ইউরোপে আজকের যে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের স্বরূপ তা একদিনে অর্জিত হয় নি। শত বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহ, কূটনৈতিক কৌশলের প্রয়োগ আর স্নায়ুযুদ্ধের মধ্যদিয়েই এসেছে আজকের এই ইউরোপীয় সম্প্রীতি। এই নব্য ইউরোপীয় আন্তঃমহাদেশীয় জাতীয়তাবাদ সরাসরি উপকৃত করেছে কাদের? এককথায় যদি উত্তর দিতে চাই তবে বলতে হবে ‘তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের’ বা ‘গণমানুষের’। সৃজনশীল প্রশ্নের কাঠামোয় এবার বোধ্যগম্যতার পাঠ- গণমানুষ উপকৃত হয়েছে কাজের সুযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে। তো কোথায় কোন কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পেল, তা জানতে দেখি মহামহাশয় শিক্ষাদাদু সেখানে ঘুরাচ্ছে ছড়ি- বলে কি, “বাছা, কারণ নিয়ে মাথা ঘামা; তোদের দেশেও তো কাজের সুযোগ বৃদ্ধির প্রয়োজন!’ কথা সত্য; এত্ত মানুষ, তাদের এত্ত এত্ত হাত- আহা সব যদি কর্মীর হাত হয়ে যেত, তবে দেশের উন্নয়ন গাণিতিক সব হিসেব-নিকেশ ভেঙ্গে সেই কবে মাউন্ট এভারেস্টে পৌঁছে যেত। তো সেই ভেবে খুঁজতে গিয়ে অন্যতম কারণ পেলাম- বয়স্ক শিক্ষা। এই প্রবন্ধে আমরা ইউরোপে বয়স্ক শিক্ষার স্বরূপ উদ্ঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে এক্ষেত্রে কী পরিবর্তন এসেছে এবং তা কী প্রভাব ফেলেছে তা দেখার চেষ্টা করবো।
ইউরোপে বয়স্ক শিক্ষার শেকড় রোপিত হয়েছিল সেই রেঁনেসা যুগেই। সর্বস্তরের মানুষের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিতেই প্রচলন হয়েছিল বয়স্ক শিক্ষার। আজকের ইউরোপে বয়স্ক শিক্ষার পথিকৃৎ ‘ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য এডুকেশন অব অ্যাডাল্টস’ (২০০৬) বলছে যে, অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে উন্নত এবং সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক দেশসমূহে বয়স্ক শিক্ষার কাঠামো বা বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে উন্নত। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক দেশসমুহ যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে তা মোটামুটি তিন রকমে সীমাবদ্ধ:
প্রথমত, কোনো একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার সুযোগ না দেওয়া বা তা রোধকল্পে ব্যবস্থা নেওয়া যা সত্যিকার অর্থেই গুণগত দিক থেকে সমমানসম্পন্ন শিক্ষা ইউরোপের সকল এলাকায় নিশ্চিত করতে দারুণ ভূমিকা রেখেছে।
দ্বিতীয়ত, বৈচিত্র্যময় এবং নমনীয় কাঠামোয় গুণগত মানসম্পন্ন বয়স্ক শিক্ষার সুযোগ তৈরিতে প্রয়োজনীয় আইনী কাঠামো ও তার বিকাশে সহায়ক নীতি প্রণয়ন করা। এই পদক্ষেপ সারা ইউরোপে বয়স্ক শিক্ষার পরিসর যেমন বৃদ্ধি করেছে, তেমনি বৃদ্ধি করেছে জীবনের যে কোন সময়ে এসে পেশা পরিবর্তনের অনন্য সাধারণ সুযোগ।
তৃতীয়ত, ইউরোপে শিক্ষা প্রদানকারী নানা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অংশীদারিত্ব স্থাপনে উৎসাহিত করা এবং সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন। এই পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এখন একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে অপরিসীম স্বাধীনতা পাচ্ছে।
এই তিনটি পদক্ষেপ কীভাবে বয়স্ক শিক্ষার বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে? কোল্যারডিয়ান ও বোজমাভোল্ড (২০০৫) বলছেন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের অন্যতম সামাজিক সমস্যা ছিল প্রজন্মসমূহের মধ্যে ভাবনা, চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদক্ষতার ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক। বয়স্ক শিক্ষার বিস্তার সেই ব্যবধানকে কমিয়ে এনেছে ন্যূনতম পর্যায়ে। বয়স্ক শিক্ষাই একজন চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিকে আজকের ট্যাব-জেনারেশনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, অভ্যস্ত করে দিচ্ছে তাদের পরিবেশে। আর তাই আজ ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মহোদয়গণ খুব সহজেই মিশে যেতে পারছেন তাঁর সদ্য টিনেজ পেরোনো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, তাদের চিন্তা আর দর্শনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে খুঁজে পেতে পারছেন রত্নসম নবীন স্কলারদের। শুধু তাই নয়, সুইডিশ ন্যাশনাল অ্যাজেন্সি ফর এডুকেশন (২০০০) প্রমাণ করেছে যে, আজকের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিপ্লবে এই বয়স্ক শিক্ষার অবদানও অপরিসীম। যেমন- বিগতে দশকে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক পরিবর্তন বাস্তবায়নে যে হাজার হাজার দক্ষ কর্মী প্রয়োজন হয়েছে, তা সরবরাহ করতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে বয়স্ক শিক্ষা।
বর্তমানে ইউরোপে বয়স্ক শিক্ষার শিক্ষাক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ হলো- নিত্যনতুন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়, পেশাগত জীবনের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় নানা জ্ঞান ও দক্ষতা, সুনাগরিকত্ব বিষয়ক শিক্ষা, মূল্যবোধ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শারীরিক সুস্থতা-সংক্রান্ত শিক্ষা, শিক্ষকতার উৎকর্ষতা সাধনে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স, সামাজিক অভিযোজন-সংক্রান্ত শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে ওঠা ও দক্ষতা বৃদ্ধি-সংক্রান্ত শিক্ষা, আবেগ ব্যবস্থাপনা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক-কাজ-যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক শিক্ষা।
বর্তমানে ‘ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য এডুকেশন অব অ্যাডাল্টস’ বয়স্ক শিক্ষাকে কীভাবে ইউরোপে আরও বেশি জনপ্রিয় ও মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া যায়, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করছে। কারণ তারা মনে করছে- আগামী দিনে যখন মানুষের যোগাযোগ ও কাজের পরিধি বেড়ে যাবে আরও অনেক বেশি, তখন বয়স্ক শিক্ষা নেটওয়ার্কই মানুষকে দেখাবে মুক্তির পথ।
পুনশ্চ: আমরা হয়তো তখনও প্রজেক্টভিত্তিক ঠেলাধাক্কা মারা নৈশ স্কুলের ধারণায় রয়ে যাবো। বয়স্ক শিক্ষা বলতে বুঝবো বয়স্ক সাক্ষরতা কার্যক্রমকে। আহা, আমাদের কপালে যদি আর একটু বেশি উন্নতি লেখা থাকতো!
তথ্যসূত্র
Albert C. (Ed.) (1996), History of Adult Education in: International Encyclopedia of Adult Education and Training, ISBN 0-08-042305-1
Colardyn, D and Bjørnavold, J (2005), The learning continuity: European inventory on validating non-formal and informal learning, CEDEFOP Panorama series 117. Luxembourg: Official Office of Publication of the European Communities
EAEA (2006), Adult education trends and issues in Europe, Belgium
The National Agency for Education (2000), Lifelong learning and Life wide Learning, Stockholm, ISBN 91-89313-84-4
লেখক পরিচিতি
রিদওয়ানুল মসরুর বাংলাদেশের সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন বিভাগে সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
রিদওয়ান ভাই, এক কথায় অসাধারণ। বয়স্ক শিক্ষা সম্পর্কে নতুন কিছু জানলাম। আপনার সাথে আমিও বলতে চাইঃ
”আহা, আমাদের কপালে যদি আর একটু বেশি উন্নতি লেখা থাকতো”
আমার বিশ্বাস…আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বলবে- ভাগ্যিস আমাদের কপালে এত বেশি উন্নতি লেখা ছিল……
তুমি…আমি…আমরা…সেটা করবোই………//