ডাচ শিক্ষাব্যবস্থা বিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর সব শিক্ষার্থীকে কে কোন দিকে পড়তে চায় তা নিয়ে ভাবতে বলে। ছয় মাস সময় পায় তারা সেটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার। কার কোন দিকে আগ্রহ, কার কী পড়তে ভালোলাগে এগুলো নিয়ে বিদ্যালয়ে আলোচনা হয়। বিদ্যালয় আর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আলোচনা হয় এবং বিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ বাবা-মায়েদের ডাকেন আলোচনার জন্যে। শুধু ভালোলাগলেই হবে না, সেটি পড়তে পারার মতো যোগ্যতা সে রাখে কিনা তাও বিবেচনায় থাকে। যোগ্যতা শুধু নম্বর আর পরীক্ষার ফলাফলের ওপরই নির্ভর করে না; শিক্ষার্থীর মানসিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সেটিকে সমর্থন করে কি না, তাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়।
হয়তো দেখা গেলো, কোনো শিক্ষার্থী খুব বায়োলজি পড়তে আগ্রহী, আগ্রহ নিয়ে সে পড়াশোনা করছে, ফলাফলও ভালো। ল্যাবে তাকে বলা হলো, কোনো একটি মাছ বা প্রাণীর ব্যবচ্ছেদ করে দেখাতে, কিন্তু রক্ত দেখে সে অজ্ঞান হয়ে গেলো। কিংবা মানবকঙ্কাল দেখে খুব ভয় পেলো। বায়োলজি পড়ার স্বপ্ন দেখার রোমান্টিসিজমের সময় কোনো শিশুরই পারিপার্শ্বিক এসব বিষয় মাথায় থাকে না।
শুধু আলোচনার মাধ্যমে দিকনির্দেশনা দিয়ে বিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ কিংবা রাষ্ট্র দায়িত্ব শেষ করে না। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষা ও পেশাদারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে আয়োজিত হয় “শিক্ষা মেলা”। শিক্ষা মেলায় বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়, তবে আগে থেকে ই-মেইলের মাধ্যমে প্রবেশ কার্ডটি সংগ্রহ করতে হয়। ইমেইলে জানাতে হয়, সে কি শিক্ষার্থী হিসেবে আসছে নাকি শিক্ষার্থীর বাবা-মা হিসেবে আসছে নাকি সপরিবারে আসছে? পুরো মেলাটি যেহেতু অনেক বড় আর সব ব্যাপারে সবার আগ্রহ না-ও থাকতে পারে, তাই শিক্ষামেলায় কম্পিউটার দেয়া আছে, প্রত্যেকে নিজের পছন্দমতো তার নিজের ‘ওয়াকিং রুট’ বানিয়ে, ম্যাপ প্রিন্ট আউট নিয়ে সেদিকে হাঁটতে পারে। কেউ পছন্দের বিষয়ভিত্তিক রুট বানাতে পারে, কেউ পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক রুট বানাতে পারে; কেউবা দেশ, ভাষা ইত্যাদির ওপর পছন্দ করে নিজের নিজের কাস্টমাইজ রুট নিয়ে মেলা হেঁটে ঘুরে দেখতে পারে।
মেলায় কাজ করে প্রধানত শিক্ষার্থীরা। যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যে শিক্ষার্থী যে বিষয়ের ওপর পড়ছে বা হাতেকলমে কাজ করছে, তারা সে বিষয়েই ছোটদের কৌতুহলের উত্তর দেয়। যারা এখনও মনস্থির করে উঠতে পারেনি, কী পড়বে, কোনটা পড়বে তাদের আগ্রহী করার চেষ্টা করে। ইমেল এড্রেস রাখে, বাসার এড্রেস রাখে, মেলায় রাখা ফোল্ডারের বাইরেও অতিরিক্ত আরও তথ্য পাঠায়।
ধরা যাক, কেউ একজন বায়োলজি পড়তে আগ্রহী, সে বায়োলজির কোন শাখায় কাজ করতে চায়? বায়ো-টেকনোলজি, বায়ো-মেডিসিন নাকি বোটানি। একজন মানুষের স্বভাব খুব ঘরকুনো, সে বাইরে বের হতে চায় না, তার জন্যে কৃষি উন্নয়ন পড়ার মানে নেই। মাঠে, ঘাটে, জঙ্গলে বেরিয়ে তাকে পড়তেও হবে, কাজও করতে হবে। ফুল, গাছ, পাখি, লতা, পাতা, প্রজাপতি, ফড়িং, গরু, ঘোড়া এ-সমস্ত নিয়েই তাকে কাজ করতে হবে। যে এগুলো ভালোবাসবে না, সে এ নিয়ে কাজ করার আগ্রহ পাবে না। আবার কেউ যদি খুব বহির্মুখী স্বভাবের হয় কিন্তু বায়োটেকনোলজি পড়তে চায় সেটিও সমস্যা। তাকে অনেক বেশি সময় ল্যাবে থাকতে হবে, একাকী কাজ করতে হবে, নির্জনতাপ্রিয় না হলে এ কাজে সে আগ্রহ পাবে না। এ সমস্তই শিক্ষা মেলায় বিস্তারিতভাবে প্রায় একজন একজন করে সমস্ত শিক্ষার্থীকে বলা হয়। আসলে তৈরি হতে বলা হয় – নিজেকে চেনো-জানো, কী চাও, কেন চাও, আসলেই চাও তো? ভুল করছো না তো? যা সব সিনেমায় বা টিভিতে দেখে ভাবছো, বাস্তব ও তাই তো?
যারা একদমই জানে না, কী পড়তে চায়, কীসে তার আগ্রহ, ভবিষ্যতে কী করবে কিংবা কিসে আছে সুনিশ্চিত, তাদের জন্যে আলাদা করে প্রতি আধ ঘণ্টা অন্তর তথ্যমূলক ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। ভিডিও দেখার পরও যারা দ্বিধায় ভোগে, তারা আবার আলাদা একটি হলে তথ্যপ্রদানমূলক সেমিনারে যোগ দিতে পারে। এরপরও কেউ কারও সাথে কথা বলতে চাইলে, উপদেশ নিতে চাইলে, শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা সেখানে আছেন। তারা বিনামূল্যে তাদের সাথে কথা বলে, আলোচনা করে। এই সার্বজনীন শিক্ষা মেলা ছাড়াও প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলাদা আলাদা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে তথ্য মেলার আয়োজন করে। তবে সাধারণত দেখা যায়, বিষয় নির্বাচন করার পর সেই বিষয়টি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, সেটির ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য মেলায় যোগ দেয়।
এই পুরো কার্যক্রমটিই হয় রাষ্ট্রের স্বার্থে যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যতো শিক্ষার্থী তারা যোগাড় করতে পারবে, ততোই রাষ্ট্রীয় অনুদান পাবে। যুগোপোযোগী অত্যাধুনিক শিক্ষাকার্যক্রম, ভালো ফলাফল ও যথেষ্ট শিক্ষার্থী –শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর রাষ্ট্রীয় অনুদান পাওয়ার অন্যতম শর্ত এখানে। নইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদও বাতিল হয়ে যেতে পারে। এ কার্যক্রমকে নাগরিক স্বার্থেও বিবেচনা করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরা সঠিক জায়গায় নিজেদের মেধা, আগ্রহ, সামর্থ্য দিতে না পারলে সেটি তাদের ব্যক্তিগত ক্ষতির সাথে রাষ্ট্রেরও ক্ষতি। অসুখী, অদক্ষ, অনাগ্রহী নাগরিকদের নিয়ে তো আর কোনো সুখী সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে না!
এতকিছুর পরও বেশিরভাগ সময়ই শেষ রক্ষা হয় না। এখানের শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ নিতে পারে না। পড়াশোনার চাপে উচ্চশিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। জরিপে দেখা যায়, পঞ্চাশ শতাংশ বা ক্ষেত্রবিশেষে আরও কম শিক্ষার্থী তাদের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়াশোনা পুরোপুরি শেষ করে। কুড়ি ভাগের মতো শিক্ষার্থী কর্মজীবনে প্রবেশের পর আবার পড়াশোনায় ফিরে এসে কাজের পাশাপাশি স্নাতক শেষ করে। যে কারণে “গবেষনা ও উন্নয়ন” বিভাগে বিরাট শূন্যতা বিরাজ করে যেটি পূরণ করে বিদেশিরা। এই জায়গাটুকুতে দেখা যায় প্রচুর বিদেশি কাজ করছে। আজকাল প্রচুর বাংলাদেশী মেধাবীরাও নেদারল্যান্ডসের “গবেষনা ও উন্নয়ন” বিভাগে কাজ করছে।
এ পন্থাটি নেদারল্যান্ডসের সেরা পন্থা নয়, তবে এরা সময়ের সাথে চলে। দেখা যাবে, আগামী পাঁচ বছরে পরিবেশ ও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে আরও কার্যকর কিছু উপায় বের করেছে। এখানে সর্বকালের কিংবা চিরস্থায়ী পন্থা বলে কিছু নেই। সময়ের সাথে এরা নিজেদেরকে সমন্বয় ও উন্নত করে।
লেখক পরিচিতি
তানবীরা হোসেন শিক্ষা ও সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করছেন।