করাকে খুব গুরুত্বের সাথে উৎসাহিত করা হয়।

শিশুদের মধ্যে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, সহযোগিতা আছে। এমনকি খেলার সময়ও তারা ব্যক্তিগত কোনো অর্জনকে বড় করে দেখে না। দলগত অর্জন এবং সহযোগিতাপূর্ণ আচরণকে খুব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। প্রকৃতির কোনো প্রতিকূলতাকে এরা ভয় করতে শেখায় না, জয় করতে শেখায়। তাই যেকোনো প্রাকৃতিক বৈরিতার মধ্যেও শিশুদের বাইরে খেলায় মানা নেই।

পারস্পারিক সম্পর্ক খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শিশুরা পরস্পরকে সহযোগিতা করতে কখনো পিছপা হয় না। শিশুর শিখন প্রক্রিয়াকে শাণিত করার যে মূল শক্তি, তা হলো শিশুর মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা। তাই শিশুর মনোযোগ দেওয়ার চর্চাকে উৎসাহিত করা হয়। শিশু সহজাতভাবেই তার পছন্দের কাজে মনোনিবেশ করে, তাই কোনো পূর্বনির্ধারিত কাজের অজুহাতে তার মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয় না। বরং শিশু যে-কাজে মনোনিবেশ করে, তাতেই আরও উৎসাহ যোগানো হয় যাতে তার মনোযোগ আরও গভীর হয়। পরিশেষে ওই শিশুর কাছে তার অনুভূতি জানতে চাওয়া হয়। শিশু তখন নিজের মনোযোগের বিষয়টি সবার কাছে প্রকাশ করে, নিজের অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশের চেষ্টা করে। এভাবেই তার ভাষার দক্ষতা তৈরি হয়। কোনো নীতিকথা শেখানো হয় না। কাজের মাধ্যমে শিশুর নৈতিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করা হয়।

শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজ হাতে কাজ করার আনন্দ, সহযোগিতার মাধ্যমে সমবেত জীবনের উচ্ছাস যেনো তারা উপলব্ধি করতে শেখে, সেটি নিশ্চিত করতে পারা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা যেনো তার জীবনকে সহজ করে, অর্থময় করে। নৈতিকতার শিক্ষা যেনো শিশুরা তাদের কাজের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে।

শিশুর দৈনন্দিন জীবনযাপনের সাথে বিদ্যালয়ের আয়োজন সবসময় সঙ্গতিপূর্ণ রাখা হয়, যেন শিশু কোনোরূপ দ্বিধায় না পড়ে। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম ও শিশুর অগ্রগতি সম্পর্কে অভিভাবকগণকে নিয়মিত অবহিত করা হয়। শিশুরা নিজ হাতে চাষ করে, পশুপালন করে, ফসল তোলে এবং নিজেদের চাষের সবজি নিজেরা একদিন রান্না করে সবাই মিলে খায়। সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বিদ্যালয়ে স্বাড়ম্বরে উৎযাপন করা হয়।  সকল কাজই শিশুরা করে শিক্ষকের সহযোগিতায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে। খেলা আর কাজ করতে করতে তারা শেখে জীবনের সব প্রয়োজনীয় শিক্ষা। একজন কিন্ডারগার্টেন শেষ করা ছয় বছর বয়সী শিশু তার সারা জীবনের প্রায় সকলরকম জীবনদক্ষতা অর্জন করে নেয় খেলতে খেলতে। তারপর শুরু হয় লেখাপড়া।

আমরা প্রাক-প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাকে সদ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত করে এক বছর মেয়াদি শিশুর সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রগুলিকে পরিচর্যার কাজ করছি। অনেক দেরিতে হলেও আমরা শুরু করতে পেরেছি, কিন্তু সেখানেও পরীক্ষা আর প্রতিযোগিতা থামানো যাচ্ছে না। সর্বত্র সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা কেমন বিষময় তা তো আমরা প্রতিনিয়তই দেখছি। বিদ্যালয় যেনো শিশুদের সুস্থ্ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল শিক্ষা দিতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।

শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজ হাতে কাজ করার আনন্দ, সহযোগিতার মাধ্যমে সমবেত জীবনের উচ্ছাস যেনো তারা উপলব্ধি করতে শেখে, সেটি নিশ্চিত করতে পারা প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা যেনো তার জীবনকে সহজ করে, অর্থময় করে। নৈতিকতার শিক্ষা যেনো শিশুরা তাদের কাজের মাধ্যমে অর্জন করতে পারে। জীবন সংগ্রামে সাহসিকতার সাথে মুখোমুখি দাঁড়াবার শিক্ষা যেনো তারা বিদ্যালয় থেকে পায়। প্রয়োজনে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াবার শক্তি যেনো শিশু অর্জন করতে পারে তার শিক্ষার মাধ্যমে। তা যদি না হয় তবে আর আশা নেই।

লেখক পরিচিতি

জগজ্জীবন বিশ্বাস খুলনা সদর থানা রিসোর্স সেন্টারে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে কর্মরত। জাপান থেকে পিজিডি ইন টিচার ট্রেনিং ও ইউকে থেকে এমএ ইন এডুকেশন সম্পন্ন করেছেন।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version