বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন

আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে

এক

সমুদ্রের তীরে বসে দীর্ঘ সময় রাতের খোলা নীল আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে ঘাড় ব্যথা করে ফেলেছি; কিন্তু কোনো রমণীর সুন্দর মুখ তো অনেক দূরের কথা, কোনো রমণীর কায়াটুকুও খুঁজে পাইনি। একইভাবে বৃক্ষরাজির পাশে বসে বহুবার রাতে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি; কোনো এলোকেশী নারীর এলোকেশ তো অনেক দূরের কথা, উড়ে আসা ধান গাছের কোনো শুকনো খড়ও দেখতে পাইনি। কারণ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য্যের ওপর গবেষণা করার আগ্রহ বা দক্ষতা কোনোটিই আমার মধ্যে জন্মাতে পারিনি। তাই আমি চাঁদকে চাঁদই দেখি, আর গাছকে গাছই দেখি। আমার এ-ব্যর্থতার উপমা দেয়ার একটিই কারণ, সেটি হলো প্রকৃতি ও প্রকৃতির কথা, জীবন ও জীবনের কথা, মানুষ ও মানুষের কথা, সমাজ ও সমাজের কথা ইত্যাদি যে কোনো বিষয়ের ওপর যিনিই গবেষণা করুন না কেনো, তিনিই গবেষক, তিনিই সত্য ও সুন্দরের সাধক।

বিজ্ঞানভিত্তিকই হোক বা শিল্পকলাভিত্তিকই হোক, আজ যে গবেষণালব্ধ তথ্য সঠিক বলে গ্রহণ করা হয়েছে, কালকে যে সেটি ভুল বলে প্রমাণিত হবে না, সেটি কেউই বলতে পারে না। গবেষণার ফল যাই হোক না কেনো, সত্যিকারের গবেষণা মস্তিষ্ককে শাণিত করে এবং সেই সঙ্গে সময় উপযোগী জ্ঞান দান করে। এই শাণিত মস্তিষ্ক আর সময় উপযোগী জ্ঞান দ্বারা যিনি শিক্ষার্থীকে পাঠদান করেন, তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে। এ জন্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতিতে গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতিতে তা করা হয় না। এটিই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি অন্যতম পার্থক্য। তাই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বা গবেষণার কোনো পরিবেশ নেই, তাকে বিশ্ববিদ্যালয় বলা যায় কিনা – এ প্রশ্ন আমার অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষতেও থাকবে, যে পর্যন্ত না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য অনুধাবন করতে পারেন।

আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ব্যক্তিবিশেষে উপস্থাপনা ভিন্নতর হলেও সত্যিকারের একজন ভালো গবেষক চাইলে ভালো শিক্ষক না হয়ে থাকতে পারেন না, কারণ তাঁর রয়েছে শাণিত মস্তিষ্ক ও সময়-উপযোগী জ্ঞান। ভালো শিক্ষক ও ভালো গবেষক একে অপরের পরিপূরক।

দুই

অনেক বিশ্লেষক (যদিও আমার মতে শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মানদণ্ড নির্ণয়ে শিক্ষার্থীরাই বড় বিশ্লেষক) বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও পাঠদানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চার ভাগে ভাগ করে থাকেন:

  • ভালো গবেষক এবং ভালো শিক্ষক;
  • ভালো গবেষক, কিন্তু ভালো শিক্ষক নন;
  • ভালো গবেষক নন, কিন্তু ভালো শিক্ষক;
  • ভালো গবেষকও নন, আবার ভালো শিক্ষকও নন।

প্রথম ক্যাটেগরির শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্যাটেগরির শিক্ষকদের নিয়ে আমার কিছুটা হলেও ভিন্নমত রয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, ব্যক্তিবিশেষে উপস্থাপনা ভিন্নতর হলেও সত্যিকারের একজন ভালো গবেষক চাইলে ভালো শিক্ষক না হয়ে থাকতে পারেন না, কারণ তাঁর রয়েছে শাণিত মস্তিষ্ক ও সময়-উপযোগী জ্ঞান। ভালো শিক্ষক ও ভালো গবেষক একে অপরের পরিপূরক। তাই, ভালো শিক্ষক অবশ্যই একজন ভালো গবেষক যদি না তিনি সময়-উপযোগী জ্ঞান অর্জনে ক্লান্ত না হয়ে পরেন। চতুর্থ ক্যাটেগরির একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধুই একটি আপদ। কীভাবে এবং কেন এই আপদের সংখ্যা কম-বেশি আমাদের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়েই চলছে তার কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকই শুধু নন, সকল সচেতন নাগরিকই অনুধাবন করতে পারেন বলে আমার বিশ্বাস।

তিন

কর্মচারি বা কর্মকর্তা নিয়োগে আমার মতো অনেক শিক্ষকেরই তেমন কোনো মাথাব্যাথা নেই, কিন্তু শিক্ষক নিয়োগে যখন মেধা ও গবেষণার (শাণিত মস্তিষ্কের) তেমন কোনো স্থান দেয়া হয় না, তখন অধিকাংশ শিক্ষকই দারুণভাবে মর্মাহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বিষয়টি মাথায় রেখে সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তাদের প্রতিও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। কারণ এ ধরনের শিক্ষক নিয়োগে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানই কমায় না, সেই সঙ্গে আমাদের প্রিয় সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার প্রতিযোগিতায় নামতে দারুণভাবে নিরুৎসাহিত করে। আমাদের একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, শিক্ষার্থীদের জন্যেই শিক্ষক, শিক্ষকদের জন্যে শিক্ষার্থী নয়। এ অনুধাবন থেকেই ২০১২ সনে আমার প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সম্মানিত শিক্ষক ও সহকর্মীগণ আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করেছিলেন এবং সেই সঙ্গে তৎকালীন শিক্ষক-নির্বাচনী বোর্ডের সভাপতি অর্থাৎ তৎকালীন উপাচার্যকে (অত্যন্ত দূরদর্শী ও উচ্চশিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায়) পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। এ অপ্রাসঙ্গিক কথাটি বলার উদ্দেশ্যে হলো, চতুর্থ ক্যাটেগরির শিক্ষক যে কয়েকটি স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে, তার একটি (ব্যক্তিগত স্বার্থ) পূরণ হলেও বাকি কোনোটিই পূরণ হয় না বলে অন্তত আমি মনে করি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্য সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যামে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার তুলনায় অনেকটাই উত্তম। কারণ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্বাচনী বোর্ডের অস্বচ্ছতার অভাবের প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয় না।

জাতীয় স্বার্থ, শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও সার্বিক মান রক্ষার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ ক্যাটেগরির শিক্ষক নিয়োগ বন্ধের কোনো বিকল্প নেই। আর তার জন্যে আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যামে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মৌলিকে পরিবর্তন। এজন্যে দরকার নতুন, গঠনমূলক ও নিরপেক্ষ নীতিমালা। আমার জানামতে, বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়া রয়েছে যেখানে চতুর্থ ক্যাটেগরির শিক্ষক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া অন্য সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যামে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার তুলনায় অনেকটাই উত্তম। কারণ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্বাচনী বোর্ডের অস্বচ্ছতার অভাবের প্রভাব আছে বলে আমার মনে হয় না।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যামে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক প্রভাব ও নির্বাচনী বোর্ডের অস্বচ্ছতার অভাবের প্রভাবমুক্ত (যেকোনো স্বার্থেই হোক না কেনো) আছে কি? এ প্রশ্ন আমার অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে – যে পর্যন্ত শুধু পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যামে শিক্ষক নিয়োগ চলতে থাকবে।

এটি সকলেই আনন্দের সাথে স্বীকার করবেন যে, আমাদের বর্তমান সরকার এতোই উচ্চশিক্ষাবান্ধব যে, উচ্চশিক্ষার্থে নবীন শিক্ষক, গবেষক বা সরকারি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন স্কলারশিপ বা ফেলোশিপের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ ডলার বিদেশে পাঠাতেও কার্পণ্য করছে না। কিন্তু হতাশ হই যখন দেখি নিজের চেষ্টাই অত্যন্ত সম্মানজনক স্কলারশিপ নিয়ে উন্নত দেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের ছলে-বলে-কলে-কৌশলে বাদ দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রিহীন ও তাদের চেয়ে অধিকতর কম মেধাবীদের (স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের ফল ও গবেষণাকর্মের ভিত্তিতেও) পাঁচ/দশ মিনিটের মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি কি সরকারের নীতিবিরুদ্ধ ও আমাদের মতো একটি দেশের জন্য অর্থের অপচয় নয়? এটি কি উন্নত দেশ থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের পরোক্ষভাবে উন্নত দেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করা নয়? এটি কি brain-draining-কে সহায়তা করা নয়? এ প্রশ্ন আমার সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগকর্তাদের কাছে থাকলো।

আবদুল্লাহ আল মামুন: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে