কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন নিয়ে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল চমৎকার একটি কলাম লিখেছেন প্রথম আলোতে গত ৪ এপ্রিলে। সেখানে তিনি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের ইতিবাচক দিক তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু আশঙ্কাও ব্যক্ত করেছেন। সবচাইতে বড় বিষয়, যারা ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’ টার্মটি শুনেছেন, কিন্তু সেটির সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই, তাদের জন্য তিনি খুব সহজ ভাষায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন। তাঁর লেখার পাশাপাশি আমি কয়েকটি বিষয় যুক্ত করতে চাই।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক বেনজামিন ব্লুমের নেতৃত্বে শিক্ষা-মনোবিদদের একদল গবেষক ১৯৫৬ সালে সর্বপ্রথম শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রগুলোকে বড় আকারে তিনটি ভাগে ভাগ করেন- জ্ঞানমূলক ক্ষেত্র (Cognitive domain), বিশ্বাস-অনুভূতিমূলক ক্ষেত্র (Affective domain) এবং মনোপেশীজ ক্ষেত্র (Psychomotor domain)। এই তত্ত্ব অনুসারে শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতাকেও তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- জ্ঞানমূলক দক্ষতা, বিশ্বাস-অনুভূতিমূলক দক্ষতা এবং মনোপেশীজ দক্ষতা।
জ্ঞানমূলক দক্ষতা মূলত শিক্ষার্থীর জ্ঞান-সম্পর্কিত যাবতীয় দক্ষতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত, যেগুলো খুব সহজেই লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পরিমাপ করা যায়। যেমন- বাংলাদেশের রাজধানীর নাম কী বা বন্যার ফলে কীভাবে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে ইত্যাদি। আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর নিজের বিশ্বাস ও অনুভূতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে কাজ করা বিশ্বাস-অনুভূতিমূলক ক্ষেত্রের মূল আলোচ্য বিষয়। এগুলো আংশিক লিখিত পরীক্ষার মাধ্যেম পরিমাপ করা গেলেও মূলত পর্যবেক্ষণ বা আলাপচারিতার মাধ্যমেই এই ক্ষেত্রের দক্ষতা পরিমাপ করা উচিত। যেমন- সৃষ্টিকর্তার প্রতি শিক্ষার্থীর বিশ্বাসের পরিবর্তন। মনোপেশীজ ক্ষেত্র সরাসরি প্রয়োগভিত্তিক। কোনো কিছু শেখার পর হাতে কলমে সেটি করতে পারা অর্থাৎ মনের শেখার সাথে পেশীর দক্ষতাকে সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে কিছু করতে পারা এই দক্ষতার আওতাভুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, কোনো শিক্ষার্থী কীভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকতে হবে তা জানার পর যদি সে নিজে হাতে মানচিত্র আঁকতে পারে, তাহলে তার এই মনোপেশীজ দক্ষতা অর্জিত হয়েছে বলা যাবে।
জ্ঞানমূলক ক্ষেত্র বা শিখন দক্ষতার ক্ষেত্রে জ্ঞানমূলক দক্ষতাকে চিত্রের মতো করে আরো ছয়টি উপক্ষেত্র (Sub-domain) বা ভাগে ভাগ করা যায়- জ্ঞান (Knowledge), অনুধাবন (Comprehension), প্রয়োগ (Application), বিশ্লেষণ (Analysis), সংশ্লেষণ (Synthesis) ও মূল্যায়ন (Evaluation)। এই মডেলে জ্ঞান সর্বনিম্নে, এবং মূল্যায়ন সবচাইতে উচ্চতর স্থানে অবস্থান করে। তার মানে এই নয় যে একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কিত নয় বা একটি আরেকটির চাইতে আলাদা। মূলত পিরামিড মডেল অনুযায়ী এগুলো উচ্চতর দক্ষতা নির্দেশ করে এবং অগ্রবর্তী দক্ষতা নিম্নবর্তী দক্ষতাগুলোকেও ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই পিরামিড মডেলে বিশ্লেষণ বা Analysis নিচ থেকে চতুর্থ স্থানে থাকলেও এই বিশ্লেষণ মূলত জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও বিশ্লেষণের সমষ্টিবদ্ধ রূপ। কোনো কিছু বিশ্লেষণ করতে চাইলে সে সম্পর্কিত জ্ঞান যেমন থাকতে হয়, তেমনি বিষয়টি অনুধাবন করতে প্রয়োগ করতে পারতে হয় এবং তার পরই মূল্যায়ন করা সম্ভবপর হবে।
কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রে মূলত এই ছয়টি উপক্ষেত্রই প্রতিফলিত হবে। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক-
অনুচ্ছেদ
তোমাদের মনে হতে পারে, পেঙ্গুইনের জীবনে বোধহয় আনন্দফুর্তির সুযোগ নেই। কিন্তু তা ঠিক নয়! সুযোগ পেলেই পেঙ্গুইনরা নানা খেলাধুলায় মেতে ওঠে। তাদের একটা প্রিয় খেলা হচ্ছে পেটের ওপর ভর দিয়ে মসৃণ বরফের উপর দুরন্ত গতিতে ছুটে যাওয়া। আবার সাগরের ঢেউয়ের মাথায় চড়ে তীরে আছাড় পড়তেও তারা খুব মজা পায়। উঁচু বরফের পাহাড় থেকে সমুদ্রের পানিতে লাফিয়ে পড়া সম্ভবত তাদের সবচাইতে প্রিয় খেলা! (অনুচ্ছেদ শিশুকিশোর মাসিক সাতরং-এর স্বাধীনতা দিবস সংখ্যার ১৮ নং পৃষ্ঠা থেকে সংগৃহীত)
প্রশ্ন ১: পেঙ্গুইনের প্রিয় খেলা কী?
প্রশ্ন ২: পেঙ্গুইনরা কীভাবে পাহাড় ও সমুদ্রকে তাদের খেলাধুলার কাজে ব্যবহার করে?
প্রশ্ন ৩: পেঙ্গুইনরা যেভাবে পাহাড় থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে, ঠিক সেরকম কী কী খেলা তুমি খেল? কীভাবে খেল?
প্রশ্ন ৪: তোমার পরিচিত পশু বা পাখি কীভাবে খেলা করে বর্ণনা দাও।/ মানুষ খেলাধুলা করে আনন্দ পায়, পশুপাখিরা কী কারণে খেলাধুলা করে?/ পশুপাখিদের সাথে মানুষের খেলাধুলা করাটাকে কি তুমি সমর্থন কর? কেন?
এই প্রশ্নগুলো কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের দুর্বল উদাহরণ। প্রশ্নপত্রপ্রণেতারা অবশ্যই অনেক চিন্তাভাবনা করে শক্তিশালী প্রশ্নপত্র তৈরি করবেন, এখানে শুধু উদাহরণ দেওয়ার জন্য প্রশ্নগুলো তৈরি করা হয়েছে। প্রথম প্রশ্নটি সরাসরি জ্ঞান উপক্ষেত্রের, যেখানে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থভিত্তিক বা অনুচ্ছেদেই দেওয়া রয়েছে। দ্বিতীয়টি অনুধাবন উপক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখানে অনুচ্ছেদটি পড়ে বুঝে তারপর উত্তর দিতে হবে। তৃতীয় প্রশ্নটি সরাসরি অনুচ্ছেদে নেই, কিন্তু অনুচ্ছেদের দৃশ্যকল্পটিকে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী নিজের মতো করে উত্তর তৈরি করবে। চতুর্থ প্রশ্নটির ক্ষেত্রে নাম ছাড়া আর কোনো উপাদানই অনুচ্ছেদে নেই। অনুচ্ছেদটির আবহ ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা নতুন একটি সমস্যা বা কল্পনাকে যুক্তির মাধ্যমে সমাধান বা উপস্থাপন করবে। চতুর্থ প্রশ্নের প্রথম অংশটি বিশ্লেষণ, দ্বিতীয়টি সংশ্লেষণ এবং তৃতীয়টি মূল্যায়ন উপক্ষেত্রের উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
২.
আমাদের দেশের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি মূলত জ্ঞানমূলক উপক্ষেত্রকে প্রতিফলিত করে। এই ধরনের প্রশ্নপত্রে শিক্ষার্থীর উচ্চতর দক্ষতাগুলোকে খুব একটা ব্যবহার করতে হয় না। মুখস্থবিদ্যা যার যতো শক্তিশালী, এই পদ্ধতি অনুসারে সে তত মেধাবী। এমনকি শিক্ষাপদ্ধতির বাহ্যিক কাঠামোর কারণে বিশ্লেষণ অংশের কিছু কিছু প্রশ্নও আপাতদৃষ্টিতে জ্ঞান-সম্পর্কিত হতে পারে। মুখস্থ করে যেমন সিয়েরা লিওনের রাজধানীর নাম পরীক্ষার খাতায় লেখা যায়, তেমনি মুখস্থ করে শীতের সকালের বর্ণনাও লেখা যায়। যদিও দ্বিতীয়টি উচ্চতর দক্ষতার আওতায় পড়ে। কিন্তু পড়ালেখার কাঠামো মুখস্থবিদ্যা হওয়ায় যে কেউ মুখস্থ করে একটি চমৎকার শীতের সকাল-সম্পর্কিত রচনা লিখতে পারে। ফলে প্রশ্নপত্রের পাশাপাশি লেখাপড়ার সিস্টেম কতোটুকু মুখস্থবিদ্যার জন্য সহায়ক, সেটিও কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের সফলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে- ২০০০ সালের এডুকেশন ওয়াচ গবেষণায় পঞ্চম শ্রেণী সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের যে আদর্শায়িত প্রশ্নপত্রের মাধ্যেম মূল্যায়ন করা হয়েছিলো, তাতে দেখা গিয়েছিলো প্রাথমিক শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত ২৭টি জ্ঞানমূলক প্রান্তিক যোগ্যতার সবগুলো অর্জন করতে পেরেছে মাত্র ১.৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। অথচ তাদের অধিকাংশই তখন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে এবং বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে। এমনটা কেন হলো? এমনটা হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে- বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষায় যেখানে জ্ঞানমূলক প্রশ্নের ছড়াছড়ি, সেখানে এডুকেশন ওয়াচের প্রশ্নপত্রে অন্য উপক্ষেত্রগুলো থেকেও বেশকিছু প্রশ্ন ছিলো। বিশ্লেষণ করে এও দেখা গেছে, জ্ঞানমূলক প্রশ্নগুলোতে শিক্ষার্থীরা যতোটুকু দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, বাকি উপক্ষেত্রের প্রশ্নগুলোতে তারা ততোটাই অদক্ষতা প্রকাশ করেছে। এডুকেশন ওয়াচ গবেষণায় এ ব্যাপারে বিস্তারিত দেওয়া আছে।
বলা হচ্ছে, কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের বিষয়টি শিক্ষকরাই যেখানে বুঝতে পারছেন না, সেখানে শিক্ষার্থী বা অভিভাবক কীভাবে এই ধরনের প্রশ্নপত্রের আলোকে নিজেদের তৈরি করবে? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। গবেষণাগারে পরিবেশ কিংবা বস্তুনিরপেক্ষ গবেষণা বিজ্ঞানস্বীকৃত, কিন্তু সামাজিক বিজ্ঞানের আওতায় যে কোনো উদ্যোগেই যারা সরাসরি প্রভাবিত হবে, তাদেরকে প্রথম থেকেই যুক্ত করতে হয়। কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্র যদিও শিক্ষণ-শিখনের দিক থেকে চমৎকার উদ্যোগ, কিন্তু যারা সরাসরি এর সাথে সম্পর্কিত তারা যদি এটি ভালোভাবে বুঝতে না পারেন, তাহলে এই চমৎকারিত্বের কোনো ব্যবহারিক মূল্য থাকে না।
২০১০ সাল থেকে এসএসসি পরীক্ষা হবে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের আওতায়। কিন্তু এর জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক, কেউই প্রস্তুত নয়; তাদেরকে প্রস্তুত করা হয়নি। মূলত এই ধরনের প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীর দক্ষতায় কী পরিবর্তন আনবে, সেটি যেমন অভিভাবকরা জানেন না; তেমনি কীভাবে এই প্রশ্নপত্রের বিন্যাস, মূল্যায়ন ও গঠন হবে, শিক্ষকরাও তা জানেন না। পাশাপাশি কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, সে বিষয়টি শিক্ষার্থীদের কাছে তো অজানাই। ফলে শিক্ষার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত তিনটি মূল গ্রুপই আসলে এর বাইরে অবস্থান করছে, সবকিছু বাস্তবায়িত হচ্ছে কর্মকর্তাদের মাথা থেকে। ফলে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের চমৎকারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই, প্রচলিত শিক্ষার মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর দক্ষতা অর্জন ও তার মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যতোটুকু অপ্রাসঙ্গিক, ঠিক ততোটুকু বা তার বেশি প্রাসঙ্গিক এই কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যেম মূল্যায়ন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঠিক দক্ষতা যেভাবে মূল্যায়ন করা যায়, ঠিক তেমনি শুরু থেকেই শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা ও মননশীলতাকে চর্চা করিয়ে তাদের সুপ্ত মেধাকে বিকশিত করা যায়; প্রচলিত পদ্ধতিতে যা একেবারেই অসম্ভব।
কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের বিরোধিতা করছেন অনেকেই। এই বিরোধিতা আসছে দু’দিক থেকে। যারা এই ধরনের প্রশ্নপত্রের সুফল বা ধরন সম্পর্কে অবগত নন, তারা বিরোধিতা করছেন একরকমভাবে। আর যারা এর উপযোগিতা সম্পর্কে সাংঘাতিকভাবে সচেতন, তারা বিরোধিতা করছেন অন্যভাবে। প্রথমপক্ষ মূলত অজ্ঞানতায়-ভয়ে নতুন পদ্ধতির বিরোধিতা করছেন; দ্বিতীয়পক্ষ করছেন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া এই পদ্ধতির প্রয়োগ শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার মনে পদ্ধতিটি সম্পর্কে বিরাগ সৃষ্টি করতে পারে, শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষতি সফলতা অর্জনে বাধা হয়ে দাড়াতে পারে এই চিন্তা থেকে। শিক্ষাতত্ত্বে একটি বিষয়কে খুবই গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। শিক্ষার্থীকে যা শেখানো হয় না, সে বিষয়ে তাকে মূল্যায়ন করার অধিকার কারো নেই। যদি মূল্যায়ন করে বলা হয়, শিক্ষার্থী এটি পারে বা পারে না, তাহলে গবেষণার নৈতিকতার দিক থেকে এটি চূড়ান্ত অনৈতিক কাজ বলে গণ্য করা হয়। এখন প্রথম থেকে শিক্ষার্থীদের এই পদ্ধতির সাথে পরিচিত না করিয়ে হুট করে তাদের এভাবে মূল্যায়ন করাটা একধরনের অনৈতিক কাজের মতোই মনে হচ্ছে। উদ্দেশ্য সাধু হলেও কর্মকৌশলের কারণে সেটি বিপরীত হতে পারে। এই শিক্ষার্থীদেরই যদি ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের আলোকে মূল্যায়ন করা হতো, তাহলে একটি চমৎকার কাজ হতো সন্দেহ নেই।
শিক্ষকদের মূল্যায়ন দক্ষতাও এখানে একটি বড় ব্যাপার। বইয়ের বাইরে বা মুখস্থবিদ্যার বাইরে গিয়ে কেউ একলাইন লিখলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটিকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়; শিক্ষকরা সরোষে কেটে দেন। এখন কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নে অনেক প্রশ্নই থাকবে, যার উত্তর বইতে নেই, সেগুলোকে শিক্ষকরা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? তারা কি পুরনো মানসিকতা থেকে শিক্ষার্থীদের নম্বর প্রদান করা থেকে বিরত থাকবেন? ধরে নিলাম, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষকরা প্রচলিত গণ্ডীর বাইরের উত্তরকে মূল্যায়ন করতে সমর্থ; কিন্তু সৃজনশীল উত্তরে শিক্ষকদের সম-উপযোগিতা বা সমব্যবহার (Homogeneity) কীভাবে বজায় রাখা যাবে? দেখা যাবে, যে ধরনের সৃজনশীল বা মননশীল উত্তরে এক ধরনের শিক্ষক ১০-এ ৫ দিচ্ছেন, আরেকজন হয়তো সেখানে ৮ দিচ্ছেন। কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভালোভাবে প্রস্তুত না করেই মূল্যায়নের মাঠে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। যার আরেকটি অবশ্যম্ভাবী ফলাফল- মূল্যায়নে বৈষম্য সৃষ্টি।
আমি সচেতনভাবই চাই, আমাদের দেশে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু হোক। কিন্তু তার আগে এর সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে তৈরি করিয়ে নিতে হবে। সবচাইতে ভালো হয়, নবম-দশম শ্রেণীতে চালু না করে আগে শিক্ষকদের সময় নিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কাজ শুরু করা। যদি আগামী বছর থেকেও ধাপে ধাপে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পরে ষষ্ঠ শ্রেণীতে কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নপত্র চালুর কাজ শুরু হয়, তাহলে ২০১৫ সালের মধ্যেই মাধ্যমিক স্তরে সফলভাবে এটি চলমান রাখা সম্ভবপর হবে। না হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবার বিরোধিতায় চমৎকার এই উদ্যোগটিকে কবর দিতে হবে।
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।