বাড়ি পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রশ্নফাঁস ও শতভাগ পাশ: কাঠামোগত, সংগঠনগত ও ব্যবস্থাপনাগত ভিত্তি

প্রশ্নফাঁস ও শতভাগ পাশ: কাঠামোগত, সংগঠনগত ও ব্যবস্থাপনাগত ভিত্তি

সাম্প্রতিককালে আমাদের শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে নতুন যে মাত্রা যোগ হয়েছে এবং যা নিয়ে সমাজের নানা স্তরে কথা হচ্ছে তা হলো প্রশ্নফাঁস এবং পাশের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ছবিটি নেওয়া হয়েছে দৈনিক যুগান্তর থেকে।
সাম্প্রতিককালে আমাদের শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে নতুন যে মাত্রা যোগ হয়েছে এবং যা নিয়ে সমাজের নানা স্তরে কথা হচ্ছে তা হলো প্রশ্নফাঁস এবং পাশের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। ছবিটি নেওয়া হয়েছে দৈনিক যুগান্তর থেকে।

সাম্প্রতিককালে আমাদের শিক্ষার প্রায় সকল স্তরে নতুন যে মাত্রা যোগ হয়েছে এবং যা নিয়ে সমাজের নানা স্তরে কথা হচ্ছে তা হলো প্রশ্নফাঁস এবং পাশের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। প্রশ্নফাঁস একটি নেতিবাচক বিষয়, কিন্তু পাশের হার বৃদ্ধিটা ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু লক্ষ্য করা যায় ইতি-নেতি দুটো নিয়েই সমাজে উদ্বেগ প্রকাশ পাচ্ছে।

তবে সরকারের দিক থেকে আমরা দেখছি নেতিবাচক বিষয়টাকে অস্বীকার করতে এবং ইতিবাচক বিষয়টি যেভাবেই অর্জিত হোক তাকে সাফল্য হিসাবে প্রচার করতে। আমরা স্মরণ করতে পারি দু-দশক আগেও শিক্ষা বিষয়ে সচেতন মানুষের উদ্বেগ ছিল মূলত নকলের ছড়াছড়ি ও পাশের হারের স্বল্পতা নিয়ে। অর্থাৎ তখন দুটোই ছিল নেতিবাচক বিষয়। সরকারের দিক থেকে তখন পাশের হার কমলে তা নকল রোধ করতে পারার সাফল্য হিসাবে প্রচার করা হতো।

এই প্রেক্ষাপটে কিছু প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে চলে আসে তা হলো, কিভাবে আগের অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি হলো? কেন এত প্রশ্নফাঁস হচ্ছে, বা সরকার কেন প্রশ্নফাঁসের তথ্য-প্রমাণ থাকলেও তা অস্বীকার করছে? কেনই-বা সরকার মূল্যায়ন-প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত ক’রে বা শিক্ষকদের নীতি-নৈতিকতাকে আরো নীচে নামতে বাধ্য ক’রে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পাশের হারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করছে?

এগুলোর উত্তর স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে গত শতকের নব্বই দশক থেকে যেসব সরকার আমরা পেয়েছি তাদের বাস্তবায়িত শিক্ষা-কর্মসূচী ও সিদ্ধান্ত-বিষয়ক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে আমরা খুঁজে পাবো। এই তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে আমরা আমাদের বহুধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার মূল ধারাতেই এ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবো। 

২.

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার তুলনা করলে একটা বিষয় সাধারণভাবে বলা যায়: প্রাথমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে অধিকাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারী হাইস্কুলে পড়ে। কিন্তু সরকারের তথ্য থেকেই দেখা যাচ্ছে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা সেই ১৯৭৪ সালে যা ছিল ২০১০ সালে এসেও প্রায় তাই-ই রয়ে গেছে।

১৯৭৪ সালে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৩৬ হাজার ১৬৫টি [১] এবং ২০১০ সালে এসে সেটা হয়েছে ৩৭ হাজার ৬৭২টি [২]। এই বৃদ্ধি খুবই নগণ্য, কারণ এ সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা এবং ভর্তির হার দুটোই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে, কিন্তু সরকারী স্কুলের সংখ্যা প্রায় বাড়েনি বললেই চলে। তবে সরকারী স্কুল না বাড়লেও ১৯৭৫ সাল থেকেই নিবন্ধিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে।

১৯৭৪ সালে যেখানে এ ধরণের স্কুল ছিল মাত্র ৪৬৮টি সেখানে ১৯৭৫ সালেই এটা হয়েছে ৩ হাজার ৭৪৯টি [৩]। ১৯৯০ সালে গিয়ে নিবন্ধিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হয় ৯ হাজার ৫৮৬ [৪] এবং ২০১০ সালে এটা পৌঁছায় ২০ হাজার ৬১টিতে [৫]। এসব নিবন্ধিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুব অল্প পরিমাণ ভাতা এবং শিক্ষার্থীদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত কিছু বই – তাও নতুন-পুরনো মিলিয়ে – দেওয়া হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে।

এই স্কুলগুলো স্থাপিত হওয়ার কারণ মানুষের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সরকারী স্কুল নিকট-দূরত্বে না থাকা, ইত্যাদি। কিন্তু এসব স্কুলের নিবন্ধন, শিক্ষক নিয়োগ, নিয়োগ চূড়ান্তকরণ এসবের সাথে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক, এবং এর সাথে একটা আর্থিক লেনদেনের সম্পর্ক ছিল। শিক্ষকদের বহু দাবী, বহু আন্দোলন-সংগ্রাম-অনশন এবং বিভিন্ন সরকারের বহু অঙ্গীকার ও বহু অঙ্গীকার ভঙ্গের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালে ২২ হাজার ৬৩২টি নিবন্ধিত বেসরকারী স্কুলকে সরকারীকরণ করা হয় [৬]।  

স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রায় সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার পর শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে আরেকটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ১৯৯০ সালে।

To fulfill the constitutional obligation of Universal Primary Education, the Government promulgated the Primary Education (Compulsory) act 1990 [৭].

উল্লেখ করা যেতে পারে এই সিদ্ধান্ত ছিল এক সামরিক স্বৈরশাসকের। এই অধ্যাদেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হলে ভর্তি উপযোগী শিশুর বিশাল সংখ্যা সরকারের জন্য একটা বাড়তি চাপ ও দায় হয়ে আসে। কারণ ১৯৯০ সালে আমরা দেখি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন উপযোগী বয়সের (৬-১০) মোট শিশুর মধ্যে স্কুলে যায় মাত্র ৬০.৫% [৮] (১ কোটি ২০ লক্ষ ৫১ হাজার ১৭২ [৯])।

তাহলে আরো প্রায় ৪০% শিশু অর্থাৎ প্রায় ৭৮ লক্ষ ৬৮ হাজার ১২০ জন শিশু তখনো স্কুলেই যায় না। উপরন্তু যারা স্কুলে যায় তাদের ক্ষেত্রে সেসময় গড়ে ৬৩ জনের জন্য একজন শিক্ষক ছিলেন। কারণ ১৯৯০ সালে সরকারী ও নিবন্ধিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলে মোট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ৫০৮ ও ১ কোটি ২০ লক্ষ ৫১ হাজার ১৭২ [১০]। তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ৬৩, যা মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য ছিল চরমভাবে প্রতিকূল।

এই দুটো বিষয় অর্থাৎ শিক্ষার বাইরে থেকে-যাওয়া বিপুল সংখ্যক শিশু এবং শিক্ষা-প্রতিকূল শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সেসময়ের সরকারকে সংকটে ফেলে থাকবে। কারণ এই চরম প্রতিকূল অনুপাতেও যদি প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে থেকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ভর্তি নিশ্চিত করতে হয় তাহলে নতুন স্কুল লাগে প্রায় ৩০ হাজার ৮৪৩টি এবং শিক্ষক লাগে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৪৬৬ জন।

কিন্তু ঘোষিত নীতি ও তার গুরুত্ব বিবেচনায় এর জন্য যে-পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল তা সরকার দেয়নি। না দিয়ে সরকার যেটা করেছে তা হচ্ছে, নিবন্ধিত বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আরো বাড়ানোর সাথে সাথে এনজিও নামের উন্নয়ন বাণিজ্যিক সংগঠনের শিক্ষা-কর্মসূচীকে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত কিন্ডারগার্টেনকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃতির সুযোগ করে দিয়েছে।

আর এভাবেই সরকার তারই ঘোষিত বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দায় এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়! এই প্রক্রিয়ায় বিত্তহীন ও নিম্নবিত্তসম্পন্ন অভিভাবকেরা কিছু সুবিধা পেয়ে এনজিও-র স্কুলে, এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী বা শিক্ষায় মানের আকাঙ্ক্ষী নিম্নমধ্যবিত্ত-মধ্যবিত্ত অভিভাবকেরা বুঝে-না-বুঝে তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেনে পাঠানোর দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। এসময় আমরা বিভিন্ন এনজিও-র কাছ থেকে শুনতে পাই তাদের হাজার-হাজার স্কুল আছে, তাদের লক্ষ-লক্ষ লার্ণিং সেণ্টার আছে – অনেকটা এ ধরণের কথা ।

শুধু তা-ই নয়, ১৯৮৮ সালে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলাম তৈরী করে তার ভিত্তিতে ১৯৯১ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত হলেও সেই পাঠ্যপুস্তক সরকারী ও নিবন্ধিত বেসরকারী স্কুল বাদে আর কোথাও দেওয়া হয়নি। এসময়ে অনেক এনজিও, অনেক কিন্ডারগার্টেন এনসিটিবি প্রকাশিত প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য আবেদন করে করে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর থেকেই দীর্ঘ অনেক বছর ধরে আমরা দেখেছি সরকার প্রণীত পাঠ্যপুস্তকগুলোর ফটোকপি করা, নকল করে ছাপানো, পুলিশের ধরপাকড়, পুরনো বই কেনা, ইত্যাদির খবর।

ফলে মূলত দেশী-বিদেশী এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক স্তরের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় ও কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোর জন্য এলোমেলো নিম্নমানের পাঠ্যবই রচনা, সিলেবাসভুক্ত করানো ইত্যাদির বিস্তৃতি ও বাণিজ্য সেসময় থেকেই দ্রুত ঘটতে থাকে। শিক্ষার্থীর বয়স, পরিবেশ, বিপন্নতা ইত্যাদি বিষয়কে মুখ্য করে তুলে এনজিওগুলো শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক, ম্যানুয়াল ইত্যাদি প্রণয়নের জন্য বিদেশী অর্থায়নে বহু পর্যায়ের দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞ-কনসালট্যাণ্ট ভাড়া করে, বহু অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে অনেকসময় অপ্রয়োজনীয় এবং সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক পাঠ্যবই প্রণয়ন করে অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ হতে থাকে।

একই সাথে বহু ধরণের এনজিও-র নানা প্রকারের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তৃতিতে সরকারের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বহু বহু প্রকল্পে অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটে; সুযোগ ঘটে বড় বড় অঙ্কের বেতনপ্রাপ্তির ও দেশবিদেশে অধিক অধিক কর্মশালা-প্রশিক্ষণ-সেমিনারে অংশগ্রহণের, ঘুরে-বেড়ানোর।

সেই সাথে বহু ধরণের সরবরাহ-বাণিজ্যের সুযোগ পায় মূলত রাজনীতির সাথে যুক্ত বা আশীর্বাদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গ। মূলত এই দুটি কারণে মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চেয়েও সরকারের মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের জায়গা হয়ে ওঠে অনেকসময় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা। এর এমন প্রকল্পও খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে শিক্ষার্থী-প্রতি সারাবছরের ব্যয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চেয়েও বেশী।

কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাবে এখানকার শিক্ষকদের আক্ষরিক অর্থেই গৃহপরিচারিকার চেয়েও কম বেতন দেওয়া হয়েছে আর অধিক পরিশ্রম করানো হয়েছে, যা এখনো অব্যাহত আছে। অথচ এসব অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার নানা প্রকল্প যখন পাইলটিং বা স্বল্পমেয়াদে ছোট আকারে ক’রে সম্ভাবনা যাচাই করা হয় তখনই এর কর্মকর্তাগণ বড় অঙ্কের বাজেট বণ্টন করে রাখেন নিজেদের জন্য; প্রকল্পগুলো সেভাবেই প্রণয়ন করা হয়। আর সেসময়ে শিক্ষকেরা যেটুকু বেতন পান অনেকসময় তার তিন ভাগের একভাগ বেতনও পান না প্রকল্প যখন দীর্ঘমেয়াদে বাস্তবায়নে যায়। 

একই সাথে মূলধারার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধিতে চরম প্রতিকূল ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কিছুটা অনুকূলে আনতে নব্বইয়ের দশক থেকেই অধিক সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ অপরিহার্য বিবেচিত হয়। এসময়ে ‘ডোনার’ নামের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যবসায়ী চক্রের চাপে শিক্ষক নিয়োগে নারীদের হার ক্রমে বাড়াতে বাড়াতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত করার কথা বলা হয়।

আগে থেকেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিকূল ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের পাশাপাশি পাঠ্যবই যথাসময়ে না পাওয়া, বই ছাড়া আর কোনো শিক্ষা-উপকরণ না থাকা, অনাকর্ষণীয় শ্রেণীকক্ষ, শ্রেণীকক্ষের স্বল্পতা, শিক্ষকদের অপ্রতুল বেতন ইত্যাদি সংকট ছিল; এর সাথে যোগ হলো নতুন শিক্ষক, বিশেষ করে নারী-শিক্ষক নিয়োগের নামে অযোগ্য, অল্পশিক্ষিত নারীকে অর্থের বিনিময়ে অসাধু প্রক্রিয়ায় নিয়োগের বাণিজ্য। শিক্ষাদানের সাবেকী মূল্যবোধ যা ছিল তা টাকার বিনিময়ে অযোগ্য-অশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগের ছড়াছড়িতে একেবারে নেই হয়ে গেল।

আর এসব শিক্ষক রাজনীতি-প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় এবং অনেক অর্থ ব্যয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অল্প বেতন পাওয়ায় ক্লাস-পরিচালনা তাদের অধিকাংশের কাছেই কখনো আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠেনি। কোনো প্রশিক্ষণই তাদের কাছে একটু ভাতা প্রাপ্তির বাইরে আর কিছু ছিল না। এর পাশাপাশি নানা স্বার্থে পাঠ্যবই, বাংলা বানান ইত্যাদি নিয়ে কুপরিকল্পিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে শিক্ষকদের কাছে, বিশেষ করে পুরনোদের কাছে প্রতিবছর পাঠ্যবই অপরিচিত ও ক্ষেত্রবিশেষে বিভ্রান্তিকর মনে হতে থাকে।

তাঁরা পাঠদানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং প্রায় অধিকাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ-নির্দেশনা, শিক্ষক-সহায়িকা এসব ছেড়ে, পাঠ্যবইয়ের বাইরের সকল উপকরণ বাক্সবন্দী করে সাবেকী রীতিতে কোনোমতে পাঠদান করতে থাকেন।

এর ফলে শিক্ষার্থীদের পড়তে শেখা আর লিখতে শেখার সংকট আরো বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে অর্থাৎ নব্বই দশকেই আমরা দেখি পড়ার দক্ষতা, লেখার দক্ষতা বাড়ানোর নামে বহু বহু টাকা বাজেটের আইডিয়াল প্রজেক্ট, এসটিম প্রজেক্টসহ নানা প্রকল্প করে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মতোই আনুষ্ঠানিক শিক্ষায়ও বিশেষজ্ঞ-কর্মকর্তাদের বড় বড় আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে। পাশাপাশি দেখি শিক্ষায় আগ্রহ হারানোদের বা একটু লিখতে-পড়তে পারাদের বা ঝরে পড়াদের লেখা ও পড়া ভুলে যাওয়া ঠেকাতে ধারাবাহিকভাবে আরো সুন্দর সুন্দর নামের প্রকল্প ফাঁদতে [১১]।

৩.

সংকট হলো মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে – এই স্তরে যেহেতু অধিকাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারী স্কুলে পড়ে, এই স্কুলের সংখ্যা যখন অপরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলা হলো। দেখা যাচ্ছে বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা স্বাধীনতার পর ছিল ৫ হাজার ৬৪৬, কিন্তু ২০০০ সালেই এটা হয়ে গেছে ১৫ হাজার ৪০৩ [১২]। কিন্তু সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা স্বাধীনতার পর যেখানে ছিল ১৪৮ সেখান থেকে এটা ২০০৮ সালে এসেও রয়ে যাচ্ছে মাত্র ৩১৭ [১৩]। 

বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এই অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধির কারণ মূলত কালো টাকা এবং সেইসাথে এর শিক্ষক নিয়োগ, নির্মাণকাজ, পাঠ্যবই নির্বাচন ইত্যাদি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিম্ন থেকে উচ্চ নানা স্তরের রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গের ব্যাপক আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ ঘটা। পাশাপাশি এসব স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ্যতার বিবেচনায় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দলীয় বা আত্মীয় পরিচয় বিবেচনা করে কিছু বেকারের কর্মসংস্থান করাও সম্ভব হয়। কিন্তু এই অপরিকল্পিতভাবে স্কুলের সংখ্যাবৃদ্ধিতে মাধ্যমিক স্তরে এক ধরণের শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেয় নব্বই দশকের প্রায় শুরু থেকেই।

দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৫২ হাজার ৫১ এবং ১৩ লক্ষ ৫২ হাজার ৭০০ [১৪]। অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ২৫.৯৮। এই অনুপাত দুই দশক পার করেও ১৯৯০ সালে এসে হচ্ছে ১ : ২৪.৩ [১৫]। কিন্তু অন্যদিকে স্বাধীনতার পর প্রাথমিক স্তরে সরকারী-বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিল ৫২ লক্ষ ৫০ হাজার ৮১৯ এবং মোট শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ১৭ হাজার ২৭৫ [১৬]। আর শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ৪৪.৭৭।

এই অনুপাত ১৯৯০ সালে এসে হয়ে গেছে ১ : ৬৩, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত চরম বিপরীতমুখী পরিস্থিতির চিত্র নির্দেশ করছে। এসময়েই ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবীতে বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকেরা ব্যাপক আন্দোলন করেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে সারা দেশের শিক্ষকেরা ক্লাস ও এসএসসি পরীক্ষার দায়িত্ব বর্জন করলে এক চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সরকারী স্কুলের শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মকর্তা দিয়ে জেলাশহরের কেন্দ্রগুলো পরিচালনা করা সম্ভব হলেও সারাদেশের পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে সেসময়ে নকলের এক ধরণের বন্যা বয়ে যায়।

এসব কারণেই বাধ্যতামূলক সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা ঘোষণার পর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির চাপ এড়ানোর জন্য গৃহীত কৌশলের পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরের বেসরকারী স্কুলে শিক্ষার্থী বাড়ানোরও একটা তাগিদ এসময় থেকে অনুভূত হয়। সে-কারণেই নব্বই দশকের প্রায় শুরুতেই মাত্র ৫০০টি এমসিকিউ প্রশ্নের একটি প্রশ্নব্যাংক করে গণিত ছাড়া সকল বিষয়ে ৫০ নম্বর পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। কি ভয়াবহ শিক্ষা উন্নয়নমূলক সিদ্ধান্ত! প্রতি বিষয়ে ৫০০টি টিক মুখস্থ করলেই ৫০ নম্বর নিশ্চিত!

এর পাশাপাশি আগের মতোই শহরের কেন্দ্রগুলোকে অপেক্ষাকৃত নকলমুক্ত রেখে গ্রাম বা থানার পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোতে নকলের প্রবাহ অব্যাহত রাখা হয়। নকল করতে দেওয়া হবে এমন নিশ্চয়তা প্রদান করে অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে নতুন নতুন পরীক্ষাকেন্দ্রও চালু করা হয়। সুতরাং এখন যেটা প্রশ্নফাঁস, উত্তর বলে দেওয়া আর মূল্যায়নে শিথিলতার মাধ্যমে ক্ষমতা-কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট মুষ্টিমেয় মানুষের বাইরের সকল মানুষের সন্তানদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করা, ঠিক এর আগের রূপটি ছিল নগর ও প্রধান প্রধান শহরের ভালো স্কুলগুলোকে নকলমুক্ত রেখে গ্রামগঞ্জের কেন্দ্রগুলোতে নকলের বিস্তৃতির সুযোগ দিয়ে প্রান্তের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করা।

লক্ষ্যণীয় যে, ১৯৯০ সালেও যেখানে এসএসসিতে পাশের হার ছিল ৩১.৭৩% সেখানে ১৯৯১ সালে হচ্ছে ৬৪.৯৪%, ১৯৯২ সালে হচ্ছে ৬১.৬০% এবং ১৯৯৪ সালে হচ্ছে ৭১.৪৬% [১৭]। পাশের হারের এই উল্লম্ফনের সময়ে অনেক বয়স্ক মানুষ এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, পাশ করছে এমন খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে ‘এসএসসি পাশ এখন সহজ’ – এমন একটা ধারণা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে শিক্ষা অব্যাহত রাখার পক্ষে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরণের প্রণোদনা সৃষ্টি করা হয়। এর পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের শিক্ষা উপবৃত্তিও চালু করা হয়।

ফলে এই দশকে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এমনভাবে বাড়তে থাকে যে স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধির হার অব্যাহত থাকলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১৯৯০ সালের ১ : ২৪.৩ থেকে ২০০০ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ১ : ৪৩.৯১ [১৮]। কি বিস্ময়কর! এতে বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রবেতন আদায় বৃদ্ধি পায়, শিক্ষকদের প্রাইভেট-টিউশন থেকে আয় বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের সরকারী ভাতা বাড়ানোর দাবীকে সামাল দেওয়াও সম্ভব হয়।

এরপর ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে আরো প্রায় ৩ হাজার [১৯] মাধ্যমিক বিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়ায় এবং মফস্বল ও গ্রাম এলাকার কেন্দ্রগুলোতে নকলের বিস্তৃতি একটু রোধ করায় পাশের হার যেমন কমে আসে (২০০৩ সালে ৩৫.৯১%) [২০] একই সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতও অনেকটা সহনীয় হয়ে আসে (২০০৫ সালে হয় ১ : ৩১.০৬ ) [২১]।

এর ফলে স্কুল-পরিচালনার জন্য যথেষ্ট শিক্ষার্থীর সংকট অনেক স্কুলে আবারও শুরু হয়। নানারকম খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে – শিক্ষার্থী নেই, অথবা একজনও এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করেনি, শিক্ষক বসে বসে সরকারী ভাতা নিচ্ছেন – এ রকম। এই সংকট কাটানোর চাপ পড়ে প্রাথমিক স্তরের উপর। এসময় ছাত্রী উপবৃত্তি পাওয়ার জন্য প্রাথমিকে অনুত্তীর্ণ ছাত্রীরাও হাইস্কুলে ভর্তি হতে শুরু করে, এবং তাদের এমন সুযোগ দেওয়া হয় নারী শিক্ষার হার বাড়ানোর নামে।

একইসাথে ২০০২ সাল থেকে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার প্রায় ২০% থেকে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে ২০০৮ সালে বাধ্যতামূলকভাবে প্রায় ৪০%-এ নিয়ে আসা হয় [২২]। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ২০০২ সালে পঞ্চম শ্রেণীর মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত মেধাবী প্রায় ২০% শিক্ষার্থী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও তাদের মধ্যে পাশ নম্বর পেয়েছে মাত্র ৪৪.১৯% [২৩]। সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের ক্ষেত্রে এটা একটা সংকট হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকবে।

উল্লেখ্য ১৯৮০ বা ৯০ দশকের শুরুতেও বৃত্তি পরীক্ষায় কারা অংশগ্রহণ করবে তার সিদ্ধান্ত স্কুল-কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবকেরা নিতেন। এরপর থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের হার বাড়ানোর পাশাপাশি পাশের হারেরও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি আমরা দেখতে পাই। ২০০৮ সালে বৃত্তি পরীক্ষায় পঞ্চম শ্রেণীর মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০% অংশগ্রহণ করে পাশ করে ৭৪.০৩% [২৪]। 

তবে একই সাথে দেখা যায় স্কুলগুলোকে বাধ্য করে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য ৪০% শিক্ষার্থীর আয়োজন করা হলেও ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী পরীক্ষাই দিতে যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০০৮ সালে পরীক্ষাকেন্দ্রে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর হার গিয়ে পৌঁছায় প্রায় ১৩% [২৫]। এর কারণ হতে পারে স্কুলগুলো বাধ্য হয়ে নাম পাঠালেও শিক্ষার্থী নিজেকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত মনে করছে না, বা অভিভাবক তাঁর সন্তানের যোগ্যতা বিবেচনা করে দূরের উপজেলা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য সময় ও অর্থ খরচ করতে চাচ্ছেন না।

এরপরই ২০০৯ সালে সকল শিশুকে বৃত্তি পরীক্ষার মতো অভিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থায় আনতে পিইসিই বা সাধারণের মুখে উচ্চারিত এই পিএসসি পরীক্ষার সূচনা হয়, পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এতে সকল শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করলেও পাশের হার অলৌকিকভাবে প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে যায় [২৬]। পূর্বে উল্লেখিত এই হারটা আবার স্মরণ করা প্রয়োজন যে, ২০০২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২০% অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাশ করছে ৪৪%, ২০০৮ সালে ৪০% অপেক্ষাকৃত মেধাবী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে পাশ করছে ৭৪%, আর এর এক বছর পরই সকল শিক্ষার্থী পিএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করছে প্রায় ৯০%!

৪.

২০০০ সালের পর থেকে বৃত্তি পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর বা ২০০৯ সালে পিএসসি পরীক্ষা চালুর মাধ্যমে অস্বাভাবিকভাবে এই পাশের হার বাড়ানোর প্রয়োজন কেন পড়লো সরকারের? কারণ জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি)। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোর একটা হলো শিক্ষা নিয়ে, যার মূল কথা হলো ২০১৫ সালের মধ্যে সকল শিশু প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করবে ও সকল মানুষ শিক্ষিত হবে।

২০০০ সালে জাতিসংঘ এই লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে এটা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ অন্যান্য উন্নয়ন-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিশাল বিশাল ঋণ ও অনুদান প্রদান এবং পুরাতন ঋণ-সুদ ইত্যাদি মওকুফ করাসহ ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। এবং এর সাথে সাথে আমাদের মতো নিম্নআয়ের ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো অনেকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরই ভিত্তিতে পিইডিপি-২, পিইডিপি-৩ ইত্যাদি হাজার হাজার কোটি টাকার শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচীর নাম আমরা শুনতে থাকি।

তবে সময় যত কমে আসতে থাকে উদ্বেগ তত বাড়তে থাকে। সে-কারণে শিক্ষা বিষয়ক এমডিজি-২ বাস্তবায়নে ২০০৮ সালের পর থেকেই ব্যাপক তোড়জোড় শুরু করা হয়। হিসেব করে দেখা যায় ২০০৮ সালেও যত শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে তার মাত্র ৫০% পঞ্চম শ্রেণী শেষ করছে [২৭]। এই চিত্র ২০১৫ সালের মধ্যে সকল শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করবে এমডিজি পূরণের এমন অঙ্গীকার বাস্তবায়ন যে অসম্ভব তা নির্দেশ করেছে। এটা বুঝেই পিএসসি চালু করে শতভাগ পাশের নিশ্চয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে অসাধ্য সাধনের অসাধু একটা উপায় খুঁজে পায় সরকার ও তার আমলা-কর্মকর্তাগণ।

“জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০” যাঁরা প্রণয়ন করেছেন তাঁদের কেউ কেউ এ ধরণের পরীক্ষা তাঁদের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে ছিল না এমনটা বললেও আমরা দেখতে পাই এটা মুদ্রিত শিক্ষানীতিতে রয়েছে [২৮]। এই ব্যবস্থার ফলে একদিকে যেমন প্রথম শ্রেণীতে যারা ভর্তি হচ্ছে তাদের প্রায় সবারই পঞ্চম শ্রেণী পাশের নিশ্চয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে ঝরে পড়ার হার রোধ করা এবং এমডিজি-২ অর্জনের বিষয়ে অগ্রগতি মাপা সম্ভব হচ্ছে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী যোগানও ব্যাপকভাবে বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে।

অর্থাৎ প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাটা চাহিদার দিক থেকে চরমভাবে সরে যোগানের দিক থেকে চরম উৎকণ্ঠার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এই ধ্বংস-প্রক্রিয়া নিয়ে যোগানদারের উৎকণ্ঠা একেবারেই নেই, কারণ মুষ্টিমেয় যোগানদার-শাসকশ্রেণীর প্রজন্ম এই শিক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না। তারা হয় উন্নত দেশে পড়াশোনা করছে অথবা সেখানকার শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচী, পাঠ্যবই অনুসরণ করে এদেশেই পড়ছে এবং একই পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে মান অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

৫.

আরেকটি বিষয় বিবেচ্য। মূলত বৈষয়িক কারণে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা অনেক সময় সরকারের আমলা-কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের আগ্রহের জায়গা হলেও কিন্ডারগার্টেনগুলো যেহেতু এক ধরনের বেসরকারী বাণিজ্যিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সে-কারণে এটা ছিল সরকারের প্রশাসনিক মনোযোগের বাইরে।

কিন্তু এমডিজি বিষয়টি সামনে আসায় সরকার বুঝতে পারে যে, ব্যাপকভাবে প্রসারমান কিন্ডারগার্টেন নামের এসব বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হিসেবের মধ্যে না আনলে সে বিশ্বসভায় এমডিজি-২ বাস্তবায়নের ঘোষণা করতে পারবে না। এসময়েই সকল কিন্ডারগার্টেনকে নিবন্ধনের মাধ্যমে গণনার ভাবনা আসে, ভাবনা আসে এনজিও-পরিচালিত স্কুলগুলোতেও যারা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাদান করাচ্ছে তাদের অভিন্ন মান যাচাইয়ের। কথা ওঠে সকল শিশুকেই, সে যেখানেই পড়–ক, জাতীয় শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে প্রণীত পাঠ্যপুস্তক দেওয়ার।

এর পেছনে আরেকটা কারণ ছিল। ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ের মধ্যে গ্রামে-গঞ্জে কিন্ডারগার্টেনের ব্যাপক বিস্তৃতিতে এবং সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার প্রতি আস্থাহীনতায় ব্যাপকসংখ্যক অভিভাবক তাদের শিশুকে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করালে এবং পাশাপাশি এনজিও-পরিচালিত স্কুলগুলোতে সরকারী স্কুলের চেয়ে লেখাপড়া ভালো হয় ও কিছু কাজও শেখা যায় এই ধারণায় বিত্তহীন বা নিম্নবিত্তের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের এসব স্কুলে ভর্তি করা অব্যাহত রাখলে কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম-বেশী শিক্ষার্থী-সংকটও শুরু হয়।

কারণ ততদিনে সরকার পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের স্কুলও বেড়েছে। সরকারকে এসময়েই বিভিন্ন ধরনের উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, বৃত্তির সংখ্যা বাড়ানো ইত্যাদি কর্মসূচী গ্রহণ করতে দেখা যায়। ফলে এসময়ে অনেকটা শিক্ষার্থী টানাটানির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের কোথাও কোথাও। দেখা যায় একই শিশু সরকারী স্কুলে নাম লেখায় উপবৃত্তি বা খাদ্য পাওয়ার জন্য এবং অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় নাম লেখায় পড়াশোনা ও কাজ শেখার জন্য। এমনকি এগুলোর পাশাপাশি বস্তি উচ্ছেদ, বস্তিতে আগুন লাগানো, সরকারী মিল-কারখানা অচল হওয়া, ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত থাকায় কোথাও কোথাও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতোও দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

এ সময়েই এনজিওগুলো সমন্বিতভাবে ভারী ভারী গবেষণা-প্রকল্প নিয়ে বহু বহু বিশেষজ্ঞ-গবেষক দ্বারা ফলাফল-প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশে-বিদেশে ছড়াতে থাকে যে, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য নির্ধারিত মোট প্রান্তিক যোগ্যতার মাত্র ২%-ও অর্জন করতে পারছে না [২৯]। 

এসব গবেষণার মাধ্যমে এনজিওগুলো আরো যেটার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করে সেটা হচ্ছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় দাতাদের অর্থ সরবরাহ শুধু অব্যাহত রাখাই একমাত্র প্রয়োজন নয়, উপরন্তু তাদেরকে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষায় অর্থাৎ মূলধারার প্রাথমিক বিদ্যালয়েও কাজ করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর পালা পরিবর্তনে বিভিন্ন এনজিও-র তৎপরতা নানাসময়ে প্রকাশ হয়ে পড়ায় সেটাতে তারা সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হয়।

কিন্ডারগার্টেনগুলোকে এক ধরণের নিবন্ধন প্রদান করে গণনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ২০১০ সালের প্রাথমিক বিদ্যালয় জরিপ রিপোর্টে আমরা এর মোট সংখ্যা দেখি মাত্র ৪ হাজার ৪১৮ এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাই যথাক্রমে ৪১ হাজার ১২৯ ও ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১২৭ [৩০]। 

প্রকৃতপ্রস্তাবে এর চেয়ে অনেক বেশী কিন্ডারগার্টেন ছিল এবং তারা সে-সময়ের মধ্যে নিবন্ধন নেয়নি। কেউ কেউ নিতে আগ্রহীও ছিল না। এরপর প্রাথমিক শিক্ষার বার্ষিক পারফরমেন্স প্রতিবেদন-২০১৪-তে মাত্র ৩ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৩ সাল শেষে, মোট কিন্ডারগার্টেন দেখানো হচ্ছে ১৪১০০ এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেখানো হচ্ছে যথাক্রমে ৮৪৬৩৫ ও ১৭৯৮৫০০ [৩১]। 

অর্থাৎ এই তথ্য অনুযায়ী ৩ বছরে কিন্ডারগার্টেন বাড়ছে প্রায় ২২০%, শিক্ষক বাড়ছে প্রায় ১০৬% এবং শিক্ষার্থী বাড়ছে প্রায় ২৩৬%! লক্ষ্যণীয় এখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১ : ২১.২৫। অর্থাৎ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় অনেকটা শিক্ষানুকূল। এটা বুঝে এসময় থেকে সরকার কিন্ডারগার্টেনসহ সকল ধরণের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হিসাব করছে। আর এতে করে সরকার-পরিচালিত স্কুলগুলোর চরম প্রতিকূল শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটু হলেও অনুক‚লে দেখানো সম্ভব হচ্ছে।

লক্ষ্যণীয় ২০১৩ সালে সরকারী ও সবেমাত্র জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৩ হাজার ২৭৪ এবং ১ কোটি ৪৮ লক্ষ ৯০ হাজার ২২৫ [৩২]। সুতরাং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ৪৯.০৯। কিন্তু এসময়ে সকল ধরণের প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে একত্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত একটু সহনীয় দেখানো হচ্ছে ১ : ৪২ [৩৩]। সরকারের লক্ষ্য রয়েছে এভাবেই অনুপাতকে দু-এক বছরের মধ্যে ১ : ৪০-এ নিয়ে আসা এবং শিক্ষানীতি অনুযায়ী ২০১৮ সালের মধ্যে ১ : ৩০-এ পৌঁছানো [৩৪]। 

দীর্ঘকাল ধরে চলমান এসব নানা ধরণের অসাধু প্রক্রিয়া ঢাকতে মূলত এখন সাফল্য হিসাবে সামনে আনা হচ্ছে পাশের হার বৃদ্ধি এবং বছরের শুরুতেই বিদেশ থেকে ছেপে এনে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই প্রদান আয়োজন-অনুষ্ঠান পাঠ্যপুস্তক উৎসবে ধারণকৃত উজ্জ্বল শিশুর মুখচ্ছবিকে। বই বিদেশ থেকে কেন ছাপাতে হচ্ছে সেটা আমাদের সরকারগুলোর আরেক উন্নয়ন-সাফল্যের (!) ধারাবাহিকতার ইতিহাস।

৬.

শিক্ষার মান উন্নয়নের পক্ষে নানা ধরণের ইতিবাচক নির্দেশকগুলোকেও আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। একটা হচ্ছে শিক্ষার্থী-প্রতি রাজস্ব ব্যয়। শিক্ষার্থী-প্রতি সরকারের রাজস্ব ব্যয় পর্যাপ্ত নয়। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ২৪ হাজার ৬১ কোটি ৩ লক্ষ টাকা [৩৫] এবং এসময়ে প্রাথমিক স্তরের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৬০ লক্ষ ১ হাজার ৬০৫ [৩৬]।

সুতরাং শিক্ষার্থী-প্রতি সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ১৫০৩.৬৮ টাকা। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী-প্রতি সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ২৩.৬২ টাকা এবং ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে এই ব্যয় ছিল মাত্র ১০০.১৮ টাকা [৩৭]। ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব ব্যয় ছিল ২২১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা [৩৮] এবং এসময়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৮৯ লক্ষ ২০ হাজার ২৯২ [৩৯]।

সুতরাং শিক্ষার্থী প্রতি রাজস্ব ব্যয় ছিল ২৪৭.৯৭ টাকা। শিক্ষার্থী-প্রতি রাজস্ব ব্যয়ের এই ধারাবাহিক বৃদ্ধির অঙ্ককে অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে স্পষ্ট হবে যে এই ব্যয় শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য নিতান্ত অপ্রতুল। উল্লেখ্য ২০০৫-০৬ অর্থবছরে ক্যাডেট কলেজের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী-প্রতি সরকারের ব্যয় ছিল ৭৩ হাজার ৬৮৩ টাকা [৪০], যে টাকা শিক্ষাখাতের রাজস্ব বরাদ্দ থেকেই ব্যয় হয়! এই ব্যয়ের সাথে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থী-প্রতি ব্যয় তুলনা করলেও ধারণা করা যায় এতটা অল্প ব্যয়ে কতটা মান অর্জন করা সম্ভব।

আরেকটা নির্দেশক হলো প্রশিক্ষিত শিক্ষক। প্রাথমিক স্তরে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের হার ২০০৫ সালে ছিল ৫৩.৪% [৪১]। ২০১১ সালে গিয়েও এটা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮%, যেখানে ২০১০ সালেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার শতভাগ প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিশ্চিত করেছে [৪২]। 

শ্রীলঙ্কায় এসময়ে এই হার ৮২%, পাকিস্তানে ৮৪%, ভিয়েতনামে ১০০% [৪৩]। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত শিক্ষকের এই হার শিক্ষার মান উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক নয় এমন চিত্রই নির্দেশ করছে। উপরন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক অসততায় যেসব অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে কতটা সক্ষম বা গ্রহণের পর তা প্রয়োগে কতটা আগ্রহী তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।

গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি নির্দেশক হলো প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা সারা বছর ধরে মোট কত ঘণ্টা বিদ্যালয়ে ক্লাস করছে। তার হিসাবেও দেখা যাচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা আশ্চর্যরকমভাবে কম সময় পাচ্ছে। ১৯৯২ সালে চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হিসাবটা ছিল যথাক্রমে ১২৩৫, ১১০০, ৭৫০, ৭৫০, ৩৮৪ ঘণ্টা [৪৪]। বর্তমানে এই হারের উন্নয়ন হয়েছে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

কারণ বহু ধরণের সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় বিষয় ও সংকটের সাথে শিক্ষা-বহির্ভূত বহুবিধ কাজে শিক্ষকদেরকে জড়িত করা, বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষার সংখ্যা বেড়ে যাওয়াসহ অনেক কারণে মোট প্রকৃত শ্রেণী-ঘণ্টা আরো কমে গেছে বলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

এসব বিষয়ের পাশাপাশি ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের উপর পরিচালিত একটি জরিপে প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায় শিক্ষকের পর্যাপ্ততা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শ্রেণীকক্ষের পর্যাপ্ততা, ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষার্থীদের জন্য পানি ও টয়লেট ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায় ৯০% শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন [৪৫]। 

যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য পাঠ-উপকরণ প্রাপ্তির বিষয়ে অর্ধেকেরও বেশী শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন, এবং শিক্ষক-সহায়িকা প্রাপ্তির বিষয়ে নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন ৭০% [৪৬]। শিক্ষা-সহায়ক উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রায় ৬০% শিক্ষক, এবং সকল শিক্ষার্থীর প্রতি সব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ৮৫% শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন [৪৭]। প্রায় ৭৬% শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলছেন [৪৮]। স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন কিনা সে-বিষয়ে প্রায় ৬৭% শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন, এবং প্রায় ৬৫% শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন তারা আদৌ সদস্য হওয়ার যোগ্য কিনা সে-প্রশ্নে [৪৯]। 

প্রায় ৮০% শিক্ষক নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন অভিভাবকেরা তাদের সন্তানের লেখাপড়ার বিষয়ে সচেতন কিনা এ-প্রশ্নে [৫০]। প্রায় ৮৫% শিক্ষক বলেছেন শিক্ষকতার বাইরের অন্যান্য বাধ্যতামূলক কাজের বোঝা তাদের অনেক বড় [৫১]। প্রায় সবাই মনে করেন তাদের বেতন-ভাতা দিয়ে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখা সম্ভব নয় [৫২]। আর প্রায় ৬৩% শিক্ষক শিক্ষকতা পেশাকে প্রথম পছন্দ হিসাবে ভাবতেন না, এবং এখনও প্রায় সমান সংখ্যক শিক্ষক এই পেশায় সন্তুষ্ট নন [৫৩]।

সুতরাং লক্ষ্যণীয় যে, শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং সে-থেকে পাশের হার বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক কোনো নির্দেশক বা তথ্য আমরা পাচ্ছি না।

৭.

এবার দেখা যেতে পারে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজসমূহের চিত্র। যেভাবে প্রাথমিক স্তরের বৃত্তি পরীক্ষায় পাশের হার ২০০২ সালের ৪৪% থেকে ২০০৮ সালে ৭৪% হয়, বলা যায় অনেকটা একই প্রক্রিয়ায় এসএসসি-তে পাশের হার ২০০৩ সালের ৩৫.৯১% থেকে বেড়ে ২০০৮ সালে ৭০.৮১%-এ পৌঁছে যায় [৫৪]। এটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে বেসরকারী কলেজের অপরিকল্পিত অস্বাভাবিক সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে। বিষয়টাকে একটু বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।

মোট শিক্ষার্থীর কত ভাগ কোন ধরণের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে পড়ছে তার ভিত্তিতে সাধারণীকরণ করে আমরা যেটা আগে উল্লেখ করেছিলাম – বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে, আর মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী বেসরকারী হাই স্কুলে পড়ে – সেভাবেই বলা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে কলেজ স্তরের অধিকাংশ শিক্ষার্থী সরকারী কলেজে পড়তো। কিন্তু গত প্রায় বিশ-পঁচিশ বছরে এই চিত্রটা উল্টে গেছে। আমরা দেখি স্বাধীনতার পর বেসরকারী কলেজের সংখ্যা ছিল যেখানে মাত্র ৩৬২, এই সংখ্যা ২০০৮ সালের মধ্যে পৌঁছে গেছে ৩০২৫-এ [৫৫]। 

অর্থাৎ বৃদ্ধি প্রায় ৭৩৫.৬৩%। এই সংখ্যা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশী ঘটেছে ১৯৯০ সালের পর। ১৯৯০ সালেও বেসরকারী কলেজের সংখ্যা যেখানে ছিল ৬৫০টি, সেখানে মাত্র ১৮ বছরে এই সংখ্যা পৌঁছে গেছে ৩ হাজার ২৫টিতে [৫৬]। বৃদ্ধির হার প্রায় ৩৬৫.৩৮%। বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতোই এসব কলেজের প্রতিষ্ঠা, শিক্ষক নিয়োগ, পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন, নির্মাণকাজ ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বাণিজ্য সৃষ্টি হয় যার সুবিধাভোগী মূলত বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ।

লক্ষ্যণীয় সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে কলেজগুলোতে ১৯৭০, ১৯৮০, ১৯৯০, ২০০০ ও ২০০৮ সালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১ : ৩৯.৯৬, ১ : ৩০.৫৮, ১ : ৪৫.০৯, ১ : ২৮.০৯ ও ১ : ২১.১৫ [৫৭]। এক দশক থেকে আরেক দশকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাতের এই চরম উত্থান-পতন কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধির এবং তার সাথে সঙ্গতি রেখে এসএসসি-এইচএসসিতে পাশের হারের হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষার্থী-সংখ্যা হ্রাস-বৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরছে। উল্লেখ্য সরকারী কলেজগুলোতে চরম অস্বাভাবিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত মিলিয়ে গড় অনুপাত ছিল এগুলো।

আরো উল্লেখ্য ২০০৮ সালে সরকারী কলেজের সংখ্যা ছিল ২৫২টি এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১০ হাজার ৩৩৭ এবং ৭ লক্ষ ২২ হাজার ৩৬২ [৫৮]। সুতরাং সরকারী কলেজে এসময়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ৬৯.৮৮। সরকারী কলেজ বাদ দিলে ২০০৮ সালে বেসরকারী কলেজে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছিল যথাক্রমে ৭৩ হাজার ৬১৪ এবং ১১ লক্ষ ৩৩ হাজার ২৭১ [৫৯]। 

সুতরাং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল মাত্র ১ : ১৫.৩৯। আরেকভাবে দেখা যেতে পারে – ২০০৮ সালে মাত্র ২৫২টি সরকারী কলেজে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৪০% পড়তো এবং বাকী প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী পড়তো ৩ হাজার ২৫টি বেসরকারী কলেজে। উল্লেখ্য ১৯৯০ সালে ১৯৮টি সরকারী এবং ৬৫০টি বেসরকারী কলেজে [৬০] কোথায় কত শিক্ষার্থী পড়তো সে-তথ্য এখনো উদ্ধার করা না গেলেও এটা প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় তখন চিত্রটা উল্টো ছিল। হতে পারে তখন মোট কলেজ-শিক্ষার্থীর ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সরকারী কলেজে পড়তো।

ফলে ব্যাপকসংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া বেসরকারী এই কলেজগুলোর বড় একটা অংশ দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থী সংকট নিয়ে চলেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও স্বার্থে নিবন্ধিত কলেজ এবং রাজনীতি ও সম্পর্কসূত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কলেজের শিক্ষকেরা বহু ধাপে বহু টাকার বিনিময়ে চাকরীর নিশ্চয়তা পেলেও অনেকেই প্রায় বসে বসেই অনেকগুলো বছর সরকারী ভাতা পেয়ে এসেছেন। কলেজগুলোতেও উন্নয়নের জন্য নানা ধরণের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে চলার জন্য এবং শিক্ষকদের ন্যূনতম মাসিক আয়ের জন্য ছাত্রবেতন আদায় বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। এসময়েই আমরা এসএসসি-তে পাশের হারের অস্বাভাবিক উল্লম্ফন দেখেছি।

একইভাবে এইচএসসি-তে পাশের হার যেখানে ২০০১ সালে ছিল ২৮.৪১%, ২০০৫ সালে গিয়ে সেটা হচ্ছে ৫৯.১৬%, এবং ২০০৮ সালেই এই হার পৌঁছে যাচ্ছে ৭৪.৮৫%-এ [৬১]। এই হারের বৃদ্ধি ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত বেসরকারী কলেজ ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বাড়ানোর প্রণোদনায়।

৮.

কিছু ঐতিহাসিক তথ্য এ পর্যায়ে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চস্তরের কলেজগুলোর সংখ্যাবৃদ্ধির যে ধারা ও প্রক্রিয়া ১৯৭০ সালের পর থেকে আমরা দেখলাম ঠিক প্রায় এমনই ধারা ও প্রক্রিয়া চলেছিল শতবর্ষ আগে। ১৮৭০ সালের দিকে প্রাথমিক শিক্ষাকে ‘অধিক’ গুরুত্ব দিতে তখন মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা থেকে সরকারের দায় কমিয়ে বেসরকারী উদ্যোগে এগুলো প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু ১৮৭০ সালে শুরু হওয়া সেই প্রক্রিয়ার তিন দশকেরও বেশী পরে এসে ১৯০৪ সালে সরকারের মূল্যায়নে যেমন আমরা পাই “4 villages out of 5 are without schools” [৬২],  একইভাবে শতবর্ষ শেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর সবার জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা (পরবর্তী পর্যায়ে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা) চালুর চার দশক পার করে এসেও ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমরা দেখি “কোন গ্রামে বিদ্যালয় নেই বা কোন গ্রামে আরো বিদ্যালয় প্রয়োজন তা জরিপের মাধ্যমে স্থির করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হবে” [৬৩] এমন ঘোষণার কথা!

তখন “১৮৮১-৮২ সালে কলেজ ছাত্রদের দুই তৃতীয়াংশ ছাত্র পড়তো সরকারী কলেজে কিন্তু ১৯০২ সালে দেখা যাচ্ছে মোট ছাত্রের এক চতুর্থাংশ পড়ছে সরকারী কলেজে, বাকী সবাই প্রাইভেট কলেজে,” [৬৪] আর শতবর্ষ পর ১৯৮১-৮২ সালের সরকারী কলেজের শিক্ষার্থীর সাথে ২০০৮ সালের তুলনা করেও প্রায় একই ধরণের চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি।

তখন হান্টার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা না বাড়ায় ‘হতাশা’ ব্যক্ত করা হয়েছিল। এখন কয়েকটা শিক্ষা কমিশনের সমাপ্ত-অর্ধসমাপ্ত প্রতিবেদন-নীতি পার করেও আমরা হতাশা ব্যক্ত করছি। তখন ছিল উপনিবেশিক শাসন, এখন স্বাধীন দেশের স্বজাতীয় প্রভু। ইতিহাসের অদ্ভুত পুনরাবৃত্তি!

৯.

সবশেষে আমরা দেখবো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি। ১৯৯২ সালে প্রথম বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দশ বছরের মধ্যেই আমরা দেখি ২০০১ সালে এই সংখ্যা হয়েছে ২২, এরপর ৪ বছরের মধ্যেই ২০০৫ সালে এই সংখ্যা হয়ে গেছে ৫৩ [৬৫]। ২০০৮ সালে এটা কমে হচ্ছে ৫১ [৬৬] এবং ২০১৪ সালে ইউজিসির ওয়েবসাইটে গিয়ে ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের লিঙ্ক পাওয়া যাচ্ছে।

এই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০১ সালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ১২.৩৫। ২০০৫ সালে গিয়ে এটা হয়েছে ১ : ২৬.২৮। ২০০৮ সালে গিয়েই এটা হয়ে গেছে ১ : ৪৫.৫২। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কেমন লাভজনক বাণিজ্য হয়ে উঠেছে। আর এখানেই উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার বৃদ্ধির প্রণোদনা লুক্কায়িত আছে যেটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু অন্যদিকে লক্ষ্যণীয় যে ২০০৮ সালে সরকারী ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭ হাজার ৫৯৯ এবং ১ লক্ষ ৬০ হাজার ৪৪৭ [৬৭]। সুতরাং শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ছিল ১ : ২১। এ ধরণের অনুপাতও যে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অনুকূল নয় সে-বিষয়ে ইউজিসি তার ২০১২ সালের প্রতিবেদনে বলছে এভাবে :

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আনুপাতিক হার অনুকূল হলে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে এই হার সন্তোষজনক নয়। ২০১২ সালে জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত ৩২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমোট শিক্ষার্থী ১,৯৭,২৭৮জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ১০,৫৬৮। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:১৯।. . .  [৬৮]

সুতরাং স্পষ্ট যে, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষাথী অনুপাত ১ : ১৯ গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য সন্তোষজনক না হলে ২০০৮ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষাথী অনুপাত ১ : ৪৫.৫২ মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য কতটা প্রতিকূল ছিল। অথচ জনমুখে প্রচারিত যে, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেল করা কষ্টকর!

সুতরাং এটা বোঝা যাচ্ছে যে নানা পর্যায়ের শিক্ষাবাণিজ্য বৃদ্ধির তাগিদে শিক্ষার অপেক্ষাকৃত উচ্চস্তরে অপরিকল্পিতভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এবং তা টিকে থাকার স্বার্থেই শিক্ষার অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তরে পাশের হার বৃদ্ধি করা অপরিহার্য ছিল।

১০

ব্যাখ্যার আরেকটি দিক। সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা, সবার জন্য শিক্ষা – এসব কথা খুব একটা নতুন নয়। সবাইকে শিক্ষিত করার কথা, সর্বজনীন অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার কথা পাকিস্তান সরকারের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই ঘোষণা করা হয়েছিল এভাবে :

Universal free primary education was a major goal of national planning in the First Five Year Plan (1955-’60). The Plan hoped that free and compulsory primary education would be possible in about 20 years. [৬৯]

সেই বিশ বছর পাকিস্তানেরও পার হয়নি। উপরন্তু “. . . ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৯৬৩৩ থেকে ১৯৭০ সালে নেমে আসে ২৯০২৯টিতে. . .” [৭০]। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন পরিকল্পনা, নীতিমালা ও কর্মসূচীতে এ ধরণের কথা সব সরকারই বলেছে, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় স্বল্পসময়ে মানসম্মতভাবে তা করা যায় সেটা কেউ করেনি। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ থেকে আমরা জানি সেখানে কত অল্প সময়ে শিক্ষার হার ও শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বর্তমান সরকার এমডিজি-২ বাস্তবায়নে শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার, সবাইকে শিক্ষিত করার এতটা চাপ গ্রহণ করলো কেন? কারণটা অনেকখানি রাজনৈতিকও। একটা বিষয় সত্য যে, বর্তমান সরকার ২০১৪ সালে এমন একটা নির্বাচনের মাধ্যমে ‘বিজয়ী’ হয়েছে যে-নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ ভোটার ভোট দেয়নি।

সে-দুর্বলতাকে উপেক্ষা এবং নানা ধরণের দুর্নীতিকে আড়াল করতে তারা শিশুমৃত্যুর হার, প্রসূতি মৃত্যুর হার ইত্যাদি কমানোর সূচককে বিশ্বসভায় বড় সাফল্য বলে প্রচার করছে। বাল্যবিবাহের হার কম দেখানোর জন্য মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ বছর করে ফেলেছে। এখন যদি এমডিজি-২ অর্থাৎ ২০১৫ সালের মধ্যে সব শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্য তারা অর্জন করেছে বলতে পারে তবে বিশ্বসভায় তাদের গ্রহণযোগ্যতার একটা ভিত্তি তৈরী হবে বলে তারা মনে করছে।

সে-কারণেই এত অস্থিরতা, সে-কারণেই প্রশ্নফাঁস করে দেওয়া, সে-কারণেই যে-সকল কেন্দ্রে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থী রয়েছে তাদেরকে উত্তর বলে দেওয়া, সে-কারণেই খাতায় যা-ই লিখুক শিক্ষকদের নম্বার দেওয়ার অলিখিত নির্দেশনা দেওয়া, সে-কারণেই মূল্যায়নপত্র তৈরীতে কারচুপি ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সে-কারণেই এ ধরণের অসততার নানা তথ্যপ্রমাণ থাকলেও সেগুলোকে অস্বীকার করা। 

লক্ষ্যণীয়, এসব সত্ত্বেওও সরকারের এই সাফল্য নিয়ে বিশ্ব উন্নয়ন-বাণিজ্যিক-প্রতিষ্ঠানের মোড়ল বিশ্বব্যাংক ইতিমধ্যে (২০১৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর) লিখে ফেলেছে :  

Bangladesh has made remarkable progress in primary education, with 98.6% enrollment rate and 73.8% children completing primary education. [৭১]

সরকারের দিক থেকেও এই মর্মে ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। বিশ্বসভায় অঙ্গীকারকৃত সময়ের আগেই এমডিজি-২ অর্জনের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বলছেন :

সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Millenium Development Goals) এবং সবার জন্য শিক্ষা (EFA) এর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে দেশের সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকলেও বর্তমান সরকার ২০১৪ সালের মধ্যেই এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।. . .  [৭২]

সুতরাং স্পষ্ট যে এই শতভাগ পাশ, এই শতভাগ শিক্ষিত নাগরিকের সাথে শিক্ষার মানের কোনো সম্পর্ক নেই; সঠিকভাবে বললে শিক্ষার-ই কোনো সম্পর্ক নেই। এগুলো শুধুই একটা অঙ্ক, যে অঙ্কের সাথে শাসকশ্রেণী আর তাদের উত্তর-প্রজন্মের শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই; আছে শুধু স্বার্থের সম্পর্ক।

১১.

সমাজ বা রাষ্ট্রে যা ঘটছে অবশ্যই তার একটা আর্থিক দিক থাকবে। কয়েক দশক ধরে আমরা যে-ধরণের সরকার পেয়ে আসছি তার সাথে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং সরকার-পরিচালনাকারী দলগুলোর বাণিজ্যের বড় একটা উৎস হলো শিক্ষাখাত। যত বেশী বেসরকারী স্কুল-কলেজ তত বেশী বাণিজ্য; যত বেশী কাঠামোগত পরিবর্তন (যেমন প্রাথমিক শিক্ষা আট বছর মেয়াদী করা, ইত্যাদি) তত বেশী বাণিজ্য; যত বেশী পরীক্ষা, যত বেশী পাশ, তত বেশী বাণিজ্য।

একটা হিসাব করা যাক। এবার প্রায় ৩৫ লক্ষ শিশু প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা দিয়েছে। এদের অধিকাংশই একাধিক গাইড বই কিনেছে। গড়ে যদি ১টা গাইডও সবাই কিনে থাকে আর তার দাম যদি গড়ে ৫০০ টাকা হয় তবে শুধু এই খাত থেকেই বাণিজ্য সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা। আবার প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী স্কুলে অথবা স্কুলের বাইরে কোচিং করেছে, করতে বাধ্য হয়েছে। মাসে ৫০০ টাকা হলেও ১০ মাসে প্রতিটি শিক্ষার্থী ৫ হাজার টাকা খরচ করেছে। তাহলে কোচিং খাতে বাণিজ্য হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

এগুলো কোনো নিশ্চিত অঙ্ক না হলেও এমন বহু বহু বাণিজ্য খাত তৈরী হচ্ছে শিক্ষার এ ধরণের উন্নয়নের ফলে। কিন্তু মনে রাখা দরকার এই টাকার অংশ শুধু প্রকাশক, কোচিংয়ের মালিক বা স্কুলের শিক্ষকেরা পাচ্ছেন না। এটার বড় অংশ পাচ্ছে স্কুল-কলেজ পরিচালনাকারী কমিটি – মানে নানা ধরণের প্রভাবশালী লোকজন, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের নানা পর্যায়ের ব্যক্তি। সুতরাং শিক্ষার সকল স্তরে এ ধরণের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সৃষ্টির সাথে প্রশ্নফাঁস এবং শতভাগ পাশের সম্পর্ক সরাসরি।

১২.

পরিশেষে বলা প্রয়োজন বিভিন্ন সরকার বিগত কয়েক দশক ধরে মান উন্নয়নের নামে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে ধাপে ধাপে কাঠামোগত, সংগঠনগত ও পদ্ধতিগতভাবে এই যে একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন সেই কাঠামো, সংগঠন ও পদ্ধতি এখন অনেকটা চক্রের মতো কাজ করছে, যা থেকে কোনো একটি স্তরের বিচ্ছিন্নভাবে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সেই পুরো চক্রটিকে ব্যাখ্যা করতে আরো অনেক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রয়োজন।

তবু যেটুকু উপস্থাপন করা গেছে তাতে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সেই কাঠামোগত ও পদ্ধতিগত সংগঠনের চক্র এবং সেই চক্রের ক্রমোন্নয়ন কিছুটা ব্যাখ্যা করা গেছে বলে আমাদের ধারণা। আর এই বিশ্লেষণ থেকে এটাও বোঝা সম্ভব যে চক্রটা একটা দুষ্টচক্র। কোনো দুষ্টচক্রের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপও চূড়ান্তে ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না, বরং তা আরো নেতিবাচক ফল সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমাদের এই চক্রটা ভাঙতে হবে; আর তা করতে হবে আমাদের স্বার্থে, আমাদের নিরানব্বই ভাগ মানুষের স্বার্থে।

তথ্যসূত্র

[১] Primary Education in Bangladesh, Bangladesh Bureau of Educational Information and Statistics (Banbeis), Banbais Publication: 56, January- 1987, p. 20

[২] Report on Primary School Census 2010, Directorate of Primary Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh, p. 24

[৩] Primary Education in Bangladesh, Bangladesh Bureau of Educational Information and Statistics (Banbeis), Banbais Publication: 56, January- 1987, p. 20  

[৪] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.1

[৫] Report on Primary School Census 2010, Directorate of Primary Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh, p. 24

[৬] Bangladesh Primary Education, Annual Sector Performance Report-2014, Directorate of Primary Education, May 2014, p. 5

[৭] http://www.cpeimu.gov.bd/, 2014

[৮] http://www.bd.undp.org/content/bangladesh/en/home/mdgoverview/overview/mdg2/

[৯] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.1

[১০] Ibid, p.1

[১১] প্রায় তিন যুগ আগে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর সে-সময়ের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রায় একই ধরণের বিশ্লেষণ করে গেছেন। দেখুন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, “সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের খাতে প্রাথমিক শিক্ষা”, বংলাদেশের শিক্ষা : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা, ১৯৯০। 

[১২] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.2-3

[১৩] Ibid, p.2-3

[১৪] Ibid, p.2

[১৫] Ibid, p.2

[১৬] Ibid, p.1

[১৭] http://www.banbeis.gov.bd/webnew/index.php?option=com_content&view=article&id=470:results-of-secondary-school-certificate-ssc-public-examination-by-stream-1990-2010&catid=79:output-statistics-2010&Itemid=187

[১৮] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.2

[১৯] Ibid, p.2-3

[২০] http://www.banbeis.gov.bd/webnew/index.php?option=com_content&view=article&id=470:results-of-secondary-school-certificate-ssc-public-examination-by-stream-1990-2010&catid=79:output-statistics-2010&Itemid=187

[২১] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.2-3

[২২] Report on Primary School Census 2010, Directorate of Primary Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh, p. 66

[২৩] Ibid, p.66

[২৪] Ibid, p.66

[২৫] Ibid, p.66

[২৬] Ibid, p.66

[২৭] http://www.unicef.org/bangladesh/Quality_Primary_Education%281%29.pdf

[২৮] জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পুর্ণমুদ্রণ [যপ্রা] জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৮, ৫১

[২৯] See Nath, Samir R and A Mushtaque R Chowdhury (Edited), A Question of Quality: State of Primary Education in Bangladesh: Achievement of Competencies, Vol. 2, Education Watch 2000, Campaign for Popular Education (CAMPE) & The University Press Limited (UPL), Dhaka, 2001

[৩০] Report on Primary School Census 2010, Directorate of Primary Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh, p. 24

[৩১] Bangladesh Primary Education, Annual Sector Performance Report-2014, Directorate of Primary Education, May 2014, p.6

[৩২] Ibid, p.5

[৩৩] Ibid, p.6

[৩৪] জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পুর্ণমুদ্রণ [যপ্রা] জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৬

[৩৫] http://www.banbeis.gov.bd/db_bb/education_finance1.htm, p. 2

[৩৬] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p. 1

[৩৭] http://www.banbeis.gov.bd/publication/Pub.No.56%20Primary%20Education%20in%20Bangladesh.%20January-1987,.pdf), p.49  

[৩৮] Ibid, p. 50

[৩৯] Ibid, p.44

[৪০] http://www.banbeis.gov.bd/db_bb/education_finance3.html, Table 13

[৪১] http://knoema.com/HDR2013/human-development-report-1980-2012?tsId=1012680)

[৪২] http://data.worldbank.org/indicator/SE.PRM.TCAQ.ZS

[৪৩] Ibid

[৪৪] শামসুল হক ও ছিদ্দিকুর রহমান (সম্পাদিত), প্রাথমিক শিক্ষা, ইউনিসেফ, ঢাকা, ডিসেম্বর ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ২৪

[৪৫] Alam, A.K.M. Badrul and Khurshida Akhtar Jahan, “Quality Education in Selected Primary Schools in Bangladesh”, Bangladesh Education Journal, Vol. 6, No. 1, Bangladesh Forum for Educational Development (BAFED) and BRAC University Institute of Educational Development (BU-IED), Dhaka, 2007, p. 46

[৪৬] Ibid, p. 46

[৪৭] Ibid, p. 46

[৪৮] Ibid, p. 47

[৪৯] Ibid, p. 47

[৫০] Ibid, p. 47

[৫১] Ibid, p. 48

[৫২] Ibid, p. 48

[৫৩] Ibid, p. 48

[৫৪] http://www.banbeis.gov.bd/webnew/index.php?option=com_content&view=article&id=470:results-of-secondary-school-certificate-ssc-public-examination-by-stream-1990-2010&catid=79:output-statistics-2010&Itemid=187

[৫৫] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.3-4

[৫৬] Ibid, p.3-4

[৫৭] Ibid, p.3-4

[৫৮] http://www.banbeis.gov.bd/db_bb/college_education_1.html, p. 1-2

[৫৯] Ibid, p. 2

[৬০] http://www.banbeis.gov.bd/trend_analysis1.htm, p.4

[৬১] http://www.banbeis.gov.bd/db_bb/out_sta.htm

[৬২] শহিদুল ইসলাম, “বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা : ঐতিহাসিক পটভূমি”, বংলাদেশের শিক্ষা : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৪৩ (উদ্ধৃত : সুখময় সেনগুপ্ত, বঙ্গদেশে ইংরেজী শিক্ষা : বাঙালীর শিক্ষা চিন্তা, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ১০৭)

[৬৩] জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, পুর্ণমুদ্রণ [যপ্রা] জানুয়ারি ২০১২, পৃষ্ঠা ৯

[৬৪] শহিদুল ইসলাম, “বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা : ঐতিহাসিক পটভূমি”, বংলাদেশের শিক্ষা : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৪৩ (উদ্ধৃত : সুখময় সেনগুপ্ত, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭৭)

[৬৫] http://www.banbeis.gov.bd/db_bb/university_education_1.html, p. 1-2

[৬৬] Ibid, p. 1-2

[৬৭] Ibid, p. 2

[৬৮] ৩৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১২, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, নভেম্বর ২০১৩, ইউজিসি প্রকাশনা নং- ১৬১, http://www.ugc.gov.bd/reports/, p. xxix

[৬৯] http://www.banbeis.gov.bd/publication/Pub.No.56%20Primary%20Education%20in%20Bangladesh.%20January-1987,.pdf), p. 3

[৭০] আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, “সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের খাতে প্রাথমিক শিক্ষা”, বংলাদেশের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, ঢাকা, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৮৯; আরো দেখুন,  http://www.banbeis.gov.bd/publication/Pub.No.56%20Primary%20Education%20in%20Bangladesh.%20January-1987,.pdf), p. 17-18

[৭১] http://www.worldbank.org/en/news/feature/2013/12/10/educating-tomorrows-leaders-in-bangladesh

[৭২] প্রাথমিক শিক্ষায় পাঁচ বছরের অর্জন (২০০৯-২০১৩), মন্ত্রীর বাণী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, ২০১৪

৮ই মে ২০১৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর.সি. মজুমদার মিলনায়তনে শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন আয়োজিত সেমিনারে পঠিত এবং শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন কর্তৃক প্রকাশিত।

লেখক পরিচিতি

রাখাল রাহা 'সম্পাদনা' প্রতিষ্ঠানের এডিটর-ইন-চীফ এবং সাহিত্য, শিক্ষা ও সম্পাদনা নিয়ে কাজ করছেন। তিনি শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলনের একজন সংগঠক। তিনি শিক্ষার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে প্রতিনিয়ত লিখছেন এবং শিক্ষাবিষয়ে তাঁর নানা প্রকাশনা রয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version