সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে বাংলাদেশে সহিংসতা হয়ে উঠেছে নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। হাজারো কারণে হাজারো সহিংসতায় মরছে মানুষ হাজারে হাজারে। নানা কারণে- সে রাজনৈতিক কোন্দল হোক, হোক বাণিজ্যিক খাতে নানা পক্ষের গাফিলতি কিংবা সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানের অবহেলা– এসব অপমৃত্যু হয়ে গেছে সবার গা-সওয়া; যেন এতে কারও দায় নেই, নেই জবাবদিহিতা। কারও থাক বা না থাক, এতে শিক্ষাব্যবস্থার দায় যে রয়েছে তাতে বোধকরি শিক্ষাখাতের বোদ্ধাগণ সন্দেহ প্রকাশ করবেন না।
শিক্ষাব্যবস্থা শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার ‘শিক্ষা’ নিশ্চিত করার তরেই নয়, সবার জন্য নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ উন্নত জীবন নিশ্চিত করাও শিক্ষাব্যবস্থার একটি অন্যতম লক্ষ্য। শিক্ষাব্যবস্থা শুধু জনবলকে জনশক্তি, জনপুঁজি আর জনসম্পদে রূপান্তরিত করেই থেমে থাকে না; বরং সবার জন্য উন্নত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। সার্বিকভাবে মানুষের ব্যক্তি, সামাজিক, পেশাগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে শিক্ষার অবদান মানবসভ্যতায় বহমান নদীর প্রভাবের মতই বিস্তৃত ও বহুমুখী।
অথচ এই শিক্ষাব্যবস্থা পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট যাঁরা, এসব ভাবনা-চিন্তা তাঁদের ঠিক কতটা নাড়া দেয় তা বোধকরি এখন পর্যন্ত অসংজ্ঞায়িত। এ নিয়ে বিশেষ গবেষণা হয়েছে কিনা তা হয়ত ‘সাগর সেঁচে মুক্তা সন্ধান’-এর মতোই কঠিন। তথ্য-প্রযুক্তির বাঁধভাঙা জোয়ারে যখন সারা বিশ্ব ভেসে চলেছে মহাকালের অনন্ত সমুদ্রে, তখন বাংলাদেশী সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বিবেচিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অর্ধেকের বেশি শিক্ষক কম্পিউটারের মাউস ধরতে ভয় পান, এমনকি মোবাইল ফোনের মত দৈনন্দিন যন্ত্রটাও হয়তো অনেকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেন না। এটি কিন্তু যাঁরা পারেন না, তাঁদের দুর্বলতা নয়; এ দুর্বলতা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার। এই শিক্ষাব্যবস্থা তাঁদেরকে নিয়ত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলা শেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। তার ওপর আমাদের জাতীয় অভ্যাস ‘নোট লুকিয়ে রাখা’ যা শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সূচনাতেই প্রথম হবার দৌড়ের মাধ্যমে, রয়ে যায় একেবারে আমৃত্যু। তাই আমরা তথ্যের অবাধ শেয়ারেও হয়তো ঠিক বিশ্বাস করি না; আর হয়তো সেজন্যই দেশব্যাপী কোথায় কোন গবেষণা হয়েছে, তার ফলাফলই বা কী, কী সুপারিশই বা এলো সেই গবেষণা থেকে তা অজানাই থেকে যায় সবার– বাস্তবায়ন তো শুধুই স্বপ্ন। তারই ফলশ্রুতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকল্পনা যাঁরা করেন এবং যাঁরা বাস্তবায়ন করেন তাঁদের মধ্যে তথ্যের অবাধ প্রবাহ না থাকায় অনেক পেছনে পড়ে থাকছে বাস্তবায়নাধীন শিক্ষাব্যবস্থা।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে যে সকল দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার পেছনে অনেকেই অনেক কারণ উদ্ভাবন করেছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থার দায়টা কেউ উপলব্ধি করছে না। যারা গার্মেন্টস-কর্মী, তারা যেমন অবহিত নন যে কী ধরনের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা দিতে বাধ্য মালিকপক্ষ (আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শ্রম আইনের পরিপ্রেক্ষিতে), তেমনি শ্রম আইনের ব্যত্যয় ঘটলে কাকে কীভাবে অভিযোগ জানাতে হবে তাও অবহিত নন। তাদেরকে এসব বিষয়াদি অবহিত করার দায়িত্ব শিক্ষাব্যবস্থার। আবার এ ধরনের জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, কোন ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে করণীয় কী, কীভাবে কোন ধরনের উদ্ধারকাজ সহজে ও দ্রুত করা সম্ভব সে সম্পর্কেও জানা নেই সাধারণ মানুষের- যাঁরা প্রাণ বাজি রেখে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছেন- চালান- চালাবেন। এটাও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা বৈকি। আমাদের পাঠ্যপুস্তকসমূহে যে ধরনের পাঠ রয়েছে, তা কেবলই তাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়-বিষয়ক।
মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ব্যানারে ধর্মরক্ষার আন্দোলন সাম্প্রতিক সময়ে দেশবাসীকে আলোড়িত করেছে। এই আন্দোলন যদি কখনও চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসবাদী হামলায় রূপান্তরিত হয়, তবে তার দায়ও শিক্ষাব্যবস্থাকে নিতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদ্রাসা শিক্ষা চরম অবহেলিত। তারা যেন প্রাচীন পুঁথি-কালচার আর হালনাগাদ নয়, এমন সব তত্ত্বের জালে আবদ্ধ। আমরা তাদের আধুনিক বিশ্বের চলমান শিক্ষার সুযোগ দেইনি, ভাবিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত কোনো শিক্ষক সেখানে যাচ্ছেন কিনা। ভাবিনি মুক্তচিন্তার উদ্রেক করে এমন কোনো গ্রন্থ তারা পড়ছে কিনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা তারা করছে কিনা, বিশ্বসাহিত্য তাদের পাঠের তালিকায় আছে কিনা। তারা যদি মুক্তভাবে ভাবতে না পারে, সহনশীলতার সাথে দাবি-দাওয়া আদায়ের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে- তবে সে দায় কি শিক্ষাব্যবস্থার নয়?
শিক্ষা আমাদের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শেখায়, শেখায় অন্য ধর্ম-মত-জাতের মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে, শেখায় প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে কৌশলী হতে, উদ্বুদ্ধ করে জোর না করে বরং কৌশল প্রয়োগে দাবি আদায় ও সমঝোতায় পৌঁছাতে। তবে সে জন্য শিক্ষাকে হতে হবে উন্নত; শিক্ষাব্যবস্থাকে হতে হবে হালনাগাদ এবং সকলের জন্য একই ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে ভিন্ন ভিন্ন দার্শনিক ভিত্তিমূলের সৃষ্টি না হয়। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিতে যে দুর্যোগ-বিষয়ক অধ্যায় রয়েছে, সেখানে আরও অধিক হারে সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য দুর্যোগ-বিষয়ক তথ্যাদির সমন্বয় করতে হবে এবং পাঠসমূহকে করতে হবে অধিক মাত্রায় দক্ষতানির্ভর। প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা স্তরেও দুর্যোগ শিক্ষা আবশ্যিক করা যেতে পারে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা যাতে আধুনিক সাহিত্য, বিজ্ঞান ও দর্শন পাঠ ও অনুশীলনের সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সাথে সাথে যারা শিক্ষা পরিকল্পনার সাথে যুক্ত তাদের অবশ্যই চলমান আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে হালনাগাদ থাকতে হবে। তবেই নিশ্চিত হবে সামাজিক সৌহার্দ্য ও শান্তিময় স্থিতি।
লেখক পরিচিতি
রিদওয়ানুল মসরুর বাংলাদেশের সেভ দ্যা চিলড্রেন-এর কমিউনিকেশনস অ্যান্ড রিসোর্স মবিলাইজেশন বিভাগে সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।