প্রাথমিক স্তরে ভাষা শেখা : বিষয় – বাংলা

ভাষার দক্ষতা চারটি— শোনা, বলা, পড়া, লেখা। আর ভাষা হলো যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। তাই আমাদের সঠিকভাবে যোগাযোগের জন্য ভাষা শেখাটা জরুরি। প্রশ্ন হলো, ভাষা আমরা কীভাবে আয়ত্ব করবো? অর্থাৎ ভাষার দক্ষতাগুলো কীভাবে শেখা যাবে। আমাদের মাতৃভাষা যেহেতু বাংলা, তাই আমরা জন্মের পর থেকেই চারপাশে বাংলা ভাষায় কথা শুনতে পারি, একটু বড় হয়ে এই ভাষায় বলতে পারি, পড়ালেখা করার সুবাদে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারি। কিন্তু বিদেশি ভাষা রপ্ত করার ক্ষেত্র অবশ্য ভিন্ন।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা শেখা ও বিদেশি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। আর এ কারণে প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে বাংলা ও ইংরেজি দুটি আলাদা বিষয় হিসেবে শিক্ষাক্রমে স্থান করে নিয়েছে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো ভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করানো।

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে আমরা জানতে পারি— আমাদের শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য হলো বাংলা ভাষা শুদ্ধ ও ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা। আর এই কাজটি করার জন্য বিষয় হিসেবে প্রাথমিক স্তর থেকেই বাংলা পড়ানো হয়ে থাকে।

প্রাথমিক স্তরের বাংলা পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রসঙ্গ কথায় আমরা দেখতে পাই, বাংলা পাঠ্যপুস্তকটি রচনার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে— বাংলা বাঙালির মাতৃভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষাও বাংলা। ফলে শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাংলা কেবল একটি বিষয় নয়, এটি সকল বিষয় শেখার মাধ্যম। এদিক থেকে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষায় শোনা, বলা, পড়া ও লেখার দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য। তাই বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী যেন শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা আনন্দময় পরিবেশে আয়ত্ত করতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখেই (প্রাথমিক স্তরের সকল শ্রেণির বাংলা বিষয়ের সাধারণ প্রসংগ কথা) শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তকটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলা ভাষা শিক্ষার বিস্তারিত জানা যাবে এখানে

আমাদের প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ভাষার চারটি দক্ষতাকে অর্জন করানোর জন্যই প্রণয়ন করা হয়েছে। পাঠ্যবই বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, প্রতিটি পাঠের শুরুতেই দেওয়া আছে পাঠে কী করতে হবে, এর ফলে কোন দক্ষতাটা অর্জন হবে অর্থাৎ শিক্ষকের জন্য একটি নির্দেশনা দেওয়া থাকে পাঠটি কীভাবে পড়াতে হবে। কোন পাঠটি শোনাতে হবে, কোন পাঠটি বলাতে হবে, কোনটি পড়াতে হবে ও কোনটি লেখাতে হবে তাও নির্ধারণ করা আছে। একজন শিক্ষক যদি নির্দেশনাটি যথাযথ অনুসরণ করেন, তাহলে একজন শিক্ষার্থী ভাষার চারটি দক্ষতাই সমানভাবে অর্জন করতে পারবে। এই কাজটি কতটুকু নিষ্ঠার সাথে করা হয় তা অবশ্য গবেষণার বিষয়।

প্রতিটি শিক্ষাস্তরের মাঝে ও শেষে ওই স্তরের শিক্ষা কতটুকু অর্জন করা হলো, তা যাচাই ও ফলাবর্তন প্রদানের জন্য বিভিন্ন ধরনের মূল্যায়ন ব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। তবে প্রাথমিক স্তরে আমরা সাধারণত সাময়িক পরীক্ষা ও বার্ষিক পরীক্ষাকেই গুরুত্বসহকারে দেখে থাকি। এছাড়াও আছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। সব পরীক্ষাতেই বাংলা বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকে অর্থাৎ বাংলা পাঠ্যবইটি কতটা আয়ত্ব করতে পারল তার পরীক্ষা নেওয়া হয়।

আমরা আগেই দেখেছি ভাষার দক্ষতা চারটি কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষাগুলোতে শুধু শিক্ষার্থীর একটি দক্ষতা অর্থাৎ লেখার দক্ষতাই পরিমাপ করা হয়। ব্যতিক্রম শুধু প্রথম শ্রেণির পরীক্ষা। এখানে শিক্ষার্থীর বলার দক্ষতাও পরিমাপ করা হয়। কিন্তু আর সব শ্রেণিতে শুধু পরীক্ষার খাতায় কিছু লিখতে পারলেই পরবর্তী স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারে।

বাংলা ভাষার চারটি দক্ষতার মূল্যায়ন করা যায়, তার ধারণা আমি প্রথম পাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে। সেখানে প্রথম বর্ষে সকল শিক্ষার্থীকে বাংলা ভাষা বিষয়টি পাঠ করতে হয়। আর এই কোর্সের শেষে একটি ব্যবহারিক পরীক্ষাও দিতে হয়। আর এই ব্যবহারিকে শোনা, বলা ও পড়ার দক্ষতা কতটা অর্জন করা হয়েছে তার বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়। এজন্য যা করানো হয় তা হলো—

১। শোনার জন্য: সবাইকে একটি সাউন্ডপ্রুফ রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে একটি প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সবাই তৈরি থাকে। তাদেরকে একটি অডিও শোনানো হয় আর এই অডিও শুনে তার থেকে উত্তর খুঁজে লিখতে হয়।

২। বলা ও পড়ার জন্য: শিক্ষক একজন একজন করে শিক্ষার্থীকে রুমে নিয়ে যান, সেখানে একটি অডিও রেকর্ডারের সামনে কোনো বই থেকে পাঠ করতে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীকে সেই অংশটুকু জোরে জোরে পড়তে হয়। শিক্ষক পরবর্তীতে অডিও চালিয়ে দেখতে পারেন উচ্চারণসহ অন্যান্য বিষয় শিক্ষার্থী বলতে পারছে কিনা ও পাঠ্যবিষয়টি যথানিয়মে পাঠ করতে পারছে কিনা।

এভাবে এখানে বাংলা ভাষার চারটি দক্ষতার কোনটি কতটুকু অর্জন করা হয়েছে তা যাচাই করা যায়।

আমরা চাইলেই এই কাজগুলো আমাদের প্রাথমিক স্তরে চালু করতে পারি। অর্থাৎ একটি ব্যবহারিক পরীক্ষার আয়োজন করতে পারি। তবে আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিসর ও অন্যান্য বিষয়ে কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য হয়ত এত জাঁকজমকপূর্ণভাবে শুরু করা যাবে না, তবে নিজস্ব পরিসরেও কাজটি করা যাবে। যেমন— আমরা যদি প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লিখিত পরীক্ষার সাথে সাথে ব্যবহারিক পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখি তবে দক্ষতার কতটা অর্জন করানো গেল তা পরিমাপ করা যাবে। যেমন—

১। শোনার জন্য: ক্লাশ শিক্ষক সামনে দাড়িয়ে কিছু বলবেন আর শিক্ষার্থীরা একে একে তার উত্তর দিবে। এভাবে শিক্ষক সহজেই শোনার দক্ষতার মূল্যায়ন করতে পারবেন।

২। বলার জন্য: শিক্ষক একে একে সবাইকে দিয়ে কিছু না কিছু বলাবেন, হতে পারে এটা কোনো কবিতা বা নিজের কোনো গল্প। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বলার দক্ষতার পরিমাপ করা যাবে।

৩। পড়ার জন্য: শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবইয়ের নির্বাচিত অংশ পড়তে দিয়ে পড়ার দক্ষতার পরিমাপ করা যাবে। এছাড়া আমরা প্রচলিতভাবে লেখার পরীক্ষা নিয়েই থাকি।

তাই দেখা যায়, এসব কাজের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ভাষার চারটি দক্ষতার কোনটি কতটুকু অর্জন করতে পারল, তা সহজেই পরিমাপ করা যাবে। এর মধ্যদিয়ে একজন শিক্ষার্থী ভাষা ব্যবহারে স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে। অর্জিত হবে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য।

জনপ্রিয় নিবন্ধ

আগে ইংরেজি গ্রামার শিখবো, নাকি ভাষা শিখবো?

কোন ভাষার গ্রামার হলো ঐ ভাষার গঠন প্রকৃতি যার...

শিক্ষাব্যবস্থার হালচাল

অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো। শিক্ষার অর্থনীতি নিয়ে মৌলিক গবেষণায় অর্থনীতিবদ আর্থার শুল্জ ও রবার্ট সলো দেখিয়েছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করলে সম্পদের সুফল ফেরত আসে ৩৫ শতাংশ, মাধ্যমিক শিক্ষায় ২০ শতাংশ, এবং উচ্চ শিক্ষায় ১১ শতাংশ।

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা : পিএইচডির পর কী?

আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়, আমি নিজেও এ-নিয়ে...

ক্যাডেট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা

ক্যাডেটসমূহ বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।...

আরও কিছু লেখা

অধিক

    শিক্ষকদের সন্তানদের নিজ বিদ্যালয়ে পড়ানো

    সিদ্দিকী শিপলু লিখেছেন শিক্ষকদের নিজ বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানোর প্রাথমিক...

    রোগীর সামাজিক পরিবেশ ও আমাদের ডাক্তারি বিদ্যা

    আমার সচরাচর খুব একটা অসুখ হয় না। এদিক দিয়ে...

    শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন: সংশ্লিষ্টদের বিড়ম্বনা

    ডিজিটালাইজেশন তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে তথ্যের আদান-প্রদানকে সহজলভ্য করে মানুষের সময়, শ্রম ও অর্থের সাশ্রয় করা। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা প্রণয়ন পর্যায়ে দেশে বিরাজমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সুবিধা ও সুবিধাভোগীদের প্রযুক্তিজ্ঞানের কথা যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি গৃহীত পদক্ষেপ বা পদ্ধতি কতটা সুবিধা দিতে পারছে তাও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। আর তাহলেই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো তথ্যপ্রযুক্তির অপার সম্ভাবনার রাজ্যে।

    বিনামূল্যে বই বিতরণ এবং শিক্ষার গুণগত মান

    আমাদের দেশ সমাজতান্ত্রিক দেশ নয় যে সরকারকে সব বই বিনামূলে বিতরণ করতে হবে। তাছাড়া সরকারের সে ক্ষমতাও ভালোভাবে নেই। শিক্ষাখাতে রয়েছে প্রচুর সমস্যা, বোর্ডের বই কেনা খুব একটা সমস্যা নয় অনেকের জন্যই। এমনটি নয় যে, বোর্ডের বইয়ের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশুনা করতে পারছে না।

    যোগাযোগ বৈকল্য: যোগাযোগে অক্ষম করা এক ব্যাধি – পর্ব ১

    যোগাযোগ বৈকল্য বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তেমন পরিচিত রোগ না হলেও...

    যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা – পিএইচডি নাকি মাস্টার্স

    মার্কিন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাইরেক্ট পিএইচডি করার সুযোগ আছে। অর্থাৎ,...

    প্রাথমিক শিক্ষায় আশা এবং হতাশা

    আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় ঝড়ে পড়া, শিক্ষার গুণগত মান,...

    বয়স্ক সাক্ষরতা : গালগল্প (প্রথম পর্ব)

    আ.ন.স হাবীবুর রহমান: উনিশ শত আশি এবং নব্বইয়ের দশক...

    প্রাসঙ্গিক নিবন্ধসমূহ

    নতুন লেখার খবর পান ইমেইলে
    বাংলাদেশের শিক্ষা প্রসঙ্গে নতুন লেখা প্রকাশিত হলে সেই খবর পৌঁছে যাবে আপনার ইমেইলে।