বাড়িশিক্ষাক্রম ও পুস্তকনতুন শব্দ : আসুন ১ম শ্রেণিতে আবারো ভর্তি হই

নতুন শব্দ : আসুন ১ম শ্রেণিতে আবারো ভর্তি হই

মোঃ আশরাফুজ্জামান লিখেছেন নতুন শব্দ পড়া নিয়ে

প্রথমত: নতুন শব্দ: অজ চরে-এর অর্থ আমি জানতাম না। আমি জানি না, আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছি তারাই বা কয়জন এর অর্থ জানি! এমনও হতে পারে- শুধু আমিই জানি না। আর আমার মতো আর কেউ না জানলে চলুন আবার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে নতুন শব্দ শিখি। আজ  সন্ধ্যা থেকে আমি কয়েকটি বাংলা শব্দের অর্থ আমার পরিচিত বন্ধু, ছোট ভাই, বড় ভাই এবং আত্নীয়স্বজনকে জিজ্ঞাসা করেছি। একজনও  এর কোনটির সঠিক অর্থ বলতে পারেনি বা শব্দের মানে বুঝাতে পারেনি। (অজ চরে- আমার বাংলা বই (২০১২, ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রথম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকরুপে নির্ধারিত), পৃষ্ঠা: ১১)

আচ্ছা, ভেবে দেখুন তো, আপনার পরিবার বা প্রতিবেশীর ছোট বাচ্চাটি এসে যদি আপনাকে একটি ছাগল দেখিয়ে বলে, অই যে দেখ অজ- আপনি কী করবেন? আমাদের অনেকের মুখেই শুনতাম অজগরটি আসছে তেড়ে- এরকম প্রথম অক্ষরটি দিয়ে বাচ্চাদের মনে আমরা কেন ভয় ঢুকিয়ে দেই? সুতরাং বুঝতে পারলাম কেন এই পরিবর্তন। তাই বলে এরকম একটি অপরিচিত শব্দ দিয়ে শুরু করবে নতুন প্রজন্ম? যে শব্দটি বাস্তব জীবনে তারা আর কোনোদিন কাজে লাগাবে না (আমি সন্দেহ প্রকাশ করছি এবং বলছি তারা অজ না বলে ছাগলই বলবে)।

একটি ছড়ার ১ম লাইন হলো- ইতল বিতল পাতা নড়ে। আমি জানি না এখানে ‘ইতল বিতল’ শব্দের মানে কী? আপনি জানেন কি? (ইতল বিতল – আমার বাংলা বই, প্রথম শ্রেণি, পৃষ্ঠা: ১৮)। মৌমাছিকে বলা হচ্ছে অলি। কেন? আমাদের বহুল প্রচলিত শব্দকে ব্যবহার না করে নতুন প্রজন্মকে তাদের শিক্ষাজীবনের শুরুতে কেন এরকম শব্দ শেখানো হচ্ছে? সমার্থক শব্দ যদি শিখতে হয়, তাহলে আগে প্রচলিত শব্দ শিখবে পরবর্তীতে তার সমার্থক হিসেবে এরকম শব্দ শিখতে পারে। তারা পাঠ্যপুস্তকে ছবিতে দেখে শিখবে এটি অজ আর বাস্তব জীবনে দেখবে তার চারপাশে সবাই একই প্রাণীকে বলছে ছাগল। আর যদি পাঠ্যপুস্তকে এই শব্দগুলো শেখানো হয়, তাহলে আমাকে আবার নতুন করে স্কুল জীবন শুরু করতে হবে, নতুন প্রজন্মের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য।

শুধু তাই না, বইটিতে চাঁদের ছবি একে ৩৩ পৃষ্ঠায় চাঁদকে বলা হয়েছে শশী (সমার্থক শব্দ) পরবর্তীতে ৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে চাঁদ। প্রথম শ্রেণিতে প্রথমে প্রচলিত শব্দ চাঁদ ব্যবহার করে পরবর্তীতে সমার্থক শব্দ ব্যবহার করাটাই কি শ্রেয় নয়? কেননা, স্কুলে ভর্তির আগেই আমরা চাঁদমামাকে চিনে ফেলি। মা, বাবা, ভাই, বোন, প্রতিবেশীদের কাছে আমরা ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা, চাদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা’ শুনি আর আকাশের বুকে চাঁদটাকে চিনে ফেলি। (শশী, আমার বাংলা বই, প্রথম শ্রেণি, পৃষ্ঠা: ৩৩)। পৃষ্ঠা ১১-তে আগুনের ছবির নিচে লেখা অনল (সমার্থক শব্দ)। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অনল শব্দটিও আমরা ব্যবহার করি না। তবুও কেন শিক্ষাজীবনের শুরুতেই এই শব্দগুলো শিশুকে শেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছ?

দ্বিতীয়ত : ছড়া ও চিত্রাঙ্কন: ছড়া- ‘আতা গাছে তোতা পাখি, ডালিম গাছে মউ। এত ডাকি তবু কথা কয় না কেন বউ’- এই ছড়াটির সাথে যে চিত্রাঙ্কন ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে একটি হাফপ্যান্ট পরা ছোট ছেলে, সামনে ঘোমটা দেয়া বউ। আমি বুঝতে পারছি না এ দ্বারা কী বুঝানো হয়েছে? বউটি কি এই হাফপ্যান্ট পরিহিত কিশোরের নাকি অন্য কারো? প্রথম শ্রেণিতে প্রথম ছড়া হিসেবে এর যৌক্তিকতা কতটুকু? (আমার বাংলা বই, প্রথম শ্রেণি, পৃষ্ঠা: ৫)

আবার সেই বউ, ছড়া- ‘বাক বাকুম পায়রা মাথায় দিয়ে টায়রা বউ সাজবে কাল কি চড়বে সোনার পালকি’-এর চিত্রাঙ্কনে পায়রা এবং তার পাশে একটি মেয়ের ছবি দেয়া। প্রথম শ্রেণি থেকেই কি আমরা আমাদের মেয়েদের বউ সাজতে উৎসাহ প্রদান করছি? (আমার বাংলা বই, প্রথম শ্রেণি, পৃষ্ঠা: ৩০)

এরকম আর অনেক শব্দ এবং ছবি দেখে আমি বিরক্তই হচ্ছি। যেমন চিৎপাত-আমরা যাকে বলি চিৎপটাং, পৃষ্ঠা ৩৭, ঐরাবত- হাতির ছবি, পৃষ্ঠা ১৫, গজ- হাতির ছবি, পৃষ্ঠা ২১। এছাড়া ৬৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে নিজের ঘর সাফ করে। পরিষ্কার বাদ দিয়ে সাফ করে কেন ব্যবহার করা হল, বুঝতে পারলাম না। এর আগে অনেক যুক্তবর্ণের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি এই পাঠের শেষেই বলা আছে এসো যুক্তবর্ণ শিখি। প্রথম শ্রেণিতে শিশুরা শিখবে আনন্দের মধ্য দিয়ে, সেখানে প্রথম শ্রেণিতে- প্রথমত ৫৬টি পাঠ, দ্বিতীয়ত প্রচলিত শব্দ না ব্যবহার করে সমার্থক শব্দের ব্যবহার, তৃতীয়ত যথাযথ ছড়া ও চিত্রাঙ্কনের ঘাটতি, এসবের কারণে পাঠের প্রতি শিশুরা আগ্রহ হারাবে এবং তাদের মনে ভীতির সৃষ্টি ঘটবে। তাই শিশুদের পাঠ্যপুস্তক তৈরির সময় এ ব্যাপারে আর সচেতন হওয়া প্রয়োজন এবং  শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর)-এর মাধ্যমে গবেষণা করে পাঠ্যবই রচনা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

মোঃ আশরাফুজ্জামান: রিসার্চ ফেলো, ইআইএ-ডিইউ- ওইউ(ইউকে) রিসার্চ কোলাবরেশন প্রোগ্রাম, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন

মতামত

বিজ্ঞান চেতনা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোন বিজ্ঞান শিখছে শিশুরা?

নাহিদ নলেজ বিজ্ঞান চেতনা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা কী- এ সম্পর্কে বিস্তর কথাবার্তা আমাদের সবার জানা। সেই প্রাথমিক শিক্ষাটুকুই যদি গলদপূর্ণ হয়, তাহলে আর কী কথা...

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?

মোঃ তৌফিক ইমাম চৌধুরী লিখেছেন বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থা আছে তা নিয়ে কি আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট? প্রাথমিক কিংবা নিম্নমাধ্যমিক শ্রেণীতে একজনকে অনেকগুলো বিষয়ে পড়তে...
নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।

এই বিভাগের আরও লেখা

শিক্ষাক্রম: প্রাথমিক স্তরের অর্জন উপযোগী যোগ্যতা বনাম বাস্তবে অর্জিত যোগ্যতা

প্রাথমিক শিক্ষার সাথে যুক্ত থাকার কারণে শ্রেণিকক্ষে থাকা শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার সুযোগ হয়। সেই...

বই পর্যালোচনা: তোত্তোচান জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি

তানজিনা আক্তার রুপা পর্যালোচনা করেছেন তোত্তোচান বইটির বাংলা অনুবাদ জাপানের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব...

বই পর্যালোচনা: ব্যাকরণ ও বিবিধ

মূল লেখাটি লিখেছেন: আবদুল্লাহ আল নোমান; প্রকাশ করেছেন: সম্পাদক, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাকরণ ও বিবিধ বইয়ের...

বিদ্যালয় হোক আনন্দের এক রঙিন ফুল

হাবীব ইমন লিখেছেন বিদ্যালয় ও আনন্দময় শিক্ষা নিয়ে শিক্ষা-সংশ্লিষ্টতায় অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। যখন একটি...

শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন: সংশ্লিষ্টদের বিড়ম্বনা

ডিজিটালাইজেশন তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্যের আদান-প্রদানকে সহজলভ্য করে মানুষের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় করা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন পর্যায়ে দেশে বিরাজমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সুবিধা ও সুবিধাভোগীদের প্রযুক্তিজ্ঞানের কথা যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি গৃহীত পদক্ষেপ বা পদ্ধতি কতটা সুবিধা দিতে পারছে তাও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। আর তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার রাজ্যে।

পাঠ্যপুস্তক উৎসব এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর এক উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন বই হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবনা

আদর্শ শ্রেণিকক্ষে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক যদি সময়ের চাহিদা পূরণে সক্ষম এমন বিষয়বস্তু সম্বলিত পাঠ্যপুস্তক অনুসরণ করে আধুনিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীকে শিক্ষালাভে সহায়তা করেন এবং যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেন তবেই সম্ভব হবে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিখনফল অর্জন। সার্থক হবে শিক্ষাব্যবস্থা, অর্জন করা সম্ভব হবে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য

ইংরেজি প্রশ্ন নিয়ে বিভ্রান্তি এবং এনসিটিবির ভূমিকা

যদি এমন করা হতো যে, এনসিটিবি কর্তৃক বই গাইডলাইন আকারে থাকবে এবং প্রশ্ন বাজারের কোনো ধরনের বই থেকে কোনোভাবেই নেয়া যাবে না, তবে প্রাকটিসের জন্য শিক্ষার্থীরা যে কোনো বই অুনশীলন করতে পারে তাহলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হতো এবং ইংরেজি পরীক্ষা সঠিক গ্রহণযোগ্যতা পেত।