রাষ্ট্রের কাছ থেকে নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন- এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করা হলে নিঃসন্দেহে সংসদ সদস্যরা তালিকার উপরের দিকে অবস্থান করবেন। তাঁরা জনগণের হয়ে কিংবা জনগণের জন্য অনেক কাজ করেন কিংবা কাজ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং এজন্য তাঁদের কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন- এতে কারোরই দ্বিমত নেই। তাঁরা টেলিফোন ভাতা পান। শুল্কমুক্ত গাড়ি আনতে পারেন। বাসায় বা অফিসে মেহমান আসলে আপ্যায়ন ভাতারও ব্যবস্থা আছে তাঁদের জন্য। বিদেশে যাওয়ার সুবিধা তো আছেই। সম্প্রতি বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন ভাতার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে। হয়তো বাসা ভাড়া কিংবা এরকম আরও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি সংসদ সদস্যরা নানাভাবে পেয়ে থাকেন। বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা যুক্ত হয়েছে এর সাথে।
প্রত্যক্ষ সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি পরোক্ষ অনেক সুযোগ-সুবিধাও সংসদ সদস্যরা পেয়ে থাকেন- যেগুলোকে কোনো হিসাবের মধ্যে আনা মুশকিল। কোনো সংসদ সদস্যের সন্তান এলাকার বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গেলে সে যে কারোর চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে। শুধু তাই নয়, সংসদ সদস্যের সহযোগীরাও এ ধরনের কিছু অগ্রাধিকার পায়। রাস্তাঘাটে চলাচল করলে সাধারণ মানুষ প্রায়শ যে ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হয়, সংসদ সদস্যরা সেসব থেকে প্রায় মুক্ত। এরকম নানা উদাহরণ দেয়া যাবে। অনেকক্ষেত্রে তাঁদের এসব সুযোগ-সুবিধা চাইতেও হয় না, এমনিতেই ব্যবস্থা হয়ে যায়।
তাছাড়া সংসদ সদস্যরা মোটাদাগে স্বচ্ছল মানুষ। ফলে যাবতীয় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তাদের হাতের নাগালেই। মোদ্দা কথাটা হলো, আমরা সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রের কাছ থেকে যতোটুকু সুবিধা পাই, একজন সংসদ সদস্য তার চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। সংসদ সদস্যরা মাসিক বেতনের বাইরে আর কী কী সুবিধা পান, সেগুলোর কোনো তালিকা আমার কাছে নেই। উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবগুলোই পত্রিকা মারফত জানা। হয়তো আরও অনেক সুবিধা আছে তাঁদের জন্য, কিংবা নেই- কিন্তু যতোটুকু জানা যায়, তাতে এইটুকু উপলব্ধি হয় যে, তাঁরা বড় সুখে আছেন!
এতো সুবিধার মধ্যেও সংসদ সদস্যদের জন্য মাঝেমধ্যে বাড়তি আরও সুবিধা তৈরির ঘটনাগুলো যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন নিজের কাছেই প্রশ্ন জাগে- একজন জনপ্রতিনিধি ঠিক কতোটুকু সুবিধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নিতে পারেন? যতদূর বুঝি, জনপ্রতিনিধিদের কাজ হচ্ছে জনগণের সেবা করা, আইন তৈরি করা কিংবা এ ধরনের বিষয়াদিতে প্রতিনিয়ত যুক্ত থাকা। সারা দেশে মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি; এর মধ্যে মাত্র ৩৫০ জন মানুষ নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হন। তাঁদের তো বড় বড় কাজ করতে করতেই নির্বাচিত মেয়াদের পাঁচটি বছর কেটে যাওয়ার কথা!
ছোটখাটো কাজের জন্য আরও অনেক মানুষ আছেন; আছে স্থানীয় পর্যায়ের প্রশাসন কিংবা অন্য অনেক প্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা ব্যাপারটিই ধরা যাক। কিছুদিন আগে হুট করে সংবাদমাধ্যমে খবর এলো যে, সারা দেশে বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তিতে সংসদ সদস্যদের জন্য আলাদা ভর্তির কোটা থাকছে। সেটা এক শতাংশ হবে নাকি দুই শতাংশ হবে সেটা তখনো ঠিক করা যায় নি। জানা গেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বেশ কিছুদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তিতে সংসদ সদস্যদের জন্য দুই শতাংশ ভর্তির কোটা দাবি করে আসছিলো।
কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্ত্বে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভা থেকে এই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেয়া হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সভায় আলোচনা হয় এবং সংসদীয় কমিটির সুপারিশকে উপেক্ষা করা যেহেতু সহজ কাজ নয়, সুতরাং বিষয়টি সেখানে যথাযথ গুরুত্ব পায়। সংবাদ মাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে এই কোটা বাতিল করা হয়।
সাধারণত পিছিয়ে পড়া কিংবা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটাপ্রথা চালু করা হয়- যাতে তারা উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতার মূল স্রোতে শামিল হতে পারে। যে কোটার ব্যবস্থা সংসদ সদস্যদের জন্য রাখার বন্দোবস্ত করা হচ্ছিলো, সেখানে পিছিয়ে পড়া কিংবা সুবিধাবঞ্চিতদের কথা মনে রেখেই কি তা করা হচ্ছিলো? এটি কি এমন কোনো বিষয় ছিল যেখানে সংসদ সদস্যদের মতো শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে? দুই শতাংশ ভর্তির কোটা যদি সংসদ সদস্যের জন্য যদি চালু হয়েই যেত, সেই কোটায় তাঁরা আসলে কাদের ভর্তি করাতেন? আদৌ কি তাঁরা সুবিধাবঞ্চিত কিংবা পিছিয়ে পড়া মানুষদের সন্তানদের ধরে ধরে এনে সেই কোটায় ভর্তি করাতেন? নাকি তাঁদের নিজেদের সন্তানদের কোটার আওতায় এনে ভর্তি করাতেন? নাকি অন্য কিছু ঘটার আশঙ্কা ছিল সেখানে?
পত্রিকাতেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে, শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাংসদদের জন্য ভর্তির কোটা রাখা হলে বৈষম্য বাড়বে, বাণিজ্য হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, সাংসদেরা যদি নিজেদের সন্তানদের জন্য কোটার কথা বলতেন, সেটা গ্রহণযোগ্য হতো। কিন্তু যেভাবে করা হচ্ছে, তাতে তাঁরা যে কাউকে ভর্তি করাতে পারবেন। এতে ভর্তি-প্রক্রিয়ায় রাজনীতি ও দুর্নীতি ঢোকার আশঙ্কা থাকছে (প্রথম আলো, ১২ নভেম্বর ২০১২)। বাংলাদেশ এক সময় দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন ছিল, এখনও নিচ থেকে উপরের সারিতেই দেশটির অবস্থান। সুতরাং এ অবস্থায় এ ধরনের কোটার পক্ষে যে যতোই যুক্তি দিক না কেন, ভর্তি-প্রক্রিয়ায় রাজনীতি ও দুর্নীতির ঢোকার আশঙ্কাটিই সবার আগে চলে আসে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাঁরা শেষ পর্যন্ত ঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছেন। নানা কারণে বর্তমান সরকার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। ঠিকমতো সিদ্ধান্তটি না নিলে জনমত তাঁদের পক্ষে যে যেত না, তা বলাই বাহুল্য। প্রধানমন্ত্রী নাকি বিষয়টি নিয়েই বিরক্ত হয়েছেন এবং এ ধরনের কোটা না রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। সংসদীয় কমিটি যতো জোরালোভাবেই সুপারিশ করুক না কেন, তা প্রধানমন্ত্রীর বিরক্তির কারণ হয়েছে। মূলত প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানের ফলে আজকে সংসদ সদস্যদের কোটার বিষয়টি বাতিল হয়েছে। যারা মন্ত্রণালয়ের সভায় ছিলেন, তাঁদের অনেকেই বিষয়টির বিপক্ষে অবস্থান করেছিলেন।
ঢাকার নামিদামি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরাও বিষয়টির বিরুদ্ধে তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীর অবস্থান কী ছিল জানি না, কিন্তু তিনি বরাবরই গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হয় এমন নীতিমালা তৈরির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছিলেন। সংসদ সদস্যদের জন্য ভর্তির কোটা রাখার ব্যবস্থাটি গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত কিনা, সেটা বুঝার জন্য খুব বেশি চিন্তার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু তিনি কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের অপেক্ষা করতে হলো তা বুঝা গেল না। গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত হওয়ার বিষয়টি কি তাহলে শুধু প্রধানমন্ত্রীর উপরই নির্ভর করছে?
একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বড় বড় অনেক কাজ করতে হয়, অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। এরকম একটি আপাত ছোট বিষয়কে ‘গ্রহণযোগ্য ও বাস্তবসম্মত’ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হলো কেন? দেশের তাবত সিদ্ধান্তের জন্য কি তাহলে প্রধানমন্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে? অন্য মন্ত্রীরা তাহলে কী জন্য আছেন? শিক্ষা-সম্পর্কিত এসব কাজের জন্য দায়িতপ্রাপ্ত হলেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি কেন নিজে থেকে এই সিদ্ধান্তটি নিতে পারলেন না? শিক্ষা-বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা সচিব বাধ্য কিনা তা জানা নেই, কিন্তু তারা কি পারতেন ভর্তির কোটা বিষয়টি নিয়ে পুনরায় সংসদীয় কমিটির সঙ্গে কথা বলতে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন- কোন বিচার বলে শিক্ষা-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এ ধরনের একটি সুপারিশ করতে পারলো?
শুধু তাই নয়, সুপারিশ বাস্তবায়নে কমিটি আবার মন্ত্রণালয়কে তাগাদাও দিয়েছে? এই কমিটির প্রধান হচ্ছেন অভিজ্ঞ বাম রাজনীতিক রাশেদ খান মেনন। তিনি কি জানেন না যতো কোটা বাড়বে, ততোই মেধার মূল্যায়ন কম হবে? আর এ ধরনের ভর্তির কোটা বাড়বে, ততোই তার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হবে? তাঁর মতো প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের কাছ থেকে এ ধরনের সুপারিশ আশা করা যায় না। কীভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের টেনে তোলা যায়- জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে সে ধরনের পদক্ষেপ আমরা আশা করি। বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা রাখার মতো বিষয়গুলোতে তাদের সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো কারণই নেই।
এ ধরনের চিন্তাভাবনা শিক্ষা-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি কেন করলো সেটা ভেবেই বরং অবাক হতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিষয়টির একটি সুন্দর সুরাহা হয়েছে সত্য, কিন্তু মানুষের কাছে ইতোমধ্যেই একটি ভুল বার্তা গেছে কিনা সেটি সংসদ সদস্যদের ভাবা উচিত। শিক্ষামন্ত্রীরও উচিত হবে বিতর্কিত বিষয়গুলোকে কৌশলের সঙ্গে মোকাবিলা করা। তাঁর প্রতি মানুষের এখনও এক ধরনের আস্থা আছে। সেই আস্থাটুকুই শিক্ষামন্ত্রীর বড় শক্তি হওয়া উচিত।
লেখক পরিচিতি
গৌতম রায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।