বাড়ি দক্ষতা ও উন্নয়ন

বাংলাদেশে শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ

শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সহজভাবে কিছু লেখার কাজটা বেশ কঠিন। এ-কাজের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এই যে, আলোচনা একপর্যায়ে আর নির্মোহ বা বস্তুনিষ্ঠ থাকতে চায় না। নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু ধরে আলোচনা শুরু করলেও একপর্যায়ে সেটিকে কেন্দ্রীভূত রাখা শক্ত। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ, বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত।

সেসবের বেশিরভাগই অবহেলা, হঠকারিতা ও অপরিকল্পনার ফল। এজন্য পরিকল্পনা করে কেবল লালরঙের দড়িটা ধরে টান দিতে চাইলেও হুড়হুড় করে নানারঙের আরো অজস্র দড়ি বেরিয়ে এসে সবকিছু ভজঘট পাকিয়ে ফেলে।

হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক মার্ক ব্রে রচিত একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম কিছুদিন আগে। গবেষণা বা তথ্যউপাত্ত দিয়ে এই লেখাকে ভারি করে ফেলতে চাইছি না, তবে সংক্ষেপে বলি, প্রবন্ধটিতে কৌতূহলোদ্দীপক একটি শব্দ চোখে পড়েছে। এতে তিনি জ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র আন্তঃবিষয়ক (Interdisciplinery) শাখা হিসেবে ‘শিক্ষা’-কে আরও ভালোভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এডুকোলজি (Educology) বলে একটি শব্দ প্রচলনের বিষয়ে কিছু কথা বলেছেন।

জ্ঞানের অনেক শাখার নামেই গ্রিক প্রত্যয় ‘Logy’ যোগ করার সংস্কৃতি আছে। ফলে এটি খুব অদ্ভুত কোনো প্রস্তাব নয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণেই শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি তেমন জনপ্রিয় হয়নি, অর্থাৎ Educology শব্দটি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয়নি। অবশ্য এই শব্দটিও তাঁর নিজের সৃষ্টি নয়, বরং আরো অনেক আগে থেকেই এটি নিয়ে কথা হয়ে আসছে। বাংলায় এডুকোলজির পরিভাষা হতে পারে ‘শিক্ষাবিদ্যা’, অর্থাৎ স্থাপত্যবিদ্যা বা শল্যবিদ্যার মতো। শিক্ষাবিদ্যাকে বলা যেতে পারে এমন এক বিদ্যা—যেটিতে শিখনপ্রক্রিয়া, শিখনের তাত্ত্বিক ভিত্তি, জীবন ও সমাজের সঙ্গে শিক্ষার সম্পৃক্ততা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকে।

কথা হচ্ছে, এরকম একটি নতুন পরিভাষার প্রচলন কি একান্তই জরুরি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাকে মার্কের প্রবন্ধেরই আরেকটি চমৎকার উদাহরণ তুলে ধরতে হবে। সেখানে বলা হয়েছে,  সমাজ (Society) এবং সমাজবিজ্ঞান (Sociology) যেমন এক জিনিস নয়; শিক্ষা (Education) ও শিক্ষাবিষয়ক জ্ঞানকেও (Knowledge of Education) গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই।

মূলত এখানেই সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। সাধারণভাবে ‘শিক্ষা’ কথাটাই একটা ব্যাপক অর্থকে বোঝায়, যেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যেমন ধরা যাক, নিজে শিক্ষাগ্রহণ করা এবং শিক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে পড়াশোনা করা একেবারেই এক জিনিস নয়। সহজভাবে বলা যায়, পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি ও জ্ঞান থাকলেই যে-কেউ পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হয়ে যান না, তাঁকে পদ্ধতিগতভাবে শিক্ষক হয়ে উঠতে হয়।

আধুনিক পৃথিবীতে কাউকে ধরে ধরে সবকিছু শেখানোর কিছু নেই, উপযুক্ত নির্দেশনা ও পরিবেশ পেলে মানুষ নিজেই শিখতে পারে। শিক্ষার্থীকে কেবল এই ধারণাটাই দিতে হয় যে, শতসহস্র বিচিত্র উপায়ে ভাবা ও শেখা সম্ভব। প্রযুক্তির এই যুগে এসে অডিও-ভিজ্যুয়াল উপকরণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই জায়গাটাও অনেকটাই নিয়ে ফেলছে, ফলে শিক্ষকতার ধারণাকে প্রাচীনপন্থী করে রাখার সুযোগ নেই মোটেও।

এই মুহূর্তে যেসব দেশে শিক্ষক হবার প্রক্রিয়া অত্যন্ত সুনির্ধারিত এবং সংশ্লিষ্ট যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়, সেখানে আলাদাভাবে এই পরিভাষার প্রয়োজন নেই। শিক্ষক হতে হলে এডুকেশন নিয়ে পড়তে হবে, এটি সেসব দেশে একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার। অন্য বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে পরে শিক্ষক হবার জন্য শিক্ষায় ডিগ্রি নিয়ে শিক্ষক হয়েছেন, এরকম উদাহরণ অজস্র। কারণ, শিক্ষায় ডিগ্রি ছাড়া হয়তো শিক্ষকতার অনুমতিই মিলবে না।

এই ডিগ্রিগুলো সাধারণত পূর্ণকালীন, প্রচুর কোর্সওয়ার্ক থাকে, শক্ত পড়াশোনা থাকে, গবেষণার কাজ থাকে, প্রজেক্ট থাকে। অর্থাৎ পিছলে বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। যেহেতু এসব দেশে সবাই শিক্ষাকে একটা স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবেই জানে, তাদের এডুকোলজি শব্দের দরকার পড়ার কথা নয়।

এই প্রবন্ধের লক্ষ্য এডুকোলজি শব্দটির প্রচলন করা নয়, বরং বাংলাদেশে শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই শব্দের প্রেক্ষাপট তুলনা করা। এ-কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশে শিক্ষায় জ্ঞান ছাড়াই রাতারাতি শিক্ষক হওয়া যায়। শিক্ষা নিয়ে পড়ালেখা না থাকলে শিক্ষকতাও করা যায়— বিশ্বের অনেক দেশেই যেটি রীতিমতো অলৌকিক একটি ব্যাপার। অর্থাৎ এডুকোলজির মতো একটি নতুন পরিভাষা ছাড়া এটার গুরুত্ব ঠিক চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোই যাচ্ছে না যেনো।

টিচিং ডিগ্রি একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদ্যা। শিক্ষকতার সংজ্ঞাই এখন বদলে গেছে। নিজে ভালো ফলাফল করা, দুর্দান্ত বোঝাতে পারা কিংবা ক্লাসকে বিনোদিত করা, এগুলো একজন ভালো শিক্ষকের অনুষঙ্গ বা গুণাবলি হতে পারে, কিন্তু কেবল এগুলোই ভালো শিক্ষক হতে পারার যোগ্যতা বা মাপকাঠি নয়। পড়ানোর অনুমতি পেতে হলে একজন মানুষকে সার্বিকভাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে আসতে হয়।

বাংলাদেশে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা, বিশেষত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে কথা উঠলে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ হয়ে যাবে। সংক্ষেপে বলি, এই ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষাপদ্ধতি কোনো অবস্থাতেই ভালো শিক্ষক বাছাইয়ের নিশ্চয়তা দেয় না।

এর প্রথম কারণ হচ্ছে, এইসব পরীক্ষার ধরন একেবারেই আটপৌরে। সব ধরনের পেশায় যেতে একই রকমের পরীক্ষা নেয়া হলে সেটি নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠতে পারে না। দ্বিতীয়ত, নিজের বিষয়ের পড়াশোনা এবং সরকারি চাকরির পড়াশোনা— এই দুই জিনিস এখনকার বাংলাদেশে দুই মেরুর জিনিস হয়ে উঠেছে।

যারা সরকারি চাকরি নিতে চান, তারা সাধারণত বিভাগের পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা উৎসাহী হন না। মাস্টার্সের গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসে মন না দিয়ে সেই সময়টায় নিমগ্ন হয়ে চাকরির বই পড়া একাধিক শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতায় ঢুকতে আমি নিজেই দেখেছি। এজন্য অবশ্য আমি তাদের দোষারোপ করি না। এটি সিস্টেমের সমস্যা।

আমি বলতে চাইছি, বাংলাদেশের নিয়োগ পরীক্ষা ঘুণাক্ষরেও শিক্ষকতার যোগ্যতাজ্ঞাপক কিছু নয়, এটা নিছকই বাছাইয়ের প্রক্রিয়া। শিক্ষায় পরিপূর্ণ প্রোগ্রাম সম্পন্ন করা এবং উত্তীর্ণ হওয়া ব্যক্তিরাই শিক্ষক হওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য, এটা স্বাভাবিক জ্ঞান, কোনো রকেট সায়েন্স নয়। তবে বাংলাদেশে শিক্ষায় স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর শেষ করলেই কেউ শিক্ষায় মস্ত পণ্ডিত হয়ে যাবেন, এরকমটা ধরে নেয়াও আবার অন্যায় হয়ে যাবে।

আগেই বলেছিলাম, দড়ি ধরে টান দিতে শুরু করলে কোন রঙেরটা এসে পড়বে, সেটি আগে থেকে বলা যায় না। বাংলাদেশে যে বিচিত্র উপায়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দেয়া হয়, সেটি সম্ভবত পৃথিবীতেই একটি অনন্য উদাহরণ। এমন অনেক বিভাগ আছে—যেখানে নিজের বিষয়ের মূল বিষয়গুলো না জেনেও পাশ করে বেরিয়ে যাওয়া যায়। পুরো শিক্ষাজীবনে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ বা পাঠ্যবই পড়তে হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যোগ্যতা, নিয়োগ, পাঠপদ্ধতি, মূল্যায়ন ইত্যাদি নিয়েও অনেক নেতিবাচক কথা বলার সুযোগ আছে—এমনকি দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এমন কিছু শিক্ষক আমি পেয়েছি, যাঁদের নিজের পড়ানোর বিষয় সম্পর্কে নিজেরই ভালো ধারণা নেই, নিজে কিছু যে শিখবেন সেই ইচ্ছাও নেই। রাজনীতি করেই সময় পান না অনেকে। ফলে চক্রটা লক্ষ করুন:

শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ
শিক্ষকতা ও শিক্ষক-প্রশিক্ষণ

এরকম ত্রিমুখী সমস্যার ফলে চূড়ান্তভাবে বঞ্চিত হচ্ছে আমাদের শিশুরা, যারা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। এই চক্র তাহলে ভাঙ্গবে কী করে?

বিভিন্ন কারণেই আমাদের দেশে শিক্ষকদের প্রি-সার্ভিস প্রশিক্ষণ জনপ্রিয়করণ সম্ভব হয়নি। ক্যারিয়ারের অনিশ্চয়তা এর অন্যতম কারণ। তাছাড়া শিক্ষকতা চাকুরি হিসেবে বেশিরভাগের কাছেই আরাধ্য নয়, অন্য কোনো পেশায় যেতে না পেরেই অনেকে শিক্ষকতায় আসেন। ফলে নিজের পড়াশোনা শেষে আবার শিক্ষা বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে পড়াশোনা করতে চান না অনেকেই।

ফলে ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ আমাদের একমাত্র ভরসা। সরকারি চাকুরি পাওয়ার পর বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের ডিপ্লোমা ইন প্রাইমারি এডুকেশন (ডিপিএড) এবং উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষকদের ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি নিতে হয়।

আগেই বলেছি, শিক্ষকতা করতে হলে শিক্ষা বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি সম্পন্ন করা আবশ্যক। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে আমাদের প্রচুর শিক্ষক নিয়োগ দিতে হয়, ফলে প্রি-সার্ভিস প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করে কিংবা এডুকেশনের ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু একজন শিক্ষক যখন চাকরিটা পেয়েই যান, তখন পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি নিতে, শিক্ষকতা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভে তাঁর আর বাধা কোথায়?

অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, আমি খুবই পরিতাপের সঙ্গে বলছি, শিক্ষকরা চাকরি পাওয়ার পর যেসব ডিগ্রি নেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলো ‘বনসাই’ ডিগ্রি। নিতান্তই না করে উপায় নেই বলেই করা। অবশ্য গ্রেড, বেতন-ভাতা, কাজের চাপসহ অনেককিছু নিয়েই শিক্ষকরা ক্ষুব্ধ, তার যৌক্তিক কারণও আছে, কিন্তু সেটি না শিখতে চাওয়ার অজুহাত হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

দেখা যায় যে, একে তো এই প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রিগুলো সংক্ষিপ্ত ও অপর্যাপ্ত—উপায়ন্তর নেই বলে শিক্ষকরা কোনোভাবে ডিগ্রিটা নিয়ে পিছলে বেরিয়ে যেতে চান। অন্যদিকে প্রশিক্ষকরাও তেমন গা করেন না।

আমি একটা পিটিআইতে কিছুদিন কাজ করেছি। পিটিআইয়ের সংস্কৃতিটাই হচ্ছে এমন যে, সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। কিছু না লিখে, অ্যাসাইনমেন্ট কপি করে, আক্ষরিক অর্থে ডিপিএড থেকে কিছুই না জেনে ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে গেছেন কিছু শিক্ষক। আমি ফেইল করাতে পারিনি, সেই ক্ষমতাই আমার ছিলো না। কাজেই যারা না শিখে কেবল ডিগ্রিটাই নিতে চান, তাদেরও তো তেমন সমস্যা হয় না। এই প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রির কাজটা তাহলে কী আসলে?

পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি ছাড়া দুই সপ্তাহ, এক মাস, তিন মাস, এক বছর, দেড় বছর এরকম যতো প্রশিক্ষণ বা টোটকা চিকিৎসাই দেয়া হোক না কেন, সেটি কোনো স্থায়ী ফলাফল দেবে না। এইসব ছোটোখাটো প্রশিক্ষণ থেকে নগদপ্রাপ্তি আছে, বাজেট থেকে পকেটে অংশবিশেষ পোরার সুযোগ আছে, কিন্তু তেমন কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নেই।

ভিত্তি নড়বড়ে থাকলে ওপরে খামোকা ইমারত তুলবার প্রচেষ্টা শোভনীয় নয়। খুব স্পষ্টভাবে যদি বলি, একজন শিক্ষক যদি শিক্ষকতায় পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি না-ই নিতে পারেন, শিক্ষক হিসেবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ না-ই করতে পারেন, তাঁর শিক্ষকতা করার কোনো অধিকারই তো থাকার কথা নয়। তাঁর কাছে শিশুদের তুলে দেয়ার যৌক্তিকতা কী? শিক্ষকস্বল্পতা? এভাবে আর কতোদিন?

পড়াশোনার সুবাদে ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। তার সুবাদে যেটুকু জানি, এখানে শিক্ষক হওয়া অত্যন্ত কঠিন। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা করতে হলে টিচার এডুকেশনে দুই বছরের একটা মাস্টার্স করতে হয় তিন বছরের স্নাতক ডিগ্রিসহ। এই ডিগ্রিতে মূল পড়াশোনা যেমন আছে, তেমনি আছে স্পেশালাইজেশনের সুযোগ। এর বাইরে ইন্টার্নশিপ করতে হয়, স্কুলে মূল শিক্ষকের সহকারী হিসেবে কাজ শিখতে হয়, এবং অত্যন্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে চাকরি পেতে হয়।

জনসংখ্যা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ফিনল্যান্ডের তুলনা চলে না, কিন্তু নিজের সক্ষমতার ভেতরে একটা ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত উন্নত করতে হবে, এই চিন্তাটাই যে চোখে পড়ে না বাংলাদেশে।

কেবল ফিনল্যান্ডের কথাই বা বলি কেন, পাশের দেশ ভারতে তো জনসংখ্যা কম নয়, তারা শিক্ষাখাতে ধনী-দরিদ্র বা শহর-গ্রামজাতীয় বৈষম্য নিয়ে ভুগছেও বেশ—কিন্তু তবুও তারা ‘আরটিই অ্যাক্ট (Right of children to free and compulsory education) ২০০৯’-তে শিক্ষকতায় আবেদন জন্য বিএড ডিগ্রিকে বাধ্যতামূলক করে ফেলেছে। এছাড়া শিক্ষকতা করার জন্য টিইটি (Teacher Eligibility Test) নামে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হতে হয়।

আমি সম্প্রতি পুনে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম, সেখানে এডুকেশন বিভাগ থেকে বিএসসি-বিএড নামে একটা ডিগ্রি দেয়া হয়, অর্থাৎ শিক্ষাবিজ্ঞান ও বিশেষায়িত জ্ঞানের কম্বিনেশন। ডিগ্রির নামটা আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি, তবে এর উদ্দেশ্যটি বেশ চমৎকার। কেউ শিক্ষার আদ্যন্ত শিখে এসে তারপর শিক্ষকতা শুরু করলে তাতে সুবিধা হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেই ব্যক্তির বিশেষায়িত জ্ঞানের সেবাটা একদম প্রথমদিন থেকেই পেতে থাকে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে হাস্যকর বিষয়টা হয়েছে সম্প্রতি। যখন আমাদের উচিত শিক্ষকদের দক্ষতাকে আরো বাড়ানোর চেষ্টা করা, তখন কিনা পরিকল্পনা চলছে ডিপিএডকে কাটছাঁট করার, সময় কমানোর। প্রতিবছরের জানুয়ারিতে ডিপিএড প্রশিক্ষণ শুরু হয়, তবে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এখনো এই প্রশিক্ষণ শুরু হয়নি। প্রশিক্ষকরা বসে আছেন।

এই সংকটের কারণ হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কিছু কর্মকর্তা আঠারো মাসের ডিপিএড প্রশিক্ষণ সময়টিকে কমিয়ে দশমাসে নামাতে চান, যেখানে কিনা আরো বাড়ানোর কথা, মান নিয়ে কাজ করার কথা। অর্থাৎ আমাদের যাত্রাটাই পশ্চাৎগামী। অবশ্য খুব অবাক হচ্ছি না। কারণ আমাদের শিক্ষাখাতটাই তো ‘যখন যা মনে চায়’ নীতিতে চলে।

অথচ শিক্ষাখাত নিয়ে ছেলেমানুষি নিরীক্ষা করার সুযোগ নেই। এসব সিদ্ধান্ত আসার কথা অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে, গবেষণা থেকে। বাংলাদেশে অবশ্য এসব সিদ্ধান্ত দেন প্রশাসকরা। প্রখ্যাত সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কর্মজীবনের একটি পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি সেই সময়করা অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন তাঁর ‘সমাজের হাতে ও রাষ্ট্রের খাতে প্রাথমিক শিক্ষা’ প্রবন্ধে। শিক্ষাক্ষেত্রে এরকম হুটহাট করে নেয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তিনি লিখেছেন,‌

ড্রপ আউটের গুপ্ত রহস্য আবিষ্কার করলেন আর-এক মনিষী। কি?—না, ছেলেমেয়েরা পরীক্ষায় ফেল করে বলে স্কুল ছেড়ে গিয়ে বাপের সঙ্গে লাঙল চষে। প্রতিকার করতে গিয়ে প্রস্তাব করা হল বার্ষিক পরীক্ষা উঠিয়ে দাও, সবাইকে পাশ করিয়ে দিলেই ছেলেমেয়েরা আর স্কুল ছাড়বে না। তাতেও কিছু হয় না। ড্রপ আউট এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যে পরস্পরের সঙ্গে জড়িতএই সোজা কথাটি তাঁদের মহামূল্যবান ঝুনা করোটি ফুঁড়ে ঢোকাবে কে?

অর্থাৎ কোনো গবেষণা, সমীক্ষা বা পর্যালোচনা ছাড়াই ইচ্ছেমতো অনুমাননির্ভর তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে সেটির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া চর্চা বাংলাদেশে নতুন নয়। আমরা অবশ্য এগুলো অনেকবারই দেখেছি। প্রশাসকরা শিক্ষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসেন, যদিও সেটি তাঁদের কর্মক্ষেত্র নয়।

কেবল শিক্ষকতা নয়, শিক্ষা প্রশাসন আর শিক্ষানীতিতেও শিক্ষাবিদ্যার বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের অগ্রগণ্য হবার কথা ছিলো। কারণ এই খাতটায় ভুল সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ নেই। তার মাশুল অনেক উচ্চ। একটা ভুল সিদ্ধান্তে একটা পুরো বছরের শিক্ষার্থীকে ভুগতে হবে, যেটি ডমিনো ইফেক্টের মতো পুরো ব্যবস্থাকে ধ্বসিয়ে ফেলতে পারে।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে হয়তো শিক্ষকতা করার জন্য প্রি-সার্ভিস ডিগ্রিকে বাধ্যতামূলক করা সম্ভব হবে না, কিন্তু ইন-সার্ভিস ডিগ্রিকে সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে একটুও শিথিলতা প্রত্যাশিত নয়। ক্রমে ক্রমে আমাদের এগোতে হবে সব শিক্ষককে চাকরি পাবার পর ব্যাচেলর অব এডুকেশন এবং বিশেষায়িত মাস্টার অব এডুকেশন ডিগ্রি নেবার ব্যাপারে।

ডিপিএডকে আমি পর্যাপ্ত মনে করি না, তবে এই মুহূর্তে যাওবা আছে, সেটিকে কমানোর অপচেষ্টা রীতিমতো আত্মঘাতী হবে। বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন আছে বলে এর বেশি মন্তব্য করা সমীচিন নয়, তবে প্রশাসকদের কাছে আমার প্রত্যাশা, তাঁরা যাতে বিশেষজ্ঞদের কথা শোনেন, ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন।

এবং সবশেষে, আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে নিবেদিত ও দক্ষ শিক্ষক উৎপাদনে। উৎপাদন শব্দটি ইচ্ছে করেই ব্যবহার করেছি। সুশিক্ষক তৈরি করতে হয়; সুশিক্ষকরা হঠাৎ করে এসে আবির্ভূত হন না।

শিক্ষায় ডিগ্রি নেয়া হবে শিক্ষকতায় আবেদন করার পূর্বশর্ত—ধীরে ধীরে আমাদেরকে সেই পর্যায়টায় যেতে হবে। সময় লাগবে, তবে অসম্ভব নয়। এজন্য অবশ্য শিক্ষায় ডিগ্রিকে আরো আধুনিক, সময়োপযোগী ও মানসম্পন্ন করাটাও খুবই জরুরি, তবে সেটি ভিন্ন আলোচনা।

লেখক পরিচিতি

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version