বাড়ি শিক্ষক ও শিক্ষা

শিক্ষক-শিক্ষা সহজলভ্যকরণ: উপায় ও সম্ভাবনা

শিক্ষক ও শিক্ষা: ছবিসূত্র: elearning industry
শিক্ষক ও শিক্ষা: ছবিসূত্র: elearning industry

বিশ্বজুড়েই শিক্ষকতা পেশা হিসেবে খুব একটা যেন আকর্ষণীয় নয়। কম বেতন, খানিকটা অবহেলা আর কেমন যেন হেয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যদিয়েই বেঁচে আছে এ পেশা। উন্নত দেশে অবস্থা হয়তো খানিকটা আশাব্যঞ্জক; উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষক-শিক্ষা বিষয়টি নিরাশাব্যঞ্জক না হলেও তার কাছাকাছি তো বটেই। এটি নিয়ে হয়তো অনেকেই ভাবেন না; তবে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, খানিকটা ভাবনা-চিন্তা করেন, তারা হয়তো নিশ্চিতভাবেই বলতে পারেন যে এ অবস্থা আগামী শতকে থাকবে না। ক্রমেই বিশ্ব অনুভব করেছে- শিক্ষা, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রাথমিক শিক্ষাই নির্ধারণ করে দেয় ভবিষ্যতের চেহারা। যাই হোক, সেই উন্নত শিক্ষার জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক। আর যোগ্য শিক্ষকের জন্য প্রয়োজন যথার্থ শিক্ষক শিক্ষার ব্যবস্থা, তা বিষয়ভিত্তিক ও পেশাগত উভয়ই।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবখানা এমন যে- ছেলেমেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠালেই সব দায় শেষ। তো, সে সেখানে গিয়ে মানুষ হলো নাকি অর্ধ-মানুষ হলো নাকি মানসিক চিন্তাবিবর্জিত প্রবৃত্তিনির্ভর মানুষ হলো, যা কিনা চলতি ইংরেজিতে Zombie নামে পরিচিত, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না। এর পেছনে অবশ্য একটা কারণ বেশ উল্লেখযোগ্য যা হলো- ডিগ্রির পাট চুকলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া। সারা বিশ্বে যখন সবাই যখন পেশাগত জীবনে প্রবেশ করে সে বিষয়ে জানাশোনা ও দক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, বাংলাদেশে তখন সবাই কোনোরকমে একটা চাকরি বাগিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোয় আর সকাল-সন্ধ্যা যন্ত্রমানব আচরণে জীবন পার করে দেয়। আবার পেশাগত শিক্ষা যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তারাই এর থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। না থেকে কোনো উপায় আছে কি? শিক্ষকেদরকে পেশাগত শিক্ষা গ্রহণের জন্য যখন যেতে হয় বহুদূর, তখন হয়তো সে শিক্ষা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাটাই বিশেষ কাম্য বলে মনে হয়।

শিক্ষক-শিক্ষা সহজলভ্য করার উপায় হিসেবে অনেকেই ‘শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়’ বা ‘টিচার্স ট্রেনিং কলেজ’সমূহের সংখ্যাবৃদ্ধিকেই একমাত্র উপায় মনে করেন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতার নিরিখে ঘাটতি বাজেটে (যদিও তা উদ্বৃত্ত বাজেট হিসেবে দেখানো হয় জিডিপি ম্যাকানিজমকে বিশ্ববাজারে বিক্রয়যোগ্য করতে) প্রতি জেলায় জেলায় এ ধরনের বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা অনেকটাই ব্যয়সাধ্য। আর সেজন্যই তা কবে হবে সে আশায় অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই বোধহয়। আবার সে সকল প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ব্যয়, তা ব্যবস্থাপনা ব্যয় ইত্যাদি ভাবলে তা গুরুভার হয়েই দেখা দেয়।

এক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে দেশে বিদ্যমান অবকাঠামোকে শিক্ষক-শিক্ষার জন্য ব্যবহার করা। অন্যান্য অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশাল উচ্চশিক্ষা নেটওয়ার্ক। শিক্ষক-শিক্ষার জন্য এই নেটওয়ার্ককে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে তা হয়তো এক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষার চেয়ে অধিক ফলাফল বয়ে আনতে পারে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে যদি বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, মানবিক সব ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়, তবে কেন শিক্ষক-শিক্ষা চালু করা যাবে না তেমন কোনো যুক্তি হঠাৎ চোখে পড়ে না। এ বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ কারা করবেন, প্রতি বছর বছর কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষাবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থী পাবে, তা নিয়ে দুটি কথা বলা প্রয়োজন। সকল শিক্ষক, তা তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরই হোন কিংবা মাধ্যমিক বা কলেজের হোন, একজন ভালো শিক্ষক হয়ে উঠতে তার অবশ্যই শিক্ষাবিষয়ক জ্ঞান যেমন প্রয়োজন; তেমনি পেশাগত উৎকর্ষতার জন্য প্রয়োজন ডিগ্রির। প্রতিবছর যদি নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায় বিএড ও এমএড পর্যায়ে, তবে নিয়মিত শিক্ষার্থী না পাবার কোনো কারণ প্রতীয়মান হয় না। পাশাপাশি যারা শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তারাও এ ডিগ্রি নিতে পারেন।

অনেকের মতে, এক্ষেত্রে একটি সমস্যা হতে পারে দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক পাওয়া। বর্তমানে দেশের তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে পড়ানো হয়। সেখান থেকে যারা বের হবেন তাদের অনেকেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকতার মহান পেশায় আসতে চান। প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হতে পারেন না শুধু সুযোগের অভাবে। তাছাড়া এখন অনেক টিচার্স ট্রেনিং কলেজেও চার বছরমেয়াদী বিএড কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা বের হবেন, তারাও এখানে শিক্ষক হতে পারেন। আবার এই কলেজসমূহ থেকে যারা পড়াশোনা শেষ করে বের হবেন (চার বছরমেয়াদী অনার্স শেষে) তারাও হতে পারেন শিক্ষক। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে অন্য বিষয়ের মতো এ বিষয়েও শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব বলেই মনে হয়।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী যখন উভয়ই পাওয়া যাচ্ছে তখন প্রয়োজন অর্থ। সরকারের অর্থাভাব আসলেই রয়েছে একথা মাথায় রেখে যদি ভাবি- আমাদের দেশে শিক্ষাবিষয়ক অনেক ধরনের প্রজেক্ট হয়, সেসব প্রজেক্টের মাধ্যমেও কিন্তু ব্যয় নির্বাহের- অন্তত শুরুর সময়ের গুরুব্যয় মেটানো সম্ভব। পরবর্তী সময়ের নিয়মিত খরচ অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে মেটানো হয় সেভাবে মেটানো যাবে বলেই মনে হয়।

তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো- সরকার ও শিক্ষা সেক্টরের যাঁরা নেতৃস্থানীয় তাদের এ বিষয়টি অনুধাবন করতে হবে; নিতে হবে বাস্তবমুখী যথাযথ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ। পরিকল্পনাগুলো হতে হবে সময়ের বিচারে আধুনিক ও স্মার্ট, নমনীয় ও টেকসই। যুগের পর যুগ শিক্ষক-শিক্ষা এদেশে থেকেছে অবহেলিত ও প্রায় অদৃশ্য। সময় এসেছে পরিবর্তনের। সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চালুকরণ দেশে শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি সুদূরপ্রসারী ভাবনার প্রতিফলন। দেশজ শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিভাগ চালুকরণের উদ্যোগ অতিসত্বর নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার অর্ধশত বছর পর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিভাগ চালুকরণ নতুন করে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষা-সংক্রান্ত নানা পেশার মানুষের মনে যখন আশার আলো জ্বালিয়েছে, তখন এমনটি আশা করা বোধ করি খুব বেশি অমূলক হবে না যে, অচিরেই বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজসমূহে এ ধরনের বিভাগ চালু হবে। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন এমন হাজারো চোখ উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছে সেই দিনটির পানে।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Exit mobile version