বাড়ি উচ্চশিক্ষা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা; ছবিসূত্র: REV
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা; ছবিসূত্র: REV

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হচ্ছে না, গবেষণার পরিবেশ নেই, গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত ফান্ড নেই— এসব অভিযোগ অনেক পুরোনো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার মান ও স্বল্পতা বা গবেষকের অপ্রতুলতা নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে অধিকাংশ শিক্ষক উপরের অভিযোগগুলো নির্দ্ধিধায় তুলে ধরবেন।

মনে হতে পারে, এগুলোই একমাত্র কারণ এবং এই সমস্যাগুলো দূর করলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদি উপরের সমস্যাগুলোকে সারসংক্ষেপ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করার এবং গবেষণা পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য ফান্ড দেয়া হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই হবে?

একটি ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুমানিক দুই হাজার শিক্ষক বর্তমানে কর্মরত আছেন এবং অন্য শিক্ষকরা বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাছুটিতে রয়েছেন। যে সকল শিক্ষক কর্মরত আছেন এবং শিক্ষাছুটিতে আছেন, তাঁদেরকে প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা করে গবেষণা ভাতা দেয়া হয়।

এর অর্থ হলো, একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে ৬০,০০০ টাকা পাচ্ছেন গবেষণা করার জন্য। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি মাসে গবেষণা খাতে খরচ হচ্ছে প্রায় এক কোটি টাকা এবং প্রতি বছর খরচ হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি টাকা। এটি পরিষ্কার যে, এই টাকার যদি সঠিক ব্যবহার করা হতো, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় অনেক এগিয়ে যেত।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক গবেষণা করছেন না, তারাও গবেষণা ভাতা নিচ্ছেন। এই যে শিক্ষকরা গবেষণা করছেন না, তাদের সংখ্যাটিও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। খেয়াল রাখতে হবে, একেক বিভাগের গবেষণার খরচ একেক রকম। তাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি গবেষণাভাতা শুধু যেসব শিক্ষক গবেষণা করছেন, তাদের মধ্যে বণ্টন করা হতো, তাহলে গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরো এগিয়ে যেতে পারতো।


দেখা যাচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক গবেষণা করছেন না, তারাও গবেষণা ভাতা নিচ্ছেন। এই যে শিক্ষকরা গবেষণা করছেন না, তাদের সংখ্যাটিও কিন্তু কোনো অংশে কম নয়। খেয়াল রাখতে হবে, একেক বিভাগের গবেষণার খরচ একেক রকম। তাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যদি গবেষণাভাতা শুধু যেসব শিক্ষক গবেষণা করছেন, তাদের মধ্যে বণ্টন করা হতো, তাহলে গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আরো এগিয়ে যেতে পারতো।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই পদক্ষেপ সফল করার জন্য আমাদের কী করতে হবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর বিভাগের শিক্ষকদের কাছ থেকে তাদের সম্পাদিত গবেষণার তালিকা এবং নিবন্ধগুলোর একটি কপি জমা দেবার অনুরোধ জানাতে পারে। যে সকল শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের গবেষণার ফলাফল দেখাতে পারবে, শুধু তাদেরকেই যেন পরবর্তী বছরে গবেষণা ভাতা দেয়া হয়।

যেহেতু সকল শিক্ষককে গবেষণা ভাতা দেয়া হচ্ছে গবেষণা করার জন্য, তাহলে যে সকল শিক্ষক গবেষণা করছেন না বা করতে চাচ্ছেন না, তাদেরকে জোর করে গবেষণা ভাতা দেয়া কি ঠিক হচ্ছে? যদি কোনো ভাতা বা সুবিধা দিতেই হয়, তাহলে সেটি অন্য কোনো খাতে দেয়া যেতে পারে। এতে আমাদের গবেষণা খাতে যে ভাতা দেয়া হচ্ছে, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ যেন কেউ করতে না পারে তার একটা সমাধান আমরা পেতে পারি।   

প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কত ভাগ শিক্ষক করছেন? দেখা যাবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অন্তত ৪০% গবেষণার সাথে যুক্ত নয়। এই শতকরা হিসাব কিছুটা কম বা বেশিও হতে পারে। তাহলে তারা কী করছেন? এসব শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, ইনকোর্স পরীক্ষা, মিড টার্ম পরীক্ষা, মৌখিক এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা, পরীক্ষা-সংক্রান্ত অন্যান্য কাজ যেমন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, প্রশ্নপত্র সমন্বয়, খাতা নিরীক্ষণ, পরীক্ষার ফলাফল তৈরি এবং প্রকাশ ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন।

একই সাথে, কিছু শিক্ষক নিজ বিশ্ববিদ্যালয়েই বা বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বা একাধিক বিভাগে খণ্ডকালীন চাকরি করেন। তার অর্থ দাঁড়ালো, সেখানেও তাকে উপরের কাজগুলোর অধিকাংশই করতে হয়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজকে অধিভুক্ত করা হয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন চাকরির পাশাপাশি সাত কলেজের পরীক্ষা-সংক্রান্ত কাজগুলো করতে হচ্ছে।

এছাড়াও, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষককে সকালের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রাতেও শিক্ষকতা করতে হয়, যেটিকে বলা হয় সান্ধ্যকালীন কোর্স। সেখানেও তাকে ক্লাস, পরীক্ষা এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালন করতে হয়। একই সাথে, কিছু শিক্ষককে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে দায়িত্ব পালন করতে হয়। এসকল দায়িত্ব পালন করে একজন শিক্ষক গবেষণা করার সময় কোথায় পাচ্ছেন?

তাই, এখন সময় হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকদের জন্য পোস্ট তৈরি করা যেখানে শিক্ষকদের প্রধান কাজ হবে শুধু গবেষণা করা। পাশাপাশি তাদের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি এবং পোস্ট ডক গবেষকরা কাজ করবেন। এতে অনেক শিক্ষক গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।           


বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফান্ডের অভাবে শিক্ষকরা পর্যাপ্ত গবেষণা করেন না কথাটি আংশিক সত্য। বরং অজুহাত এটি হতে পারে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফান্ডের অভাবে ভালো গবেষণা করা যাচ্ছে না। গবেষণা না করতে চাওয়ার আরেকটি কারণ হলো গবেষণা যিনি করছেন বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণার মূল্যায়ন করছে না।


আমার দৃষ্টিতে, বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফান্ডের অভাবে শিক্ষকরা পর্যাপ্ত গবেষণা করেন না কথাটি আংশিক সত্য। বরং অজুহাত এটি হতে পারে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফান্ডের অভাবে ভালো গবেষণা করা যাচ্ছে না। গবেষণা না করতে চাওয়ার আরেকটি কারণ হলো গবেষণা যিনি করছেন বিশ্ববিদ্যালয় তার গবেষণার মূল্যায়ন করছে না। যে শিক্ষক গবেষণার পেছনে সময় দেবার জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা হারাচ্ছেন, অন্য অনেকে গবেষণায় সময় না দিয়ে অন্য কোথাও সময় দিয়ে সহজেই বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। তাহলে একজন শিক্ষক কেন গবেষণা করবেন?

আরেকটি প্রশ্ন হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কি বিশেষ কিছু হিসাবে বিবেচিত হয়? বাস্তবতা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একজন শিক্ষকের গবেষণাকে বিচার করা হয় সংখ্যা দিয়ে। একটি ভালো গবেষণার কাজ শুরু করে প্রকাশ করা পর্যন্ত সময় লেগে যায় ১.৫ থেকে ২ বছর। সেখানে কিছু শিক্ষক তিন মাসেই গবেষণার কাজ করে সেটিকে ২-৩ মাসেই টাকা দিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশ করে ফেলতে পারছেন। এই যে কাজের গুণগত মানের ভিন্নতা, এটি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের বুঝার বা দেখার সক্ষমতা রাখে না? এই যে প্রশাসনের এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, এটিই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে অনুৎসাহিত করে।

এ-সমস্যা থেকে উত্তরণে আমার কিছু প্রস্তাব আছে। প্রথমটি হলো, প্রমোশন নীতিমালা কঠিন থেকে কঠিনতর করা। এই প্রমোশন নীতিমালা কেমন হওয়া উচিত সেটি এখানে তুলে ধরছি।

প্রভাষক

প্রভাষক পদের জন্য আবেদনকারীকে অবশ্যই অনার্স এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণি থাকতে হবে অথবা সিজিপিএ ৩.৫ বা তার বেশি থাকতে হবে।

প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক

প্রার্থীর অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রি থাকতে হবে। প্রভাষক হিসাবে অন্তত তিন বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে প্রভাষক হিসাবে চারটি প্রকাশনা থাকতে হবে।

সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক

সহকারী অধ্যাপক হিসাবে অন্তত চার বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে পাঁচটি প্রকাশনা থাকতে হবে।

সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক

সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে ছয়টি প্রকাশনা থাকতে হবে।

অধ্যাপক থেকে গ্রেড ২ অধ্যাপক

অধ্যাপক হিসাবে অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে অধ্যাপক হিসাবে ছয়টি প্রকাশনা থাকতে হবে।

গ্রেড ২ অধ্যাপক থেকে গ্রেড ১ অধ্যাপক

গ্রেড ২ অধ্যাপক হিসাবে অন্তত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা এবং ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে গ্রেড ২ অধ্যাপক হিসাবে ছয়টি প্রকাশনা থাকতে হবে।

উপরের কোনো ধাপে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে প্রার্থীকে যেন প্রমোশন না দেয়া হয় সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে।

বিভিন্ন অনুষদে গবেষক প্যানেল অনুমোদন

প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষদভিত্তিক শিক্ষকদের গবেষণার গুণগত মানের ওপর ভিত্তি করে সেরা ১০ জন শিক্ষকের একটি প্যানেল করতে হবে যার মেয়াদ হবে এক বছর। এই এক বছরে সেই প্যানেল তার অনুষদ থেকে যতো শিক্ষকের যতো প্রকাশনা প্রকাশিত হবে সেগুলো মূল্যায়ন করবেন এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের জানিয়ে দেবেন কোন কোন প্রকাশনাগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।


পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকদের মানউন্নয়নে শুধু পদক্ষেপ নিলেই হবে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাখাতে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ভালো গবেষণামূলক কাজকে উৎসায়িত করতে হবে।


একই সাথে সেই প্যানেল গ্রহণযোগ্যতার একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করবেন এবং সবাই সেটি মেনে নিতে বাধ্য থাকবে। এই নীতিমালা অবশ্যই সকল শিক্ষকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে যাতে তারা সেই নীতিমালার ভিত্তিতে গবেষণার কাজ করতে পারেন। এই নীতিমালা যেনো পরবর্তী প্যানেল কোনোভাবেই শিথিল করতে না পারে সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন প্রমোশন নীতিমালায় শুধু যদি গবেষণার সংখ্যার দিকে নজর না দিয়ে গুণগত মানের দিকেও নজর দিতে পারে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার প্রতি গুরুত্ব দেবার প্রবণতা বাড়বে।

সবশেষে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকদের মানউন্নয়নে শুধু পদক্ষেপ নিলেই হবে না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাখাতে সরকারি এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ভালো গবেষণামূলক কাজকে উৎসায়িত করতে হবে।

একই সাথে, বিশ্ববিদালয়ের নিজস্ব যে জার্নালগুলো আছে, যেখানে শিক্ষকরা তাদের গবেষণার কাজ প্রকাশ করেন, সেগুলোরও মানউন্নয়ন দরকার, যাতে সেখানে মানসম্মত গবেষণাই শুধু প্রকাশ করা হবে। পরিবর্তন দরকার, দরকার গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় যেন না হয় প্রাচ্যের পাঠশালা— এ স্বপ্ন নিয়েই শুরু হোক আমাদের আগামীর পথচলা।     

ড. গৌতম সাহা: সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 

লেখক পরিচিতি

ড. গৌতম সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version